সামাজিক গবেষণার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা আলোচনা কর

সামাজিক গবেষণার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা আলোচনা কর

সামাজিক গবেষণার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা

ভূমিকাঃ সামাজিক গবেষণা হলো সমাজ জীবনকে জানা ও ব্যাখ্যা করার সুসংহত পদ্ধতি। সমাজ জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিভিন্ন বিষয় বা ঘটনা সম্পর্কে জানতে সামাজিক গবেষণা পরিচালিত হয়। সামাজিক বিষয়ক জ্ঞান ভান্ডার কে সুসংহত ও সমৃদ্ধ করার জন্য যেমন গবেষণা দরকার তেমনি সমাজ জীবনে উদ্ভূত সমস্যা মোকাবেলা ও অধিকতর উন্নত অবস্থায় সমাজবাসীর উত্তরণেও গবেষণার প্রয়োজন হয়। এরূপ অবস্থার প্রেক্ষিতে সামাজিক কল্যাণ সাধনে নিয়োজিত হতে বিশেষ জ্ঞান দক্ষতা অর্জন করা আবশ্যক। গবেষণা একটি বুদ্ধিবৃত্তীয় প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে কোন সমস্যাকে অনুধাবন বা শনাক্ত করা হয়। এ গবেষণার উল্লেখযোগ্য দিক হলো সামাজিক গবেষণা।

সামাজিক গবেষণার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা


সামাজিক গবেষণার গুরুত্ব  প্রয়োজনীয়তাঃ সমাজ পরিবর্তনশীল আর এ পরিবর্তনশীল সমাজ ব্যবস্থায় মানুষ নানা রকম জটিল সামাজিক সমস্যার সম্মুখীন হয়ে থাকে। এসব জটিল সামাজিক সমস্যার সমাধানে সামাজিক গবেষণার ভূমিকা অত্যান্ত তাৎপর্যপূর্ণ। নিম্ন সংক্ষেপে সামাজিক গবেষণার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে আলোচনা করা হলো 

১। সমাজ সম্পর্কে জ্ঞানঃ

সামাজিক গবেষণার মাধ্যমে কোন সমাজ সম্পর্কে জ্ঞান ও প্রজ্ঞার নতুন দিক উন্মোচন করে। এটি সমাজ জীবনের বাস্তবতাকে অনুধাবনে মুখ্য ভূমিকা পালন করে থাকে।


২। সামাজিক সমস্যার প্রকৃতি ও কারণ সম্পর্কে জানাঃ

পৃথিবীতে এমন কোন সমাজ নেই যেখানে কোন সমস্যা নেই। উন্নত কিংবা উন্নয়নশীল সকল দেশেই কম বেশি সামাজিক বিভিন্ন সমস্যা বিদ্যমান। বস্তুত সামাজিক গবেষণার মাধ্যমে বিদ্যমান এসব সমস্যার প্রকৃতি কারণ, উৎপত্তি, প্রভাব ও ব্যাপকতা সম্পর্কে অবহিত হওয়া যায় এবং তা থেকে উত্তরণের মাধ্যমে সুন্দর সমাজ বিনির্মাণ করা সম্ভব হয়।


৩। সঠিক জ্ঞান আহরণঃ

জ্ঞানই শক্তি এবং এটি একটি স্বতঃসিদ্ধ বাক্য। সামাজিক গবেষণার মাধ্যমে আমরা সমাজের প্রতিষ্ঠান, সংগঠন ইত্যাদি সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করছি। আর এ জ্ঞানের উপর ভিত্তি করে এসব প্রতিষ্ঠানকে নির্দিষ্ট লক্ষ্য সাধনের জন্য নিয়ন্ত্রণ করতে পারছি।


৪। উপাত্ত ভিত্তিক যোগাযোগঃ

সামাজিক গবেষণা সামাজিক কুসংস্কার এবং অজ্ঞতাজনিত বিপদ থেকে মুক্ত হতে সাহায্য করে। পৃথিবীর বিভিন্ন জাতি গোষ্ঠীর প্রতি মানুষের বিদ্বেষ ও হানাহানির মূলে রয়েছে ওইসব জাতিগোষ্ঠীর প্রতি পূর্ব সংস্কার বা বদ্ধমূল ধারণা। সামাজিক গবেষণা এসব পূর্বসংস্কার দূর করে মানুষের মধ্যে সম্প্রীতি ও পারস্পরিক শ্রদ্ধা সৃষ্টি করতে সাহায্য করে।


৫। সামাজিক পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নঃ

সামাজিক পরিকল্পনা ও নীতি প্রণয়ন এবং বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সামাজিক গবেষণার গুরুত্ব অপরিসীম। একমাত্র গবেষণালব্ধ উপাত্তের উপর ভিত্তি করেই সঠিক, কল্যাণকর ও বাস্তবমুখী সামাজিক নীতি ও পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা সম্ভব।


৬। সমাজকল্যাণ কর্মসূচিঃ

সামাজিক গবেষণা সমাজকল্যাণ কর্মসূচি প্রণয়নে সাহায্য করে। সামাজিক গবেষণার মাধ্যমে আমরা বিভিন্ন ধরনের সামাজিক সমস্যার কারণ ও ফলাফল সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করি। সুতরাং গবেষণার বা গবেষণালব্ধ জ্ঞানের ভিত্তিতে আমরা এসব সামাজিক প্রতিকারের পথ উদ্ভাবন করি।


৭। পূর্বোক্তিকরণ, সতর্কীকরনে সহায়তাঃ

সামাজিক গবেষণা পূর্বোক্তিকরণ, সতর্কীকরণ ও পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে সাহায্য করে।


৮। ভবিষ্যদ্বাণীকরণঃ

সামাজিক গবেষণা ভবিষ্যৎবাণী করতে এবং সংস্কারের লক্ষ্যে উপনীত হতে সমাজকে সাহায্য করে। সামাজিক গবেষণালব্ধ উপত্যের উপর ভিত্তি করেই সমাজের বিভিন্ন অবস্থা সম্পর্কে ভবিষ্যৎবাণী করা সম্ভব হয়। 

৯। অনুসন্ধান পদ্ধতির উন্নয়নঃ

সামাজিক গবেষণার আরেকটি উদ্দেশ্য হলো অনুসন্ধান পদ্ধতির উন্নয়ন। সমাজবিজ্ঞানীরা বিভিন্ন সামাজিক ঘটনাবলী সম্বন্ধে গবেষণা করার জন্য যেসব পদ্ধতি ব্যবহার করেন সোসব পদ্ধতির সবগুলোই সবধরনের সমস্যার জন্য উপযুক্ত নয়। প্রত্যেকটি পদ্ধতির সুবিধা অসুবিধা রয়েছে। সমাজবিজ্ঞানীরা বিভিন্ন ধরনের সমস্যা নিয়ে গবেষণা করার জন্য উপযুক্ত ও যুক্তিযুক্ত পদ্ধতি নির্ণয়ের জন্য গবেষণা করেন।

১০। প্রচলিত তত্ত্বের কার্যকারিতা যাচাই করাঃ সমাজের বর্তমান সমস্যা সম্পর্কে অনুধাবন করতে হলে নতুন তথ্য আহরণ করা দরকার। কারণ প্রগতিশীল বিজ্ঞানের প্রধান বৈশিষ্ট্য হল পুরাতন বা প্রচলিত তত্ত্ব ও সিদ্ধান্তকে অবিরামভাবে তুলনা করে দেখা।

১১। সামাজিক চালক সম্পর্কে জ্ঞান লাভঃ একজন লোকের ব্যক্তিগত আচরণ সম্পর্কে কিছু বলা দুষ্কর। যদিও কোন গোষ্ঠী বা দেশের লোকের আচরণ সম্পর্কে নতুব কিছু বলা ততটা কঠিন নয়। সামাজিক চলক সম্পর্কে জ্ঞান যত বেশি হবে গোষ্ঠী বা ব্যক্তি সম্পর্কে আরও অধিকতর সঠিকভাবে কিছু বলাও সম্ভব হবে। আর সামাজিক চলক সম্পর্কে অধিকতর জ্ঞান লাভ করতে হলে সামাজিক গবেষণা চালিয়ে যেতে হবে। 

১২। কার্যকারণ সম্পর্ক আবিষ্কার করাঃ সামাজিক ঘটনাগুলোর মধ্যে কার্যকরণ সম্পর্ক আছে আর এ কার্যকারণ সম্পর্কে বুঝতে হলে জানতে হলে তা কোন প্রচেষ্টা ছাড়া জানা সম্ভব না তার জন্য দরকার সামাজিক বিজ্ঞান গবেষণা যা সমাজিক কার্যকারণ সম্পর্কে জানার একটি প্রচেষ্টা।

১৩। নতুন তত্ত্ব ও পদ্ধতির উদ্ভাবনঃ

বিজ্ঞানের নতুন তত্ত্ব, ধারণা ও পদ্ধতি উদ্ভাবন করা প্রয়োজন সমাজের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের জন্য। আর এ সকল তত্ত্ব, ধারণা ও পদ্ধতি আবিষ্কার করা সম্ভব নয়, সামাজিক বিজ্ঞান গবেষণা ছাড়া।


১৪। সমাজের গতিশীলতা সম্পর্কিত জ্ঞান অর্জনঃ

সমাজের গতিশীলতা বুঝতে হলে সামাজিক বিষয়ের অনুধাবন, বিশ্লেষণ ও ব্যাখ্যার প্রয়োজন যা সমাজবিজ্ঞানে গবেষণা ব্যতীত সম্ভব নয়। 

উপসংহারঃ উপরোক্ত আলোচনা শেষে আমরা বলতে পারি সামাজিক গবেষণা হচ্ছে সামাজিক জীবন সম্বন্ধে অনুসন্ধান, বিশ্লেষণ, ধারণা ও তত্ত্ব সুসংবদ্ধ পদ্ধতি যার উদ্দেশ্য হলো জ্ঞান ভান্ডারের সমৃদ্ধি সাধন, সংশোধন এবং তার প্রতিপালন করা । সামাজিক গবেষণা সমাজ সম্পর্কে আমাদের নতুন জ্ঞান লাভে সাহায্য করে। এই জ্ঞানের মূল্য অপরিসীম। বিশ্বায়নের এই যুগে তথ্য প্রযুক্তি অভাবনীয় উন্নতির ফলে সৃষ্টি হয়েছে নানামুখী সমস্যা। আর এ সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য প্রয়োজন সামাজিক গবেষণা। সমাজস্থ বিভিন্ন কর্মসূচি প্রণয়ন, নীতি ও পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন, চলকের কার্যকারণ সম্পর্ক নির্ণয় নতুন নতুন তত্ত্ব উন্নয়ন এবং সর্বোপরি মানবিক কল্যাণে সামাজিক গবেষণার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম।


১. সামাজিক গবেষণা কী?
সামাজিক গবেষণা হলো সমাজ ও মানুষের আচরণ, সম্পর্ক, সমস্যা ও গঠনগত দিক বিশ্লেষণের উদ্দেশ্যে তথ্য সংগ্রহ, বিশ্লেষণ ও ব্যাখ্যার একটি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি।
২. সামাজিক গবেষণার প্রধান উদ্দেশ্য কী?
সামাজিক গবেষণার উদ্দেশ্য হলো সমাজের বাস্তব অবস্থা বোঝা, সমস্যার কারণ অনুসন্ধান, নীতি প্রণয়নে সহায়তা করা এবং ভবিষ্যতের জন্য কার্যকর সমাধান খোঁজা।
৩. সামাজিক গবেষণার ধরণ কী কী?
সামাজিক গবেষণার সাধারণ ধরণগুলো হলো:
- মৌলিক গবেষণা (Basic Research)
- প্রয়োগমূলক গবেষণা (Applied Research)
- গুণগত (Qualitative) ও পরিমাণগত (Quantitative) গবেষণা
৪. সামাজিক গবেষণায় কোন পদ্ধতিগুলো ব্যবহৃত হয়?
- সাক্ষাৎকার (Interview)
- প্রশ্নাবলি (Questionnaire)
- পরিদর্শন (Observation)
- ডকুমেন্ট বিশ্লেষণ (Content Analysis)
- স্যাম্পলিং ও পরিসংখ্যান পদ্ধতি
৫. গুণগত ও পরিমাণগত গবেষণার মধ্যে পার্থক্য কী?
গুণগত গবেষণা মূলত শব্দ, অর্থ ও অভিজ্ঞতা বিশ্লেষণ করে। এটি বেশি ব্যাখ্যামূলক।
আর পরিমাণগত গবেষণা সংখ্যাগত উপাত্ত সংগ্রহ ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে ফলাফল উপস্থাপন করে। এটি পরিমাপযোগ্য এবং তুলনামূলক সহজে সাধারণীকরণযোগ্য।
৬. সামাজিক গবেষণায় নৈতিকতা (Ethics) কেন গুরুত্বপূর্ণ?
গবেষণায় অংশগ্রহণকারীর গোপনীয়তা, সম্মতি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা জরুরি। নৈতিকতা মানলে গবেষণার বিশ্বাসযোগ্যতা ও গ্রহণযোগ্যতা বাড়ে।
৭. একজন ভালো সামাজিক গবেষকের গুণাবলি কী হওয়া উচিত?
- পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা
- বিশ্লেষণী মন
- বস্তুনিষ্ঠতা
- ধৈর্য ও নৈতিক সচেতনতা
- পদ্ধতিগত জ্ঞান ও গবেষণার প্রতি আগ্রহ
৮. সামাজিক গবেষণার ফলাফল কীভাবে ব্যবহার হয়?
এই গবেষণার ফলাফল সমাজবিজ্ঞান, নীতিনির্ধারণ, উন্নয়নমূলক পরিকল্পনা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, প্রশাসন ইত্যাদি ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত গ্রহণে ব্যবহার হয়।
Post a Comment (0)
Previous Post Next Post