সমাজবিজ্ঞান কী? সমাজবিজ্ঞান এর উৎপত্তি ও ইতিহাস

সমাজবিজ্ঞান কী? সমাজবিজ্ঞান এর উৎপত্তি ও ইতিহাস

ভূমিকা: সমাজকে জানার বিজ্ঞানের পথ মানুষ জন্মগতভাবে সামাজিক জীব। একাকী নয়, বরং সমাজবদ্ধ হয়ে বসবাস করাই তার স্বাভাবিক প্রবণতা। সমাজে বসবাস করতে গিয়ে মানুষ নানা রকম সমস্যা ও চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়। এসব সমস্যাকে বিশ্লেষণ করে, সমাজের গঠন ও কার্যপ্রণালী বোঝার প্রয়াস থেকেই জন্ম নিয়েছে একটি নতুন জ্ঞানশাখা সমাজবিজ্ঞান।

সমাজবিজ্ঞান কী সমাজবিজ্ঞান এর উৎপত্তি ও ইতিহাস


সমাজবিজ্ঞান: সমাজবিজ্ঞান হলো একটি বিজ্ঞান, যা সমাজে বসবাসরত মানুষের পারস্পরিক সম্পর্ক, সামাজিক কাঠামো ও মানবসমাজের বিভিন্ন দিক নিয়ে বৈজ্ঞানিকভাবে আলোচনা করে। সহজভাবে বললে, সমাজবিজ্ঞান সেই শাস্ত্র, যা সমাজবদ্ধ মানুষের জীবন ও তাদের পারস্পরিক কার্যকলাপ নিয়ে অধ্যয়ন করে।

এই শাস্ত্রের মূল উদ্দেশ্য হলো সমাজের গঠন, পরিবর্তন, সমস্যা এবং মানব আচরণের পেছনে থাকা কারণসমূহ বিশ্লেষণ করা। সমাজবিজ্ঞান ব্যক্তি নয়, বরং ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর মাঝে গড়ে ওঠা সামাজিক সম্পর্কগুলোকেই গুরুত্ব দিয়ে বিশ্লেষণ করে।

ইতিহাস ও পরিভাষা: সমাজবিজ্ঞান শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন ফরাসি দার্শনিক অগাস্ট কোঁৎ (Auguste Comte)। তিনি ১৮৩৮ সালে প্রথম Sociology শব্দটি ব্যবহার করেন এবং ১৮৩৯ সালে সমাজবিজ্ঞানকে একটি স্বতন্ত্র শাস্ত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন। “Sociology” শব্দটি এসেছে ল্যাটিন শব্দ Socius (সমাজ) ও গ্রিক শব্দ Logos (বিজ্ঞান)-এর সমন্বয়ে, যার অর্থ দাঁড়ায় “সমাজের বিজ্ঞান”। এই কারণে অগাস্ট কোঁৎ-কে ‘সমাজবিজ্ঞানের জনক’ বলা হয়ে থাকে।

সমাজবিজ্ঞানীদের দৃষ্টিতে সংজ্ঞাবিভিন্ন সমাজবিজ্ঞানী সমাজবিজ্ঞান সম্পর্কে ভিন্ন ভিন্ন সংজ্ঞা দিয়েছেন নিম্নে কয়েকটি সংজ্ঞা তুলে ধরা হলো। 

জি. সিমেল (G. Simmel) বলেন “সমাজবিজ্ঞান হচ্ছে এমন একটি বিজ্ঞান, যা মানব সম্পর্কের অধ্যয়ন করে।”

ম্যাক্স ওয়েবার (Max Weber) এর মতে “সমাজবিজ্ঞানের উদ্দেশ্য হলো সামাজিক কার্যাবলির অধ্যয়ন এবং তার কার্যকরণ সম্পর্কে ব্যাখ্যা করা।”

স্পেন্সার (Spencer) বলেন “মানবগোষ্ঠীর জীবন ও আচরণের পঠন-পাঠনই সমাজবিজ্ঞান।”

সমাজবিজ্ঞান পাঠের প্রয়োজনীয়তা:

১. সমাজ ও মানব আচরণ বোঝা: সমাজবিজ্ঞান আমাদের সাহায্য করে সমাজে বসবাসরত মানুষের আচরণ, মূল্যবোধ, সংস্কৃতি ও সম্পর্ককে গভীরভাবে বোঝতে। এটি জানায়, মানুষ কীভাবে সামাজিক নিয়ম মেনে চলে এবং কখন তা লঙ্ঘন করে।

২. সমস্যা চিহ্নিত ও সমাধানের পথ খোঁজা: সমাজে প্রতিনিয়ত বিভিন্ন সমস্যা (যেমন দারিদ্র্য, বেকারত্ব, বৈষম্য, অপরাধ, সামাজিক অবিচার) দেখা দেয়। সমাজবিজ্ঞান এসব সমস্যার কারণ ও প্রভাব বিশ্লেষণ করে এবং কার্যকর সমাধানের পথ বাতলে দেয়।

৩. সমাজ পরিবর্তনের ধারা বোঝা: সমাজ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তিত হচ্ছে। সমাজবিজ্ঞান আমাদের শেখায় এই পরিবর্তনগুলো কেন হয়, কীভাবে হয় এবং সমাজে তার প্রভাব কী।

৪. নৈতিক ও মূল্যবোধের শিক্ষা: সমাজবিজ্ঞান পড়লে সহানুভূতি, সহনশীলতা, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ও ন্যায়বিচার সম্পর্কে জ্ঞান বৃদ্ধি পায়। এটি একজন মানুষকে সচেতন ও দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলে।

৫. বিভিন্ন সামাজিক প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম বোঝা: সমাজবিজ্ঞান শিক্ষা দেয় কীভাবে পরিবার, ধর্ম, শিক্ষা, রাষ্ট্র ইত্যাদি সামাজিক প্রতিষ্ঠান সমাজে ভূমিকা পালন করে এবং কীভাবে তারা একে অপরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত।

৬. পেশাগত দিক থেকে সহায়ক: সমাজবিজ্ঞান সাংবাদিকতা, আইন, প্রশাসন, সমাজকর্ম, উন্নয়ন কর্মকাণ্ড, গবেষণা ইত্যাদি পেশার জন্য অত্যন্ত কার্যকর ভিত্তি গড়ে তোলে।

৭. আত্ম-উপলব্ধি ও আত্ম-পরিচয় গঠন: সমাজবিজ্ঞান আমাদের নিজের সমাজে নিজের অবস্থান বুঝতে সাহায্য করে। আমরা জানি কীভাবে সমাজ আমাদের ব্যক্তিত্ব, চিন্তা ও জীবনযাপনকে প্রভাবিত করে।

পরিশেষে বলা যায়, সমাজবিজ্ঞান হলো এমন একটি বিজ্ঞান, যা সমাজের বিভিন্ন সমস্যা, গঠন ও কার্যপ্রণালী বিজ্ঞানসম্মতভাবে বিশ্লেষণ করে। এটি আমাদের সাহায্য করে সমাজকে গভীরভাবে বুঝতে এবং সমাজের পরিবর্তনশীল গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে ধারণা পেতে। সমাজবিজ্ঞান শুধু জ্ঞান নয়, এটি একটি দর্পণ। যার মাধ্যমে আমরা নিজের সমাজ ও সমাজে নিজের অবস্থানকে উপলব্ধি করতে পারি।

No comments:

Post a Comment