ম্যানর প্রথা কী? ম্যানর প্রথার বৈশিষ্ট্য

ম্যানর প্রথা কী? ম্যানর প্রথার বৈশিষ্ট্য

ভূমিকাঃ- ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশদের শাসনের সময় কিছু ইউরোপীয় সামন্তপ্রথার পাশাপাশি ৮০০ থেকে ১২০০ শতকের মধ্যে আরেক ধরনের উৎপাদন তথা আর্থসামাজিক ব্যবস্থা গড়ে উঠে সে আর্থিক ব্যস্থার নাম ম্যানর প্রথা ব্যবস্থা। ১২০০ থেকে ১৩০০ এর বিস্তৃতিকাল এবং ১৩০০-১৫০০ শতাব্দীর মধ্যে পরিসমাপ্তি ঘটে।

ম্যানর প্রথা কী? ম্যানর প্রথার বৈশিষ্ট্য

ম্যানর প্রথাঃ মূলত জমিদারদের খাসখামারগুলোকে ম্যানর ব্যবস্থা বলে।কিছু খাস জমির সমন্বয়ে স্বনির্ভর আর্থসামাজিক কাঠামোর নাম ম্যানর ব্যবস্থা। ম্যানরকে উৎপাদন ব্যবস্থার একটা মৌল একক বলা হয়েছে যেখানে ম্যানর প্রধান চারদিকে কৃষক প্রজা পরিবেষ্টিত হয়ে স্বনির্ভর এক সমাজের পতন ঘটে। ম্যানরে তিনটি শ্রেণির মানুষ বাস করত। যথা- (ক) প্রধান শ্রেণি সামন্তপ্রভু ও কর্মকর্তারা (খ) দ্বিতীয় শ্রেণি মুক্ত মানুষ (গ) তৃতীয় শ্রেণি ভূমিদাস।

ভূমির শ্রেণিবিন্যাস ও ব্যবহার:

ম্যানরে বসবাস করার জন্য ভূমিদাসকে খাজনা, নজরানা ও কর দিতে হত। ভূমিদাসদের জীবন ছিলো পশুর মত। এমনকি বিবাহেও তাদের কোন স্বাধীনতা ছিলো না। ভূমির উর্বরতা অনুযায়ী ম্যানর এর ভূমিগুলোকে তিনভাগে ভাগ করা হতো যথা-

(i) অতি মাত্রার উর্বর - সাধারণত লর্ডের নিজস্ব জমি হিসেবে ব্যবহৃত হতো।

(ii) মাঝারি মাত্রার উর্বর - কিছুটা অংশ ভূমিদাস ও মুক্ত কৃষকদের দেওয়া হতো।

(iii) অতি কম মাত্রা উর্বর জমি - অনেক সময় পশুচারণ বা অনাবাদি রাখা হতো।

প্রথমোক্ত জমি Feudal Lordএর জমি বলে গণ্য হতো অন্যান্য জমিগুলো  Manor এর Serf দের মাঝে বন্টন করা হতো।

ম্যানর প্রথার বৈশিষ্ট্যসমুহ

ম্যানর প্রথার বৈশিষ্ট্যগুলোর মধ্যে প্রধান কয়েকটি বৈশিষ্ট্য সংক্ষেপে দেওয়া হলো

১। ম্যানর প্রথা গ্রামভিত্তিকঃ ম্যানরের কেন্দ্র ছিলো গ্রাম । ম্যানরের মধ্যে ইতস্তত বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকতো খামার বাড়ি। কৃষকেরা সাধারণত এসব খামারবাড়িতে বসবাস জরতপন না। তারা সাধারণত রাস্তার পাশে একটি কুটিরে দলবদ্ধভাবে বসবাস করতেন।

২। স্বয়ংসম্পূর্ণ অর্থনীতিঃ ম্যানর ছিলো সম্পূর্ণভাবে স্বয়ংস্পূর্ণ একটি অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান। মানুষের জীবনধারণের প্রায় সব কিছুই এখানে উৎপাদিত হতো।

৩। শ্রেণিবিভক্ত সমাজঃ ম্যানর ব্যবস্থার আরেকটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো শ্রেণিবিভক্ত সমাজ। এ সমাজে তিনটু শ্রেণি ছিলো। যথা লীর্ড ও তার সমগোত্রীয়, মুক্ত মানুষ ও ভূমিদাস।

৪। ভূমিব্যবস্থাঃ গ্রামের বিস্তৃত অংশে ছিলো ভূমি। এ জমির মধ্যে অনাবাদি জমির চেয়ে আবাদি জমির গুরুত্ব ছিলো সবচেয়ে বেশি।  ম্যানরের সব ভূমিতে ৬ ভাগে ভাগ করা হয়েছে।  একজনের জমি হতে অন্যজনের জমি আইল দ্বারা পৃথক করা হতো।

৫। লর্ডের প্রতি অনুগত জীবনঃ ম্যানর প্রথা এমন একটি প্রথা যেখানে ম্যানরের সকল জনগোষ্ঠীকেই একমাত্র লর্ডের অধীনে সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে অনুগত থাকতে হতো। এজন্য অনেকে বলেন লডের অর্থনৈতিক প্রয়োজনেই ম্যানর প্রথা গড়ে উঠেছিল।

সর্বশেষ বলা যায় ম্যানর প্রথা হচ্ছে একটি আর্থিক ব্যবস্থা যা মূলত জমিদারদের খাস খামারকে নির্দেশ করে। তবে এখানে শ্রেণি বিভক্তি লক্ষ্য করা যায় এবং কর ও খাজনা আদায়ের বিষয়টিকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। সব দিক বিবেচনায় ম্যানর প্রথা ছিল একটি জটিল, শ্রেণিভিত্তিক এবং স্বনির্ভর অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, যার মূল উদ্দেশ্য ছিল সামন্তপ্রভুর আর্থিক ও সামাজিক কর্তৃত্ব বজায় রাখা। যদিও এতে কিছুটা সামাজিক স্থিতিশীলতা বজায় থাকত, তবে এর ফলে কৃষক ও ভূমিদাসদের স্বাধীনতা প্রায় শূন্য ছিল। এই ব্যবস্থার পতন ঘটে রেনেসাঁ, নগরায়ণ, বাণিজ্য সম্প্রসারণ এবং কৃষিক্ষেত্রে প্রযুক্তিগত উন্নয়নের ফলে। শেষ পর্যন্ত, ম্যানর প্রথা এক ঐতিহাসিক অধ্যায় হয়ে উঠে, যা মধ্যযুগীয় ইউরোপের আর্থসামাজিক বাস্তবতা তুলে ধরে

No comments:

Post a Comment