বাংলাদেশের গ্রামীণ রাজনীতিতে অংশগ্রহণের সমস্যাসমূহ

বাংলাদেশের গ্রামীণ রাজনীতিতে অংশগ্রহণের সমস্যাসমূহ

ভূমিকা:- বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক দেশ। এদেশের সকল ধরনের কার্যক্রমে সকলের সমান অধিকার রয়েছে। আমাদের দেশের সকল কার্যক্রম সম্পাদনের জন্য রাজনীতি বেশ কার্যকরী ভূমিকা পালন করে। তবে আমাদের দেশের রাজনীতিতে অংশগ্রহণে নানা ধরনের সমস্যা বিদ্যমান রয়েছে।

বাংলাদেশের গ্রামীণ রাজনীতিতে অংশগ্রহণের সমস্যাসমূহ

গ্রামীণ রাজনীতিতে অংশগ্রহণের সমস্যাসমূহ

বাংলাদেশের গ্রামীণ রাজনীতিতে অংশগ্রহণে যেসব সমস্যার মুখোমুখি হতে হয় তা নিম্নে তুলে ধরা হলো।

১। রাজনৈতিক অবস্থা:

আমাদের দেশের রাজনৈতিক অবস্থা গ্রামাঞ্চলে তেমন কোন পরিবেশ সৃষ্টি হয়নি এর মূল কারণ গ্রামের মানুষ সাধারণত রাজনীতি পছন্দ করেনা। আর গরামের সকল জায়গায় মানুষ প্রত্যাশা করে কৃষি পণ্য সার, বীজ, তেল সরবরাহ এসব তাই তারা রাজনীতিতে তেমন মনোনিবেশ করে না।

২। অর্থনীতি:

গ্রামের মানুষের অর্থনীতি তেমন উন্নত নয়। তারা সাধারণত দিন আনে দিন খায়। আমাদের দেশে সকল কার্যক্রমে অর্থনীতি একটি মানদন্ড হিসেবে কাজ করে। গ্রামীণ অর্থনীতি অবস্থা দুর্বল হওয়ায় গ্রামের রাজনীতি তেমন একটা প্রসার লাভ করে না।

৩। যোগাযোগ ও পরিবহন সমস্যা:

আমাদের দেশের গ্রামাঞ্চলে যোগাযোগ ব্যবস্থা তেমন একটা উন্নত নয় কারন, গ্রামের রাস্তাঘাট তেমন একটা উন্নত নই। শহরের সাথে তেমন একটা যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে না উঠায় রাজনীতি এখানে তেমন প্রসার লাভ করতে পারে না।

৪। শিক্ষার অভাব:

আমাদের দেশে এমনিতে শিক্ষার হার খুবই কম। তবে গ্রামাঞ্চলে শিক্ষার হার আরো কম কারণ গ্রামের মানুষের মাঝে সচেতনতা কম। তাছাড়া গ্রামের মানুষের মাঝে সব ধরনের সুযোগ সুবিধা না থাকার কারনে শিক্ষার তেমন প্রসার লাভ করেনি ফলে রাজনীতি ও পিছিয়ে রয়েছে।

৫। কম প্রতিদ্বন্দ্বিতা:

আমাদের দেশের গ্রামাঞ্চলে মানুষের মাঝে রাজনীতি নিয়ে তেমন কোন প্রতিযোগিতা নেই। কারণ, গ্রামের মানুষ দুবেলা দুমুঠো ভাত পেলেই খুশী।তাই এদের মাঝে রাজনীতির প্রতিযোগিতা কম দেখা যায়। তাই রাজনীতি তেমন প্রসার হয় না।

৬। নৈরাশ্যবাদী মনোভাব:

আমাদের দেশের রাজনীতিতে বড় সমস্যা হলো নৈরাশ্যবাদী মনোভাব। কারণ, আমাদের দেশের গ্রামাঞ্চলে সাধারণত নৈরাশ্যবাদী মনোভাব পোষণের ফলে এখানে রাজনীতি দেমন একটা বিকাশ লাভ করতে পারেনি। যা পুরো রাজনীতির জন্য এক চরম বিপর্যয় সৃষ্টি করে।

৭। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের অভাব:

আমাদের দেশে গ্রামাঞ্চলের মানুষের মাঝে ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবাদ তেমন বিকশ লাভ করতে পারেনি। যা দেশের মানুষের মাঝে রাজনীতিতে অংশগ্রহণে একটা বাধা সৃষ্টি করে। তবে আমাদের দেশে সকল জায়গায় যদি ব্যক্তি স্বতন্ত্র্যবাদ টিকে থাকে তবে রাজনীতি ব্যাপকভাবে বিকাশ লাভ করবে এতে কোন সন্দেহ নেই।

৮। সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রভাব

গ্রামের মানুষ প্রায়শই সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রথার দ্বারা বাঁধা পড়ে। উদাহরণস্বরূপ, নারী বা যুবকরা পরিবারিক বা সম্প্রদায়ের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করে। সামাজিক বাধা এবং প্রথাগত দৃষ্টিভঙ্গি মানুষের স্বাধীন রাজনৈতিক অংশগ্রহণকে সীমিত করে।

৯। দলীয় রাজনীতির প্রভাব

গ্রামের মানুষ প্রায়ই দলীয় রাজনীতির শিকার হয়। বড় রাজনৈতিক দলের প্রভাব, স্থানীয় নেতাদের কৌশল ও দলীয় সুবিধার কারণে সাধারণ মানুষ নিজের মত প্রকাশ করতে সাহস পায় না। এটি রাজনীতিতে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে আরও একটি বড় সমস্যা।

১০। তথ্য ও সচেতনতার অভাব

গ্রামের মানুষ রাজনীতির নিয়ম, ভোটের গুরুত্ব বা সরকারি প্রকল্প সম্পর্কে সচেতন নয়। তথ্যের অভাব রাজনৈতিক অংশগ্রহণকে সীমিত করে। সম্প্রচার, গণমাধ্যম বা স্থানীয় প্রশাসনের প্রচারণার অভাব জনগণকে রাজনীতিতে কার্যকরভাবে অংশগ্রহণে অক্ষম করে।

১১। নারী অংশগ্রহণের সীমাবদ্ধতা

গ্রামীণ রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ সীমিত। সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বাধা, পরিবারিক দায়িত্ব, শিক্ষার অভাব এবং অর্থনৈতিক অসুবিধার কারণে নারী রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে সীমিত। নারীর অংশগ্রহণ বাড়ানো না হলে গ্রামের রাজনীতির সমতা ও কার্যকর অংশগ্রহণ কম থাকে।

১২। প্রাকৃতিক ও পরিবেশগত বাধা

বর্ষাকাল বা প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় গ্রামীণ এলাকায় রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড কঠিন হয়ে যায়। রাস্তা খারাপ, বন্যা বা অন্যান্য প্রাকৃতিক বাধার কারণে মানুষ সভা, সমাবেশ বা ভোটারদের সাথে সংযোগ করতে পারে না।

১৩। প্রযুক্তি ও ডিজিটাল অগ্রগতির অভাব

গ্রামীণ অঞ্চলে ইন্টারনেট ও তথ্য প্রযুক্তির সীমিত ব্যবহার রাজনৈতিক সচেতনতা এবং অংশগ্রহণ কমিয়ে দেয়। শহরের মতো ডিজিটাল প্রচারণা ও অনলাইন ভোটার সচেতনতা গ্রামে পৌঁছায় না। ডিজিটাল মিডিয়ার ব্যবহার গ্রামীণ এলাকায় সীমিত। খবর, রাজনৈতিক বিশ্লেষণ ও সচেতনতা মূলত শহরে পৌঁছে। ফলে গ্রামের মানুষ রাজনীতি সম্পর্কে কম জানে এবং অংশগ্রহণ সীমিত থাকে।

১৪। দলীয় কেন্দ্রিক মনোভাব

গ্রামীণ এলাকায় রাজনৈতিক দলগুলো প্রায়শই নিজের স্বার্থ বা ক্ষমতার জন্য কাজ করে। স্থানীয় জনগণ প্রায়ই দলের চাপে বা নেতাদের প্রভাবের কারণে স্বাধীনভাবে অংশগ্রহণ করতে পারে না। দলীয় কেন্দ্রিক মনোভাব সাধারণ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত রাজনৈতিক অংশগ্রহণকে সীমিত করে।

১৫। স্থানীয় নেতৃত্বের দুর্বলতা

কোনো গ্রামে শক্তিশালী ও দায়িত্বশীল স্থানীয় নেতৃত্ব না থাকলে রাজনৈতিক কার্যক্রম স্থবির হয়ে যায়। নেতাদের দুর্বলতা বা স্বার্থপরতা সাধারণ মানুষকে রাজনীতিতে অংশগ্রহণ থেকে বিরত রাখে।

১৬। রাজনৈতিক সহিংসতা ও হুমকি

কিছু গ্রামীণ অঞ্চলে রাজনৈতিক সংঘাত বা সহিংসতার ঝুঁকি থাকে। নির্বাচনী সময়ে বা রাজনৈতিক কার্যক্রমে সহিংসতা, ভয় ও হুমকির কারণে মানুষ রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করতে চায় না।

১৭। রাজনৈতিক স্বার্থচিন্তা

গ্রামীণ মানুষের রাজনীতিতে অংশগ্রহণ সীমিত থাকে, কারণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে তাদের মতামত গ্রহণ করা হয় না। রাজনৈতিক স্বার্থচিন্তার কারণে সাধারণ মানুষ মনে করে তাদের অংশগ্রহণের কোনো মূল্য নেই।

১৮। সামাজিক বৈষম্য

গ্রামে প্রায়শই বর্ণ, ধর্ম, সামাজিক শ্রেণি বা সম্পদের ভিত্তিতে বৈষম্য থাকে। এই বৈষম্য সাধারণ মানুষকে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ থেকে বিরত রাখে।

১৯। সীমিত রাজনৈতিক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ

গ্রামীণ এলাকায় মানুষ প্রায়ই রাজনৈতিক ধারণা, প্রক্রিয়া ও নাগরিক অধিকার সম্পর্কে পর্যাপ্ত শিক্ষিত নয়। রাজনৈতিক প্রশিক্ষণ ও কর্মশালার অভাব রাজনৈতিক অংশগ্রহণকে সীমিত করে।

২০। অর্থনৈতিক ও কর্মসংস্থানের চাপ

গ্রামীণ মানুষের জীবনযাত্রা প্রায়শই দৈনন্দিন চাহিদা পূরণে সীমাবদ্ধ। গ্রামীণ জনগণের অর্থনৈতিক চাপের কারণে রাজনৈতিক সভা, প্রচারণা বা নির্বাচনী কার্যক্রমে অংশগ্রহণ কম হয়।

২৫। স্থানীয় সমস্যা ও কেন্দ্রীয় মনোভাবের ফারাক

গ্রামের মানুষের রাজনৈতিক চাহিদা প্রায়শই স্থানীয় সমস্যা (রাস্তা, পানি, শিক্ষা) কেন্দ্রিক। কেন্দ্রীয় সরকারের নীতি বা দলীয় কর্মকাণ্ড যদি গ্রামীণ মানুষের জীবনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ না হয়, তবে তারা রাজনীতিতে অংশগ্রহণে আগ্রহী হয় না।

২৭। যুবক ও ছাত্র অংশগ্রহণের সীমাবদ্ধতা

যুবকরা সাধারণত শিক্ষা বা কর্মসংস্থানের চাপে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে সীমিত অংশগ্রহণ করে। ছাত্রদের মাঝে রাজনীতির প্রতি আগ্রহ কম থাকলে রাজনীতি দীর্ঘমেয়াদে দুর্বল হয়ে যায়।

২৮। ভোটার ও প্রশাসনিক দুর্বলতা

ভোটগ্রহণের সময় নির্বাচনী প্রচারণা, ভোটিং বুথের দূরত্ব ও প্রশাসনিক জটিলতা মানুষকে অংশগ্রহণে বাধা দেয়। অনেক মানুষ ভোট দিতে আগ্রহী হলেও প্রশাসনিক সমস্যা তাদের বাধাগ্রস্ত করে।

২৯। প্রাকৃতিক ও পরিবেশগত বাধা

বর্ষাকাল, বন্যা বা দূর্যোগের কারণে গ্রামের মানুষ রাজনৈতিক সভায় অংশগ্রহণ করতে পারেনা। রাস্তা খারাপ বা প্রাকৃতিক বাধা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডকে প্রভাবিত করে।

৩০। জনগণের দুর্বল সচেতনতা

গ্রামীণ মানুষের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা সীমিত। তারা রাজনীতির গুরুত্ব ও ভোটের অধিকার সম্পর্কে সম্পূর্ণভাবে জানে না। সচেতনতার অভাবে মানুষের অংশগ্রহণ কম হয়।

পরিশেষে বলা যায় আমাদের দেশে গ্রামীণ মানুষ সাধারণ জীবন-যাপন করে এবং দারিদ্র্যতা ও অশীক্ষা বিদ্যমান যার ফলে রাজনীতিতে তেমন সক্রিয় নই। বাংলাদেশের গ্রামীণ রাজনীতিতে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে একাধিক সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। দারিদ্র্য, শিক্ষার অভাব, অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা এবং রাজনৈতিক অবস্থা এই সবই গ্রামীণ জনগণের রাজনৈতিক অংশগ্রহণে প্রধান বাধা।

এই সমস্যাগুলোর সমাধান করতে হলে, প্রথমে শিক্ষা ও সচেতনতা বৃদ্ধির উদ্যোগ নিতে হবে। পাশাপাশি গ্রামাঞ্চলের অবকাঠামো উন্নয়ন, রাজনৈতিক দলগুলোর কার্যক্রমের বিকেন্দ্রীকরণ এবং স্থানীয় নেতৃত্ব গঠনে উৎসাহ প্রদান জরুরি।

No comments:

Post a Comment