রাজনৈতিক সমাজবিজ্ঞানের উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ আলোচনা
ভূমিকা:- রাজনৈতিক সমাজবিজ্ঞান (political sociology) হলো মূলত একটি মিশ্র প্রকৃতির বিজ্ঞান। সমাজবিজ্ঞান ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সমন্বয়ে রাজনৈতিক সমাজবিজ্ঞান লাভ করে। এই দুই বিজ্ঞানের মধ্যে চলমান সংযোগ সম্পর্কের ফলে রাজনৈতিক সমাজবিজ্ঞানের আবির্ভাব হয়েছে। বিংশ শতাব্দীর পূর্ব থেকেই মানুষের জ্ঞান চর্চার অগ্রগতির ফলেই সমাজবিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখা সমূহ পৃথকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। এই শাখাগুলিতে ভিন্ন ভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোকপাত করা হয়। আর এই শাখাগুলোর মধ্যে রাজনৈতিক সমাজতত্ত্বের আবির্ভাব মূলত আধুনিককালে। যদিও এর আবির্ভাব আধুনিককালে তারপরও এর বিকাশ এখনও বর্তমান। বর্তমানে বিশ্বের গতিশীল রাজনীতিতে রাজনৈতিক সমাজতত্ত্বের নতুন নতুন ধারা সংযোজিত হচ্ছে যার ফলে মানুষের নিকট রাজনৈতিক সমাজবিজ্ঞান পরিধি বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং জনপ্রিয় হয়ে উঠছে।
রাজনৈতিক সমাজবিজ্ঞান উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ
সমাজবিজ্ঞান বিভাগ সমূহের মধ্যে রাজনৈতিক সমাজবিজ্ঞানের আবির্ভাব মূলত আধুনিককালে। এটি উদ্ভব আধুনিককালে হলেও এর বিকাশ এখনও বর্তমান। বর্তমান বিশ্বের গতিশীল রাজনীতিতে রাজনৈতিক সমাজবিজ্ঞানে নতুন নতুন ধারা সংযোজন হওয়ায় এর জনপ্রিয়তা ও দিন দিন বেড়ে চলেছে। নিম্নে রাজনৈতিক সমাজবিজ্ঞানের উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ আলোচনা করা হলো-
১। শিল্পবিপ্লবের প্রভাব
রাজনৈতিক সমাজবিজ্ঞানের উদ্ভব ও ক্রমবিকাশে শিল্পবিপ্লবের প্রভাব ব্যাপকভাবে পরিলক্ষিত।সেই সময়ে ব্যাপক শিল্পায়নের ফলে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সুদূরপ্রসারী পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়। এই সময়ে বিভিন্ন সামাজিক শক্তি ও সমস্যা মাথাচড়া দিয়ে উঠে। যার ফলে এই বিষয়গুলো নিয়ে সুনির্দিষ্ট ভাবে আলোচনার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। আর এ ধরনের প্রয়োজনীয়তার প্রেক্ষিতে একটি গবেষণামূলক ও অভিজ্ঞতালব্ধ সামাজিক বিজ্ঞান হিসেবে রাজনৈতিক সমাজবিজ্ঞানের উদ্ভব হয় । প্রথমত এর পরিধি সীমিত থাকলেও বর্তমানে পরিধি ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে।
২। কার্ল মার্কসের অবদান
রাজনৈতিক সমাজবিজ্ঞানের উদ্ভব ও ক্রমবিকাশে কার্ল মার্কসের অবদান অপরিসীম। কার্ল মার্কসই (karl marx) প্রথম ব্যক্তি যিনি রাজনৈতিক সমাজতত্ত্বের আলোচনার সূত্রপাত ঘটান। মূলত তিনি হেগেলীয় যে রাষ্ট্রদর্শন ছিলো তা মার্কস সমালোচনা করেন। এছাড়া ইতিহাসে মার্কসীয় বস্তুবাদী ব্যাখ্যা যেখানে তিনি বলেন বস্তুই বাস্তবতার মূল ভিত্তি। এবং কার্ল মার্কসের শ্রেণি সংগ্রাম তত্ত্ব এর মাধ্যমে রাজনৈতিক সমাজবিজ্ঞানের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের সূত্রপাত ঘটে।
৩। ম্যাক্স ওয়েবারের অবদান
রাজনৈতিক সমাজবিজ্ঞানের উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ আলোচনায় ম্যাক্স ওয়েবারের অবদান গুরুত্বপূর্ণ। তিনি মূলত একজন জার্মান সমাজবিজ্ঞানী। তিনি মূলত মার্কস প্রদত্ত বিভিন্ন ধারণার সমালোচনা করেন। ম্যাক্স ওয়েবার রাজনৈতিক সমাজবিজ্ঞান বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ মতামত ব্যক্ত করেন যেখানে মার্কসীয় ধারণা শুধু অর্থনৈতিক ধারণাকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হয়েছে সেখানে ওয়েবার বিভিন্ন অর্থনৈতিক ধারণা ও অন্যান্য উপাদানকে গুরুত্বপূর্ণ সমাজতাত্ত্বিক উপাদান হিসেবে চিহিৃত করেন।
৪। ওয়ালটার বেজহট
কার্ল মার্কসের সময়কালীন একজন শিক্ষাবিদ হলেন ওয়ালটার বেজহট। রাজনৈতিক সমাজবিজ্ঞানের উদ্ভব ও ক্রমবিকাশের পিছনে তার গুরুত্বপূর্ণ অবদান বিদ্যমান। ওয়ালটার বেজহটের English Constitution গ্রন্থ ১৮৬৭ সালে প্রকাশিত হয়। সেখানে তিনি উল্লেখ করেন যে জাতি হিসেবে ব্রিটিশদের বাধ্যতামূলক আনুগত্যের কারণে তাদের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান সমূহের মধ্যে এবং সংস্কৃতি ও ব্যক্তিত্বের মধ্যে সংযোগ সম্পর্ক নির্ধারণের ব্যাপারে যত্নবান হয়েছেন। তার Physics of Politics গ্রন্থটি রাজনৈতিক সমাজতত্ত্বকে সমৃদ্ধ করেছে।
৫। টকভিলের অবদান
রাজনৈতিক সমাজবিজ্ঞানের উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ এ ম্যাক্স ওয়েবার ও কার্ল মার্কসের পর সমসাময়িক চিন্তাবিদ টকভিলের বিশেষ অবদান বিদ্যমান। তার মতে, বিরতিহীনভাবে মানব সমাজে পরিবর্তন হচ্ছে। সামাজিক পরিবর্তনের প্রক্রিয়া ও প্রকৃতিতে পরের বহু ধ্যান ধারণার আগাম বার্তা পাওয়া যায়। এ ধরনের বিষয়গুলো রাজনৈতিক সমাজবিজ্ঞানকে সমৃদ্ধ করেছে।
৬। ইউরোপীয় সমাজতাত্ত্বিকদের অবদান
রাজনৈতিক সমাজবিজ্ঞানের উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ এ ইউরোপীয় সমাজতাত্ত্বিকদের অবদান বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সেই সময়ে তাদের নতুন নতুন কিছু বিষয়ের অন্তর্ভূক্ত সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ রাজনৈতিক সমাজবিজ্ঞানকে আরও সমৃদ্ধ করে।
রাজনৈতিক সমাজবিজ্ঞানের উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ এলিটদের (Elite) অবদান অপরিসীম। এলিট তত্ত্ব মূলত নতুন নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে রাজনৈতিক দল এবং তাদের আচার-অচরণের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ দেন যা রাজনৈতিক সমাজবিজ্ঞানের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এই এলিট তত্ত্বের বিকাশের জন্য যাদের নাম জড়িত তারা হলেন প্যারেটো ও মস্কা। সমাজবিজ্ঞানী প্যারেটোর মতে এলিট শ্রেণির আবর্তন বা পালাবদল চক্রাকারে ঘোরে আর এই এলিট শ্রেণির পালাবদলের ফলে রাজনীতি ও সমাজে পরিবর্তন ঘটে।
৮। গবেষণাপ্রসূত উপাদানের প্রভাব
গবেষণাপ্রসূত উপাদানগুলো রাজনৈতিক সমাজবিজ্ঞানের উদ্ভব ও বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। গবেষক গবেষণা করতে গিয়ে বিভিন্ন উপাদান সংগ্রহ করে। আর এ সব উপাদান রাজনীতির আলোচনার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে বিবেচিত হয়।
৯। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ইতিবাচক প্রভাব
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ব্যাপক উন্নয়ন ঘটে। এই সময়ে বিভিন্ন রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা তাত্ত্বিক পরিমন্ডলের বাইরে এসে তারা গবেষণা কর্ম, বৈজ্ঞানিক ও অভিজ্ঞতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গির থেকে বাস্তবতার বিষয়ে আলোচনা শুরু করে।আর এ ধরনের আলোচনা রাজনৈতিক সমাজবিজ্ঞানকে সমৃদ্ধ করে তোলে।
১০। মার্কিন সমাজবিজ্ঞানীদের প্রচেষ্টা
রাজনৈতিক সমাজবিজ্ঞানের উদ্ভব ও ক্রমবিকাশে মার্কিন সমাজবিজ্ঞানীদের প্রচেষ্টা ছিলো গুরুত্বপূর্ণ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এশিয়া, আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকার অনেকদেশ স্বাধীন হয়। এসব দেশে নতুন নতুন রাজনৈতিক সংগঠন গড়ে উঠে। সে সব বিষয়ে আলোচনায় মার্কিন বিজ্ঞানীরা আগ্রহী হয়ে উঠে। ফলে তারা নতুন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এসব বিষয়ে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণে আত্মনিয়োগ করেন।
১১। স্বাধীন জাতির আত্মপ্রকাশ
বিভিন্ন দেশ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর স্বাধীন হওয়ার ফলে তাদের নতুন নতুন সমাজকাঠামো গড়ে উঠে।তখন বহু সামাজিক সংগঠন ও রাজনৈতিক সংগঠন প্রভৃতি পরিলক্ষিত হয়। আর এগুলো নিয়ে আলোচনায় নতুন দৃষ্টিভঙ্গির প্রয়োজন হয়।
১২। সমকালীন জনতান্ত্রিক ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা
উনিশ শতকের দ্বিতীয় দশকে বিশেষ করে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরেই বিশ্বব্যাপী গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা নিয়ে অনেক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী সর্তক ছিলেন (বিশেষ করে পশ্চিমা বিজ্ঞানীরা)। যার ফলে রাজনৈতিক ব্যবস্থায় সংস্কারের জন্য প্রগতিমূলক আন্দোলন গড়ে উঠে। এই আন্দোলনের ফলে এক শ্রেণির সমাজবিজ্ঞানীরা সমাজবিজ্ঞানের বিভিন্ন দিক যেমন- এলিট শ্রেণি, সামাজিক সংগঠন, রাজনৈতিক সংগঠন, রাজনৈতিক আচরণ ও সংস্কৃতির প্রতি আকৃষ্ট হন এবং সেগুলো নিয়ে গবেষণা শুরু করেন যা পরবর্তীতে রাজনৈতিক সমাজবিজ্ঞানের বিষয়বস্তু হিসেবে গৃহীত হয়।
১৩। অভিজ্ঞতামূলক গবেষণা
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে অভিজ্ঞতামূলক গবেষণা কর্ম পরিলক্ষিত হয়। সেই সময়ে বিশেষ করে পশ্চিমা তাত্ত্বিকদের মধ্যে অধিকভাবে সাম্যবাদী হওয়ার প্রবণতা পরিলক্ষিত হয়। এই শ্রেণির রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা বিভিন্ন রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন। যা পরে রাজনৈতিক সমাজবিজ্ঞানের মধ্যে অন্তর্ভূক্ত হয়।
১৪। আচরণবাদী রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের অবদান
রাজনৈতিক সমাজবিজ্ঞানের উদ্ভব ও ক্রমবিকাশে আচরণবাদী রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের ভূমিকা বিদ্যমান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে তারা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় আচরণবাদী দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োগ করেন। আর এত তাদের আলোচনার ক্ষেত্র সহজ হয়। ফলে সমাজভিত্তিক আলোচনায় রাজনৈতিক সমাজবিজ্ঞানের ইঙ্গিত দেয়।
১৫। আন্তঃসামাজিক বিজ্ঞানকেন্দ্রিক আলোচনা
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পশ্চিমা চিন্তাবিদগণ সামাজিক বিজ্ঞানকে অধিকতর গ্রহণযোগ্য বিজ্ঞান করার লক্ষ্যে আন্তঃসামাজিক বিজ্ঞানকেন্দ্রিক আলোচনা শুরু করে। এতে সমাজের অনেক বিষয় স্থান পায়।
উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, কোনো বিজ্ঞান বা রাষ্ট্র যেমন একদিনে গড়ে ওঠে না, ঠিক তেমনি রাজনৈতিক সমাজবিজ্ঞানের উদ্ভব ও ক্রমবিকাশও একদিনে সংঘটিত হয়নি। বরং দীর্ঘ সময় ধরে নানা চিন্তাধারা, তত্ত্ব, গবেষণা ও বাস্তব অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক সমাজবিজ্ঞান ধাপে ধাপে তার বর্তমান অবস্থানে পৌঁছেছে। ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে এটি নানা চ্যালেঞ্জ, সীমাবদ্ধতা ও সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছে, কিন্তু সেসব চরাই-উতরাই অতিক্রম করেই আজ রাজনৈতিক সমাজবিজ্ঞান একটি স্বতন্ত্র ও গুরুত্বপূর্ণ শাস্ত্র হিসেবে নিজস্ব অবস্থান প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছে।
সমাজ ও রাষ্ট্রের পরিবর্তিত বাস্তবতা, ক্ষমতা কাঠামো, রাজনৈতিক আচরণ এবং সামাজিক সম্পর্ক বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সমাজবিজ্ঞান ক্রমেই তার প্রয়োজনীয়তা প্রমাণ করে চলেছে। আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থা ও গণতান্ত্রিক চর্চার বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে সময়ের চাহিদা পূরণে এই শাস্ত্রের গুরুত্ব ও গ্রহণযোগ্যতা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে বলা যায়, রাজনৈতিক সমাজবিজ্ঞান শুধু একটি তাত্ত্বিক বিদ্যা নয়, বরং সমকালীন সমাজ ও রাজনীতি বোঝার জন্য একটি অপরিহার্য জ্ঞানশাখা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

No comments:
Post a Comment