সংখ্যালঘু অধিকার সংরক্ষণ আইন ও পার্বত্য শান্তিচুক্তির বৈশিষ্ট্যসমূহ
ভূমিকা: একটি রাষ্ট্রের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান এবং টেকসই উন্নয়নের জন্য সমাজের প্রতিটি স্তরের মানুষের অধিকার ও মর্যাদা রক্ষা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে বাস্তবতায় দেখা যায়, শ্রেণি, বর্ণ, ধর্ম, জাতিসত্তা, ভাষা কিংবা সংস্কৃতি বিভিন্ন ভিন্নতার কারণে কিছু জনগোষ্ঠী প্রান্তিক হয়ে পড়ে এবং তারা নানা ধরনের বৈষম্যের শিকার হয়। এই ধরনের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে সাধারণত সংখ্যালঘু বলা হয়। দেশের অভ্যন্তরে সংখ্যালঘু অধিকার সঠিক প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সংখ্যালঘু অধিকার সংরক্ষণ আইন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
সংখ্যালঘু অধিকার সংরক্ষণ আইন:
এটি এমন একটি আইনি কাঠামো, যার মাধ্যমে সমাজে সংখ্যায় কম বা ক্ষমতায় প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক অধিকার সুরক্ষিত হয়। এটি নিশ্চিত করে যে, রাষ্ট্র সকল জনগণের জন্য সমান অধিকার নিশ্চিত করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, তা সে যেই ধর্ম, বর্ণ, ভাষা বা জাতিসত্তারই হোক না কেন।
এই আইন আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে (যেমন: জাতিসংঘ ঘোষিত সংখ্যালঘু অধিকার বিষয়ক ঘোষণা) ভিত্তি করে গঠিত হয়। এতে জাতিগত বা ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অধিকার যেমন নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি, শিক্ষা ও ধর্মচর্চার স্বাধীনতা, তেমনি রাজনৈতিক অংশগ্রহণ ও বৈষম্যহীন নাগরিক সুবিধা লাভের অধিকার সুনিশ্চিত করা হয়।
এছাড়া, এই আইনের মাধ্যমে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সংঘটিত বৈষম্যমূলক আচরণ, নিপীড়ন কিংবা নিগ্রহ রোধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলা হয়। বিশেষ করে স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে সংখ্যালঘুদের সক্রিয় অংশগ্রহণ ও প্রতিনিধিত্বের নিশ্চয়তা দেওয়াও এ আইনের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক।
একটি বহুসংস্কৃতির রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশেও এই আইনের প্রয়োজনীয়তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যাতে ধর্ম, ভাষা বা সংস্কৃতিগত ভিন্নতার ভিত্তিতে কেউ পিছিয়ে না পড়ে।
পার্বত্য শান্তিচুক্তির বৈশিষ্ট্যসমূহ
পার্বত্য চট্টগ্রামে দীর্ঘদিন ধরে বসবাসরত আদিবাসী এবং নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর সঙ্গে রাষ্ট্রের সম্পর্ক ছিল টানাপড়েনপূর্ণ। দমন, বৈষম্য এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা এই অঞ্চলের জনগণকে বছরের পর বছর ধরে দুর্ভোগে রেখেছিল। এই প্রেক্ষাপটে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর স্বাক্ষরিত পার্বত্য শান্তিচুক্তি ছিল একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। পার্বত্য শান্তিচুক্তির মূল বৈশিষ্ট্যগুলো নিম্নরুপ-
১. এই চুক্তির মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামে অধিষ্ঠানকারী সব উপজাতির এবং নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীগুলোর বিভিন্ন অধিকারকে একধরনের স্বীকৃতি প্রদান করা হয়।
২. এই চুক্তির মাধ্যমে পার্বত্য মানুষের সমস্যাগুলোকে সঠিকভাবে অনুধাবন করার জন্য এবং পার্বত্য অঞ্চলের মানুষের স্বার্থ বিবেচনায় রেখে সমাধানের আশ্বাস দেওয়া হয়।
৩. পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা সমাধানের জন্য পার্বত্য চট্টগ্রামে অবস্থানকারী প্রতিটি নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর সদস্যের সমন্বয়ে আঞ্চলিক পরিষদ গঠন করা হবে এবং আঞ্চলিক পরিষদ পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা সমাধানে ভূমিকা রাখবে। পরিষদে আনুপাতিক হারে বাঙালি সদস্যও অন্তর্ভুক্ত হবেন।
৪. পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশ সরকারের তত্ত্বাবধায়নে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় স্থাপন করা হবে, যাতে সিদ্ধান্তদায়ী এবং নীতিনির্ধারক পর্যায়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিবাসীদের অংশগ্রহণ প্রাধান্য পাবে।
৫. চুক্তিতে উল্লিখিত সময়সীমার মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামভিত্তিক জঙ্গিগোষ্ঠীর সদস্যরা তাদের অস্ত্র সরকারি হেফাজতে সমর্পণের জন্য দায়বদ্ধ থাকবে।
৬. চুক্তির কার্যকর হওয়ার পর পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন অঞ্চলে সরকারের পক্ষ থেকে দায়িত্বগ্রহণ করা হবে এবং বাংলাদেশের সেনাবাহিনী ওই এলাকায় প্রত্যাহার করা হবে।
৭. বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে পার্বত্য মানুষের প্রতিনিধিত্ব বাড়াতে হবে এমনভাবে যাতে প্রতিটি পার্বত্য উপজাতি সঠিকভাবে উপস্থাপিত হতে পারে।
পরিশেষে বলা যায় যে এই শান্তিচুক্তির মাধ্যমে মূলধারার বাঙালি সম্প্রদায় এবং পাহাড়ি জনগণের মধ্যে প্রায় তিন দশক ধরে চলে আসা অশান্তি এবং মত বিরোধের অবসান হয়।

No comments:
Post a Comment