আত্তীকরণ কী? মিল্টন গর্ডন এর আত্তীকরণ তত্ত্ব সম্পর্কে আলোচনা কর

আত্তীকরণ কী? মিল্টন গর্ডন (Milton Gordon) এর আত্তীকরণ তত্ত্ব সম্পর্কে লিখ

ভূমিকা: আধুনিক বিশ্বে বহুসাংস্কৃতিক সমাজ ব্যবস্থা একটি স্বাভাবিক বাস্তবতা। একেকটি সমাজে ভিন্ন ভাষা, ধর্ম, বর্ণ ও সংস্কৃতির মানুষ একত্রে বসবাস করে। এ সকল বহুবিধ গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের মধ্যে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মেলবন্ধনের যে প্রক্রিয়া, সমাজবিজ্ঞানে তাকে বলা হয় আত্তীকরণ। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কোনো সংখ্যালঘু গোষ্ঠী ধীরে ধীরে সংখ্যাগরিষ্ঠ বা প্রভাবশালী গোষ্ঠীর জীবনধারার সাথে মানিয়ে নেয়, তাদের সংস্কৃতিকে গ্রহণ করে, এমনকি এক পর্যায়ে নিজের স্বাতন্ত্র্য হারিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠদের মতো হয়ে ওঠে। অর্থাৎ, যেসব তত্ত্বে কেন, কীভাবে, কোন প্রক্রিয়ায় আত্তীকরণ হয় এবং এর কারণের তত্ত্ব বা Assimilation Theories বলা হয়

আত্তীকরণ কী? মিল্টন গর্ডন এর আত্তীকরণ  তত্ত্ব সম্পর্কে আলোচনা কর

আত্তীকরণ (Assimilation):

আত্তীকরণ সংখ্যালঘু শ্রেণি এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রেণির মাঝে একটি সম্পর্ক।এটি একটি সমাজতাত্ত্বিক প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে একটি সংখ্যালঘু গোষ্ঠী ধীরে ধীরে সংখ্যাগরিষ্ঠ গোষ্ঠীর ভাষা, সংস্কৃতি, আচরণ ও জীবনধারা অবলম্বন করে এবং এক পর্যায়ে নিজস্ব সংস্কৃতি ও পরিচয় হারিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ গোষ্ঠীর সঙ্গে একাত্ম হয়ে যায়। এটি একটি বহুমাত্রিক ও ধাপে ধাপে সম্পন্ন হওয়া প্রক্রিয়া, যেখানে কেবল বাহ্যিক রূপান্তরই ঘটে না, বরং মনের গভীরে, দৃষ্টিভঙ্গিতে, পরিচয়ে এবং সামাজিক কাঠামোয় এক ধরনের রূপান্তর পরিলক্ষিত হয়।


আত্তীকরণ ধরন:

আত্তীকরণ দুইভাবে ঘটে থাকতে পারে: যেমন-

সাংস্কৃতিক আত্তীকরণ (Cultural Assimilation):

ভাষা, পোশাক, ধর্মীয় রীতি, খাদ্যাভ্যাস ইত্যাদি গ্রহণ।

নৃগোষ্ঠীগত বা সামাজিক আত্তীকরণ (Structural/Ethnic Assimilation):

সামাজিক প্রতিষ্ঠান, বিয়ে, পেশা ও নাগরিক জীবনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে সংখ্যাগরিষ্ঠদের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন।


কোনো কোনো ক্ষেত্রে আত্তীকরণ এমনভাবে ঘটে যে, সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর অস্তিত্ব আলাদা করে বোঝার আর উপায় থাকে না। তারা সংখ্যাগরিষ্ঠদের মতো হয়ে ওঠে, এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ সমাজ তাদের অবলীলায় নিজেদের অংশ হিসেবে মেনে নেয়।


মিল্টন গর্ডনের (Milton Gordon) আত্তীকরণ তত্ত্ব

আত্তীকরণ প্রক্রিয়া কীভাবে সংঘটিত হয়, কোন কোন ধাপে এটি এগোয়, তা বিশ্লেষণ করার ক্ষেত্রে মার্কিন সমাজবিজ্ঞানী মিল্টন গর্ডন (Milton M. Gordon) একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নাম।

তিনি ১৯৬৪ সালে প্রকাশিত তার প্রভাবশালী গ্রন্থ “Assimilation in American Life”-এ আত্তীকরণের একটি সাত ধাপবিশিষ্ট মডেল উপস্থাপন করেন, যা আধুনিক সমাজবিজ্ঞানে বহুল আলোচিত ও ব্যবহৃত।

গর্ডনের মতে, একটি সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী সংখ্যাগরিষ্ঠ সমাজে অন্তর্ভুক্ত হতে হলে তাকে সাংস্কৃতিক, সামাজিক, পারিবারিক, মানসিক ও নাগরিক এই সব স্তরে নিজেকে রূপান্তরিত করতে হয়। এই রূপান্তর একটি নির্দিষ্ট ক্রমে ঘটে থাকে।

গর্ডনের আত্তীকরণের সাতটি ধাপ:

১. সংস্কৃতায়ন (Cultural Assimilation):

প্রথম ধাপে সংখ্যালঘু গোষ্ঠী সংখ্যাগরিষ্ঠদের ভাষা, খাদ্যাভ্যাস, পোশাক, রীতিনীতি, ধর্মীয় আচার ইত্যাদি গ্রহণ করে। এটি বাহ্যিকভাবে সংস্কৃতি অনুসরণের পর্যায়।

২. কাঠামোগত আত্তীকরণ (Structural Assimilation):

এই ধাপে সংখ্যালঘু গোষ্ঠী সংখ্যাগরিষ্ঠদের শিক্ষা, চাকরি, সংগঠন, বিনোদন কেন্দ্র ইত্যাদিতে অংশগ্রহণ করতে শুরু করে। ফলে সামাজিকভাবে দুটি গোষ্ঠীর মধ্যে ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়।

৩. বৈবাহিক আত্তীকরণ (Marital Assimilation):

এখানে আন্তঃবিবাহের মাধ্যমে দুটি গোষ্ঠীর পারিবারিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়, যা সামাজিকভাবে অত্যন্ত গভীর মিশ্রণের প্রতীক।

৪. পরিচিতিমূলক আত্তীকরণ (Identificational Assimilation):

এই ধাপে সংখ্যালঘুরা নিজেদেরকে সংখ্যাগরিষ্ঠ গোষ্ঠীর সদস্য হিসেবে মানসিকভাবে গ্রহণ করে এবং পূর্ব পরিচয় বিস্মৃত হতে শুরু করে।

৫. দৃষ্টিভঙ্গিগত আত্তীকরণ (Attitude-Receptional Assimilation): 

সংখ্যাগরিষ্ঠ সমাজ সংখ্যালঘুদেরকে বৈষম্যহীন দৃষ্টিতে দেখতে শুরু করে। পারস্পরিক সম্মান ও গ্রহণযোগ্যতা সৃষ্টি হয়।

৬. আচরণগত আত্তীকরণ (Behavioral-Receptional Assimilation):

দুই গোষ্ঠীর মধ্যে সামাজিক সংঘর্ষ, বিদ্বেষ ও শত্রুতা কমে যায় এবং শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নিশ্চিত হয়।

৭. প্রাতিষ্ঠানিক বা নাগরিক আত্তীকরণ (Civic Assimilation):

সবশেষে সংখ্যালঘু গোষ্ঠী রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে, আইন ও নাগরিক অধিকার প্রয়োগে সমান অংশগ্রহণ লাভ করে। তারা তখন পূর্ণাঙ্গভাবে নতুন সমাজ ও রাষ্ট্রের সদস্য হয়ে ওঠে।


গুরুত্বপূর্ণ প্রত্যয়:

মিল্টন গর্ডন তার তত্ত্বে দুটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণা উপস্থাপন করেন:

Anglo-Conformity: এখানে সংখ্যালঘুরা সংখ্যাগরিষ্ঠদের সংস্কৃতিতে সম্পূর্ণভাবে মিশে গিয়ে নিজেদের স্বাতন্ত্র্য হারায়। নতুন সংস্কৃতি গ্রহণের পরিবর্তে পূর্ব সংস্কৃতি বিসর্জন দেয়।

Melting Potবিভিন্ন গোষ্ঠীর বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতিগুলো একত্রে মিশে গিয়ে একটি নতুন, সম্মিলিত সংস্কৃতি গড়ে তোলে। এখানে সকলের সংস্কৃতি সমভাবে গলিত হয়ে একটি নতুন রূপ ধারণ করে।


উপসংহার: আত্তীকরণ একটি বহুমাত্রিক, ধাপে ধাপে সম্পন্ন হওয়া সামাজিক প্রক্রিয়া, যা কেবল বাহ্যিক আচরণগত পরিবর্তনে সীমাবদ্ধ নয়, বরং মানসিকতা, দৃষ্টিভঙ্গি ও নাগরিক অংশগ্রহণের গভীর স্তর পর্যন্ত বিস্তৃত। মিল্টন গর্ডনের তত্ত্ব এই প্রক্রিয়াকে যুক্তিসঙ্গত ও পর্যায়ক্রমিক বিশ্লেষণে রূপ দিয়েছে। তাঁর সাত ধাপ বিশিষ্ট মডেল আধুনিক বহুজাতিক সমাজে আত্তীকরণ বোঝার একটি কার্যকর কাঠামো প্রদান করে।

বর্তমানে অভিবাসন, বিশ্বায়ন ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের যুগে এই তত্ত্বের প্রাসঙ্গিকতা অনস্বীকার্য।

No comments:

Post a Comment