সাংস্কৃতিক বহুত্ববাদ কী? সাংস্কৃতিক বহুত্ববাদের বৈশিষ্ট্যসমূহ আলোচনা কর

সাংস্কৃতিক বহুত্ববাদ কী? সাংস্কৃতিক বহুত্ববাদের বৈশিষ্ট্যসমূহ আলোচনা

ভূমিকা: "সাংস্কৃতিক বহুত্ববাদ" ধারণাটির সূচনা ১৯১৫ সালে Horace Kallen-এর লেখায় পাওয়া যায়। এজন্য অনেক সময় তাকেই এই প্রত্যয়ের জনক বলা হয়। তার "Nation Democracy Versus Melting Pot" গ্রন্থে তিনি ইউরোপীয় অভিবাসীদের জোরপূর্বক "আমেরিকানাইজেশন"-এর বিরোধিতা করেন এবং এর পরিবর্তে বিভিন্ন সংস্কৃতির স্বতন্ত্র অস্তিত্ব বজায় রাখার পক্ষে মত দেন। পরবর্তীতে তিনি ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক বহুত্ববাদের ধারণাকেও তার লেখায় স্থান দেন।
সাংস্কৃতিক বহুত্ববাদ কী? সাংস্কৃতিক বহুত্ববাদের বৈশিষ্ট্যসমূহ


সাংস্কৃতিক বহুত্ববাদ:

সাংস্কৃতিক বহুত্ববাদ বলতে একই সঙ্গে একটি পরিস্থিতি ও একটি বিশ্বাস বোঝানো হয়। পরিস্থিতি হিসেবে এটি এমন এক সমাজব্যবস্থাকে নির্দেশ করে যেখানে বিভিন্ন জাতি, ধর্ম, সংস্কৃতি ও ভাষার মানুষ নিজ নিজ স্বকীয়তা বজায় রেখে, আইনের শাসন মেনে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান করে। বিশ্বাস হিসেবে সাংস্কৃতিক বহুত্ববাদ হল সেই ধারণা, যা বলে যে সকল সংস্কৃতি, ধর্ম ও জাতিগোষ্ঠী সমভাবে মূল্যবান এবং তাদের পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও সহানুভূতির ভিত্তিতে সমাজে সহাবস্থান করা উচিত।

১৯শ শতকের মাঝামাঝি সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এই ধারার উন্মেষ ঘটে। Horace Kallen, Alain Locke, এবং Randolph Bourne প্রমুখ চিন্তাবিদ এই ধারণার বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। এ দর্শনে মূলধারার পাশাপাশি ছোট ছোট সংস্কৃতির স্বীকৃতিও গুরুত্ব পায়।

সাংস্কৃতিক বহুত্ববাদের বৈশিষ্ট্যসমূহ


১. সমমর্যাদার ভিত্তিতে গোষ্ঠীগুলোর মূল্যায়ন:

এখানে সংখ্যাগুরু ও সংখ্যালঘুর ভিত্তিতে ভেদাভেদ করা হয় না। প্রতিটি গোষ্ঠী তাদের নিজস্ব সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে সমমর্যাদায় অবস্থান করে। যেমন- বাংলা ভাষাভাষী বাঙালি ও চাকমা উভয়েই সমানভাবে সংস্কৃতিবান।


২. পারস্পরিক বিরোধ সত্ত্বেও সহাবস্থান:

বিভিন্ন গোষ্ঠীর মাঝে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক বা সাংস্কৃতিক বিরোধ থাকলেও তারা একটি রাষ্ট্রের অধীনে অধিকার ও সুযোগের ভিত্তিতে সহাবস্থান করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, কাপ্তাই বাঁধ প্রকল্প বাঙালিদের জন্য বিদ্যুৎ উৎপাদন করলেও তা পাহাড়িদের বাস্তুচ্যুত করে। সাংস্কৃতিক বহুত্ববাদে এ ধরনের পক্ষপাত এড়িয়ে সবার স্বার্থ রক্ষা করা জরুরি।

৩. রাষ্ট্রীয় আচরণে সীমাবদ্ধতা:

নৈতিকভাবে বহুত্ববাদ সমর্থন করলেও, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থে অনেক সময় রাষ্ট্র তা কার্যক্ষেত্রে পালন করতে ব্যর্থ হয়। রাষ্ট্রযন্ত্রে প্রান্তিক গোষ্ঠীর অংশগ্রহণ এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

৪. সংস্কৃতির স্বকীয়তা রক্ষা:

আত্তীকরণের চেয়ে সাংস্কৃতিক বহুত্ববাদ প্রতিটি সংস্কৃতিকে টিকিয়ে রাখার ওপর গুরুত্ব দেয়। একটি সংস্কৃতি অন্যটির মধ্যে বিলীন না হয়ে নিজস্বতা বজায় রাখে।

৫. স্বাজাত্যকেন্দ্রিকতা পরিহার:

সাংস্কৃতিক বহুত্ববাদের সফল বাস্তবায়নে প্রতিটি গোষ্ঠীকে "আমার সংস্কৃতি শ্রেষ্ঠ" এই মানসিকতা ত্যাগ করতে হয়। এই ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি বহুত্ববাদের অন্তরায়।

৬. রাষ্ট্রীয় ভূমিকা বাস্তবতা অনুযায়ী:

রাষ্ট্র অনেক সময় ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে চাইলেও বাস্তবতা, রাজনৈতিক চাপ বা শক্তির ভারসাম্যের কারণে তা করতে পারে না। সাংস্কৃতিক বহুত্ববাদ এ বিষয়টি স্বীকার করে নেয়।

৭. একক রাষ্ট্রভাষা বা ধর্ম নয়:

একটি মাত্র রাষ্ট্রভাষা বা রাষ্ট্রধর্ম বহুত্ববাদের পরিপন্থী। বহুভাষিক ও বহুধর্মীয় সমাজে প্রতিটি ভাষা ও ধর্মের স্বাধীন চর্চা এবং রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি থাকা প্রয়োজন।

৮. একক পরিচয়ে সকলকে ঢেকে ফেলা উচিত নয়:

একটি গোষ্ঠীর অভ্যন্তরে বহু ভিন্ন ভিন্ন উপ-গোষ্ঠী থাকতে পারে। যেমন, "আদিবাসী" শব্দটি দিয়ে সকল উপজাতি গোষ্ঠীকে একই ছাঁদে ফেলা উচিত নয়। প্রত্যেকটির নিজস্ব সংস্কৃতির স্বীকৃতি দিতে হবে।

৯. শিক্ষাব্যবস্থায় ভাষাগত অন্তর্ভুক্তি:

বহুভাষিক সমাজে বিভিন্ন ভাষাগোষ্ঠীর শিশুদের মাতৃভাষায় শিক্ষার সুযোগ থাকা উচিত। এ জন্য আলাদা পাঠ্যক্রম, বই এবং শিক্ষক প্রয়োজন হয়।

১০. আন্তঃগোষ্ঠীগত কলহ ও রাষ্ট্রীয় ভারসাম্য:

বিভিন্ন গোষ্ঠীর নিজ নিজ স্বার্থ থাকা স্বাভাবিক। তবে তা সংঘাতে না গড়িয়ে রাষ্ট্রের উচিত সবার স্বার্থ রক্ষা করে একটি সহনশীল জাতি গঠন করা। উদাহরণস্বরূপ, আফ্রিকার হুতু ও তুতসি উপজাতির বিরোধ বহু বছর ধরে গৃহযুদ্ধ সৃষ্টি করেছে।

উপসংহার: সাংস্কৃতিক বহুত্ববাদ এমন একটি সামাজিক-রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা, যেখানে বিভিন্ন ভাষা, ধর্ম, জাতি ও সংস্কৃতির মানুষ তাদের নিজস্ব ঐতিহ্য ও স্বকীয়তা বজায় রেখে রাষ্ট্রীয় আইন মেনে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান করে। এই ধারণা সমাজে ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা, পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও সহনশীলতার ভিত্তি গড়ে তোলে। সাংস্কৃতিক বহুত্ববাদের সফল প্রয়োগ একটি জাতিকে করে তোলে আরও মানবিক, সহনশীল ও সাম্যের ভিত্তিতে গঠিত।

No comments:

Post a Comment