সংস্কৃতায়ন এবং আত্তীকরণ প্রক্রিয়ার মধ্যে পার্থক্য লিখ

সংস্কৃতায়ন (Acculturation) এবং আত্তীকরণ (Assimilation) প্রক্রিয়ার মধ্যে পার্থক্য

ভূমিকা: মানব সমাজ চিরকালই পরিবর্তনশীল। এই পরিবর্তনের ধারায় সংস্কৃতি একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। সমাজের মানুষ যখন একে অপরের সংস্পর্শে আসে, তখন তাদের মধ্যে সাংস্কৃতিক আদান-প্রদান ঘটে। বিভিন্ন সংস্কৃতির মেলবন্ধনের ফলে কিছু রীতিনীতি, বিশ্বাস, অভ্যাস ও জীবনাচারের পরিবর্তন হয়।

সংস্কৃতায়ন এবং আত্তীকরণ প্রক্রিয়ার মধ্যে পার্থক্য লিখ


এই পরিবর্তনের দুটি প্রধান প্রক্রিয়া হলো সংস্কৃতায়ন (Acculturation) এবং আত্তীকরণ (Assimilation)। যদিও এ দুটি প্রক্রিয়াই সংস্কৃতির পরিবর্তনের সাথে জড়িত, তথাপি এগুলোর প্রক্রিয়া, প্রকৃতি ও পরিণতি ভিন্ন। এক্ষেত্রে একটির মাধ্যমে একটি সংস্কৃতি অন্য সংস্কৃতির কিছু উপাদান গ্রহণ করে, অপরটিতে একটি সংস্কৃতি পুরোপুরি অন্য সংস্কৃতির মধ্যে বিলীন হয়ে যায়।

সংস্কৃতায়ন (Acculturation) এবং আত্তীকরণ (Assimilation)  প্রক্রিয়ার পার্থক্য

নিম্নে আত্তীকরণ এবং সংস্কৃতায়ন প্রক্রিয়ার মধ্যে পার্থক্যসমূহ নিম্নে উল্লেখ করা হলো-

১. সংজ্ঞাগত পার্থক্য:

যে প্রক্রিয়ায় একটি সংস্কৃতির সম্পর্শে অন্য সংস্কৃতিটি ক্রমশ পরিবর্তিত হয়, তাকে সংস্কৃতায়ন বলে। যে প্রক্রিয়ায় একটি সংস্কৃতির প্রভাবে অন্য একটি সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্য সম্পূর্ণরূপে হারিয়ে গিয়ে মূলধারার সংস্কৃতিতে আত্তীকৃত হয়, তাকে আত্তীকরণ বলে।

২. প্রক্রিয়া ধারা:

সংস্কৃতায়ন একটি দ্বিমুখী প্রক্রিয়া। দুটি সংস্কৃতিই পরস্পরকে প্রভাবিত করে এবং একে অন্যের প্রভাবে পরিবর্তন হয়। আত্তীকরণ সম্পূর্ণ একমুখী একটি প্রক্রিয়া, এখানে শক্তিশালী সংস্কৃতিটি দুর্বল সংস্কৃতির কোনো বৈশিষ্ট্যই গ্রহণ করে না।কিন্তু দুর্বল সংস্কৃতিটি শক্তিশালী সংস্কৃতি গ্রহণ করতে চায়।

৩. সময়কাল:

সংস্কৃতায়ন একটি সার্বক্ষণিক প্রক্রিয়া। সংস্কৃতায়নের ফলাফল এক মাস, দুই মাস ইত্যাদি সময়ের প্রেক্ষিতে পাওয়া সম্ভব বা বোঝা সম্ভব। কোন সংস্কৃতিটি প্রকৃতভাবে কতটুকু আত্তীকৃত হয়েছে তা বুঝতে হলে এক বা একাধিক প্রজন্ম পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়, এর আগে আত্তীকরণের বৈশিষ্ট্য বোঝা সম্ভব নয়।

৪. সাংস্কৃতিক পরিচয়ে রুপান্তর:

সংস্কৃতায়ন এর ক্ষেত্রে কোনোভাবেই কোনো সংস্কৃতি তা নিজস্ব সাংস্কৃতিক পরিচয় পরিবর্তন করতে চায় না। আত্তীকরণ এর ক্ষেত্রে দুর্বল সংস্কৃতির মানুষরা নিজেদের সংস্কৃতিক পরিচয় পরিবর্তন করে সবল সাংস্কৃতির পরিচয়ে পরিচিত হতে আপ্রাণ চেষ্টা করে।

৫. সচেতনতা ও আগ্রহ:

সংস্কৃতায়নে দাতা এবং গ্রহীতা উভয় সংস্কৃতিয় সদস্যরা এই প্রক্রিয়া সম্পর্কে খুব সচেতন থাকতে পারে না। অথবা সারা সংস্কৃতির আগ্রাহ্য বা গ্রহীতা সংস্কৃতির আগ্রহ এখানে বিবেচ্য নয়।  আত্তীকরণ এর ক্ষেত্রে গ্রহীতা সংস্কৃতিটির অধিক আগ্রহ থাকে বৈশিষ্ট্যগুলোকে নিজের মধ্যে নেবার জন্য। কখনো কখনো দাতা বা সংস্কৃতি তাকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করতে পারে বা তার এই গ্রহণ প্রক্রিয়াকে অপনীতও করতে পারে।

৬. সামাজিক গতিশীলতা:

সংস্কৃতায়ন কোনো সংস্কৃতির জন্যই কোনো ধরনের গতিশীলতা হিসেবে বিবেচিত হয় না, বরং ক্ষেত্রবিশেষ অন্য সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্য নিজের মধ্যে ধারণ করা গ্রহীতা সংস্কৃতির জন্য নিম্নমুখী গতিশীলতা বিবেচিত হয়।আত্তীকরণ প্রান্তিক সংস্কৃতির জন্যই অবশ্যই উর্ধমুখী গতিশীলতা হিসেবে বিবেচিত হয়। যদিও মূলধারার সংখ্যাগুরু সংস্কৃতির পর থেকে এই প্রকার আত্তীকরণ কখনো কোনো প্রকার আত্তীকরণ যখন ওই কোনো প্রকার গতিশীলতা হিসেবে বিবেচিত হয় না।

৭. উদ্দেশ্য:

সংস্কৃতায়ন প্রক্রিয়ার পরিবর্তনের মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের ক্ষুদ্র বা বৃহৎ ব্যবসায়িক স্বার্থ শুধু রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিল করার চেষ্টা করা হয়। আত্তীকরণ পরিবর্তনের মাধ্যমে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষা করে টিকে থাকার প্রয়াস পায় বৃহৎ ও মূলধারার সংস্কৃতির সাপেক্ষে প্রয়াস।

৮. শক্তিশালী সংস্কৃতির প্রয়োজনীয়তা:

সংস্কৃতায়ন প্রক্রিয়া একটি সচল, একটি দুর্বল সংস্কৃতি, একাধিক দুর্বল সংস্কৃতি অথবা একাধিক সবল সংস্কৃতির মধ্যে ঘটতে পারে। যদি একটি সংস্কৃতি সবল না হয় তাহলেও সংস্কৃতায়ন ঘটতে পারে এদের মধ্যে।আত্তীকরণ এর ক্ষেত্রে একটি সংস্কৃতির উপস্থিতি অবশ্যই থাকতে হবে দুর্বল সংস্কৃতির সাথে, দুর্বল সংস্কৃতির আত্তীকরণ কোনোভাবে ঘটে না।

৯. গতি:

সংস্কৃতায়ন প্রক্রিয়া কখনো কখনো খুব দ্রুতগতিতে ঘটে। যেমন-তথ্যপ্রযুক্তির বিকাশের ফলে সহজেই সংস্থায়ন প্রক্রিয়া পৃথিবীর বিভিন্ন সংস্কৃতির মধ্যে ঘটেছে।  আত্তীকরণ এ প্রক্রিয়া কার্যকরণগতভাবেই অত্যান্ত ধীর এবং প্রায় ঘটে না।

১০. প্রযুক্তির ভূমিকা:

তথ্যপ্রযুক্তির বিকাশের ফলে সংস্কৃতায়ন আরও বেশি সহজ সুলভ এবং সরল আকারে ধারণ করতে পারে। তথ্যপ্রযুক্তির বিকাশে এই প্রক্রিয়া কোনো প্রকার প্রভাবিত হয় না।


উপসংহার: পরিশেষে বলা যায়, সংস্কৃতায়ন ও আত্তীকরণ দুটি ভিন্নতর সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের প্রক্রিয়া। সংস্কৃতায়ন যেখানে সংস্কৃতির বৈচিত্র্যকে রক্ষা করে, আত্তীকরণ সেখানে এক ধরনের একরূপতা তৈরি করে। যদিও অনেক ক্ষেত্রেই এই দুটি প্রক্রিয়ার পার্থক্য স্পষ্টভাবে চিহ্নিত করা কঠিন, তবুও সমাজবিজ্ঞান ও নৃতত্ত্বের আলোকে উপর্যুক্ত বিশ্লেষণে এদের মৌলিক বিভেদ অনুধাবন করা সম্ভব। সমাজের সুস্থ সাংস্কৃতিক বিকাশের জন্য উভয় প্রক্রিয়ার সচেতন ও যথাযথ ব্যবহারের প্রয়োজন রয়েছে।

No comments:

Post a Comment