বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী সংখ্যালঘুদের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কিত বিশ্লেষণ

বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী সংখ্যালঘুদের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে বিশ্লেষণ 

ভূমিকা: বাংলাদেশের সংবিধান দেশের সকল নাগরিকের জন্য মৌলিক অধিকার ও সমতা সুরক্ষিত রাখার জন্য দায়বদ্ধ। এর মধ্যে দেশের ধর্ম, জাতি, সংস্কৃতি, ভাষা, এবং অন্যান্য পরিচয়ের ভিত্তিতে বিভক্ত বিভিন্ন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ও অন্তর্ভুক্ত। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন ধর্মভিত্তিক, জাতিভিত্তিক, ভাষাভিত্তিক সংখ্যালঘু শ্রেণি বসবাস করছে, বাংলাদেশ রাষ্ট্র হিসেবে উত্থান এবং স্বাধীনতা পূর্ব থেকেই।

বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী সংখ্যালঘুদের বৈশিষ্ট্য

এসব সংখ্যালঘু শ্রেণির অনেকগুলোই এখানে প্রজন্মান্তরে বসবাস করছে। অর্থাৎ জন্মসূত্রে বা বসবাসসূত্রে এরা সকলেই বাংলাদেশ রাষ্ট্রের নাগরিকত্বের দাবিদার। বাংলাদেশের সংবিধানে সকল আনাগরিকদের সাধারণ অধিকারের সাথে সংখ্যালঘুদের অধিকারকেও স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে।


বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী সংখ্যালঘুদের বৈশিষ্ট্য:

সংখ্যালঘু বিষয়ে সরাসরি কোনো আলোচনা না থাকলেও প্রছন্ন এবং অপ্রত্যক্ষভাবে বিভিন্ন সংবিধানের অধ্যাদেশে যেসব দৃষ্টিভঙ্গিগত বৈশিষ্ট্য দেখা যায় সেগুলো হলো-

১. সংখ্যালঘুদের বিষয়ে স্পষ্ট নির্দেশনা না থাকা: বিভিন্ন আন্তঃর্জাতিক পর্যায়ে এবং জাতীয় পর্যায়ে বেসরকারি বিভিন্ন সমীক্ষাতে বাংলাদেশ নামক ভূখন্ডের অধীনে বিভিন্ন স্বকীয় বৈশিষ্ট্যধারী জনগণের আবাস। এদের অনেকে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন অধ্যাদেশ অনুযায়ী সংখ্যালঘু হিসেবে বিবেচিত হবার যোগ্য কিন্তু বাংলাদেশের সংবিধানে সরাসরি "সংখ্যালঘু" শব্দটির ব্যবহার নেই। এর মানে এই যে, সংবিধানে সংখ্যালঘুদের জন্য কোনো বিশেষ বিধান বা স্বীকৃতি নেই। আন্তর্জাতিক অধ্যাদেশ অনুযায়ী এরা সংখ্যালঘু হিসেবে বিবেচিত হবে। বিভিন্ন মূলধারায় ধর্মের বিভিন্ন ছোট ছোট ঘরে এবং ভিন মিশন গুলোও আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী সংখ্যালঘু হিসেবে বিবেচিত হবার সব ধরনের সাধারণ বৈশিষ্ট্য ধারণ করলেও সংবিধান অনুযায়ী তাদের সংখ্যালঘু হিসেবে কোনোরকম স্বীকৃতি দেওয়া হয় নি।


২. আন্তর্জাতিক চুক্তির প্রতিফলন নেই: বাংলাদেশ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক চুক্তি যেমন রোম চুক্তি, জাতিসংঘের সংখ্যালঘু সুরক্ষা নীতি, ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক প্রটোকল মেনে চলার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তবে, এসব চুক্তির কোনো প্রতিফলন বাংলাদেশের সংবিধানে দেখা যায় না। আন্তর্জাতিক চুক্তিগুলির আলোকে দেশকে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সুরক্ষার জন্য বিধি তৈরি করতে হবে, কিন্তু বাংলাদেশের সংবিধানে এ ধরনের কোনো স্পষ্ট আইনি বিধান নেই। বাংলাদেশ কখনোই সংখ্যালঘুদের জন্য আলাদা সুবিধা বা সুরক্ষা নিয়ম প্রবর্তন করেনি, ফলে এসব সম্প্রদায়ের জন্য অধিকারের বাস্তবায়ন ও সুরক্ষা অনেকাংশে দুর্বল হয়ে পড়ে।


৩. ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বিষয়ে অস্পষ্টতা: বাংলাদেশের সংবিধান ধর্মীয় স্বাধীনতা ও সমমর্যাদা নিশ্চিতে দাবি রেখেছে। বাংলাদেশের সংবিধানের সুস্পষ্টভাবে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইমসলামকে ঘোষণা করে তার পাশাপাশি অন্য বিভিন্ন ধর্মকে সমমর্যাদায় পালনের কথা বলা হয়েছে। এই বিষয়টি সম্পূর্ণরূপে রাষ্ট্রের নিজস্ব এক ধরনের দ্বিধাকে প্রকাশ করে। যখন রাষ্ট্রধর্ম বলে একটি ধর্মকে ঘোষণা করা হয় তখন সেই ধর্মটিকে স্বাভাবিকভাবেই অন্যান্য ধর্ম হতে এক ধরনের উচ্চতার অবস্থানে রাখা হয়। তাহলে কীভাবে অন্যান্য ধর্মকে একই কাতারে রাখা সম্ভব, তা সংবিধান অনুসারে স্পষ্ট নয়। আবার সকল ধর্মের মানুষ সমানভাবে নিজ ধর্ম পালন যাতে করতে পারে সে বিষয়ে জোর দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সংখ্যালঘুর গুরুত্ব ক্ষমতাবান রাষ্ট্রধর্ম অনুসারী ব্যক্তিদের অভ্যন্তরে নিজ ধর্ম অনুষ্ঠানে কেনো ধরনের বৈষম্য ছাড়াই এবং কোনো ধরনের বিশেষ সুবিধা ছাড়া কীভাবে সম্ভব, তা স্পষ্ট নয়। আবার সংখ্যালঘুদের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান বা সাংস্কৃতিক স্থানগুলোর উপর আক্রমণ এবং ক্ষতিসাধন ঘটলেও, সংবিধানে এর প্রতিকার বা সুরক্ষা ব্যবস্থা স্পষ্ট নয়। তাই বাস্তবতায় ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের সুরক্ষা যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হয় না।

৪.উপজাতি গোষ্ঠী বা আদিবাসীদের সরলীকৃত উপস্থাপনা: বাংলাদেশের সংবিধানে ২৩(ক) ধারায় উপজাতি বা আদিবাসী গোষ্ঠীর সম্পর্কে অল্প কথায় উল্লেখ রয়েছে, যেখানে তাদের "বাঙালি সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন" হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।  প্রশ্ন হলো এই ধরনের বৈচিত্রোর উল্লেখ করে আসলে কি বোঝানো হয়েছে তা স্পষ্ট নয় এবং তবে, এই সংজ্ঞাটি অত্যন্ত সরলীকৃত এবং গুচ্ছিত। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিভিন্ন স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে উপজাতিদের আন্তঃকলহ ও দ্বন্দ্ব ক্রিয়াশীল থাকতে পারে। এসব বিভিন্ন কারণে উপজাতি উপজাতিতে ভিন্নতা একটি বিদ্যমান বাস্তবতা। কোনোভাবে উপজাতি হলে একটি সরলীকরণ করা সম্ভব নয়। দারিদ্র এবং অর্থনৈতিক বিচারে কারো অবস্থা ওপরে কারো অবস্থান নিয়ে। তাই সরকারি সহযোগিতায় চাহিদার প্রেক্ষাপট ও মাত্রাগত ভিন্নতাও রয়েছে কিন্তু সংবিধানে সব ধরনের ভিন্নতাকে অসম্পূর্ণ রেখে তাদের একটি সরলীকৃত উপস্থাপনা করা হয়েছে, যা কোনোভাবে এদের জীবনমানের প্রকৃতি ও বিদ্যমান বাস্তবতা যোভাতে অনুকূল নয়।


৫. সংখ্যালঘুদের জন্য নির্দিষ্ট পরিচ্ছেদ বা অংশ নির্ধারিত না থাকা: বাংলাদেশের সংবিধানে সংখ্যালঘুদের জন্য কোনো বিশেষ পরিচ্ছেদ বা অংশ নেই।  পৃথিবীর সব দেশের সংবিধানেই বন্ধু প্রকার অংশ নির্ধারিত থাকে। এমনকি আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের সংখ্যালঘুদের বিষয়ে ভারতীয় সংবিধানের ১০২নং পরিচ্ছেদ এর বিশদ আলোচনা রয়েছে ২৩(ক) ধারায় উপজাতীয়দের বিষয়ে কিছু উল্লেখ থাকলেও, তা কার্যত একটি সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে লেখা হয়েছে, যা পুরোপুরি বাস্তবতার প্রতিফলন নয়।


৬. সংখ্যালঘুদের নাগরিকত্বের সরলীকৃত উপস্থাপনা: বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে সংবিধান প্রদত্ত অধিকারসমূহ  দাবি ও ভোগ করার যোগ্যতা অর্জন করবেন তা নাগরিক এ আইন দ্বারা নির্ধারিত হবে। বাংলাদেশের নাগরিকত্ব আইন অনুযায়ী নাগরিকত্বের জন্য কয়েকটি মৌলিক শর্ত রয়েছে, যেমন 

(i) জন্মসূত্রে, (ii) বসবাসসূত্রে, (iii) স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণের ভিত্তিতে (iv) প্রজন্মগত সূত্রে এবং (v.) বৈবাহিক সূত্রে।

এসব প্রক্রিয়াগুলোর অনেকগুলো বাংলাদেশের ত্বখণ্ডে বসবাসরত অনেক ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় সেক্ষেত্রে তারা বাংলাদেশের নাগরিক হবার যোগ্যতা রাখে কি না বা বাখেলেও কোন কোন শর্তসাপেক্ষ তা কার্যকর হবে বা কোনো একটি শর্ত পূরণ হলে অন্যগুলো যদি পূরণ না হয় সেক্ষেত্রেই বা কী করণীয় তা এই আইনে স্পষ্ট নয়।


৭. সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জীবনমান উন্নয়নে নির্দেশনা না থাকা: বাংলাদেশে বেশিরভাগ সংখ্যালঘু সম্প্রদায় অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল এবং সামাজিকভাবে প্রান্তিক অবস্থানে রয়েছে। তাদের জীবনের মৌলিক চাহিদা যেমন খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান এবং স্বাস্থ্য সেবা পূরণের জন্য কোনো কার্যকর পদক্ষেপ সংবিধানে নেই। এর ফলে তারা সমাজে প্রতিষ্ঠিত প্রধানধারার জনগণের তুলনায় অধিকভাবে অবহেলিত থাকে। তাই এসব সংখ্যালঘুদের জীবনমান উন্নয়নের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে প্রণীত হওয়া দরকার ছিল, যাতে রাষ্ট্রের তত্ত্বাবধানে তারা জীবনের ন্যূনতম মানটি অর্জন করার পরই সংখ্যাগুরু সমাজের মানুষদের সমকক্ষ ও সমরূপ হিসেবে সমাজে বিবেচিত হতে পারে। তারপর তারা একইভাবে বিথির অধিকার অর্জনের বাস্তবতার সংবিধানের বিবেচিত হতে পারত।


৮. সংখ্যালঘু নারী ও শিশু সম্পর্কে কোন ধরনের বিষয় নির্দেশনা দেওয়া হয় সংবিধানে: নারী ও শিশুকে প্রতিটি রাষ্ট্রদ সংবিধানে আলাদা গুরুত্বের জায়গায় রাখা হয় এবং সংবিধানে তাদের প্রতিরক্ষা এবং তাদের অধিকার সংরক্ষনে বিশে অধ্যায়বিশিষ্ট অংশ নির্ধারিত থাকে। কারণ নারী এবং শিশু আন্তর্জাতিক কল্যাণমূলক অর্থনীতির আলোচনায় সমাজ Vulnerable অংশ হিসেবে স্বীকৃত। অর্থাৎ, প্রায় আড়ি Vulnerable হিসেবে রাষ্ট্রে গুরুত্ব পাওয়ার দাবি রাখে। তাদে প্রশাসন আইন এবং অন্যান্য কাঠামোগত রাষ্ট্রীয় যন্ত্রসমূহ য সংবিধানের আলোকে সক্রিয় থাকে সেখানে নারী এবং শিশুদে অধিকার সংরক্ষণের এরকম কোনো নির্দেশনা সংবিধানে বা থাকায় এসব প্রতিষ্ঠানগুলোতে সংখ্যালঘু শ্রেণির নারী ও শিশুদে রক্ষার জন্য কোনো দায়বদ্ধতা অনেক সময়ে অনুভব করে না। ফলে এই সম্প্রদায়গুলোর বা সংখ্যালঘু শিশু খুব সহজে রাষ্ট্রন দমন নিপীড়ন শিকার হয় এবং এই অত্যাচারের প্রতিকার চাওয়ায় মতো অধিকারের অগ্রাধিকার পূর্ণ বৈধতা সংবিধানে রাখা হয়নি।


৯. সংখ্যালঘুদের ভূসম্পত্তি ও অন্যান্য সম্পত্তি সংরক্ষণ বিষয়ে নির্দেশনা না থাকা: সমাজের দুর্বলতার অংশ হওয়ায় আন্তর্জাতিক বিভিন্ন আইন তাদের মালিকানাধীন ভূমি এবা অন্যান্য সম্পত্তি রক্ষার জন্য রাষ্ট্রের মধ্যে অগ্রাধিকারমূলর ব্যবস্থাপনার জন্য গুরুত্ব দেওয়া হয় যেমন- একদিকে তাদের মালিকানাধীন ভূখণ্ড এর সাথে সাথে তাদের আয়ত্তাধীন একা তাদের বসবাসের স্থল এবং তাদের দখলকৃত ভূখণ্ডকেও রাষ্ট্রীয়ও জাতীয়ভাবে (যার বৈধ মালিকানা তাদের নয়) তাদের নিজা সম্পত্তি দান করার তাগিদ দেওয়া হয়েছে কিন্তু বাংলাদেশ্যে সংবিধানে এই ধরনের কোনো নির্দেশনামূলক অংশ সংযুক্ত নেই। সমাজের দুর্বলতম অংশ হিসেবে তাদের সম্পত্তি সবসময়ের সবল অংশ দ্বারা জবরদস্তির দখল এবং জোর করে মালিকানা কেজ নেওয়ার ঘটনা অত্যন্ত স্বাভাবিক হয়ে যায়। যদি রাষ্ট্র কোনে প্রতিকার এবং সংরক্ষণের ভূমিকায় না আসে।


১০. সংখ্যালঘুদের জন্য সুরক্ষিত ও অগ্রাধিকারমূলক ব্যবস্থা না থাকা: সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জন্য কোনো ধরনের বিশেষ কোটা বা সুরক্ষা ব্যবস্থা সংবিধানে সরাসরি উল্লেখ নেই। যদিও বিভিন্ন সরকার সংখ্যালঘুদের জন্য কিছু কোটা ব্যবস্থা প্রবর্তন করেছে, তবুও সংবিধানে এটি স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠিত নয়।


উপসংহার: বাংলাদেশের সংবিধানে সরাসরি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জন্য বিশেষ কোনো সুরক্ষা বা সুবিধার উল্লেখ নেই, তবে সাধারণ নাগরিকত্বের অধিকারগুলির মধ্যে তাদের অধিকার কিছুটা স্বীকৃত। সংবিধানে সরাসরি সংখ্যালঘুবান্ধব কোনো ব্যবস্থা না থাকলেও, এটি অস্পষ্টভাবে তাদের অধিকারের প্রতি এক ধরনের সমর্থন প্রদর্শন করে। ভবিষ্যতে, এই বিষয়টি আরও স্পষ্টভাবে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হতে পারে, যাতে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় আরো সুরক্ষিত এবং সমান অধিকারভোগী হয়।

No comments:

Post a Comment