সংখ্যালঘুদের অধিকার রক্ষায় বাংলাদেশের ও আন্তর্জাতিক উদ্যোগ সম্পর্কে মতামত
ভূমিকা: বাংলাদেশ একটি বহু ধর্ম, ভাষা ও সংস্কৃতির দেশ। এখানে বাঙালি সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও নানা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, উপজাতি ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা একসঙ্গে বসবাস করে আসছে। সংবিধানে সকল নাগরিকের সমঅধিকারের কথা বলা হলেও বাস্তবে সংখ্যালঘুদের অধিকার রক্ষা একটি জটিল ও চ্যালেঞ্জপূর্ণ বিষয়। বাংলাদেশ সরকার ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। জাতীয় ও বৈশ্বিক পর্যায়ে এসব উদ্যোগ কতটা কার্যকর এবং ভবিষ্যতে এর টেকসই বাস্তবায়ন কেমন হতে পারে, সে বিষয়ে মতামত প্রদান করা হলো।
সংখ্যালঘুদের অধিকার রক্ষায় বাংলাদেশ সরকারের উদ্যোগ
বাংলাদেশ সরকার সংখ্যালঘুদের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করতে বিভিন্ন সময় নানা নীতি ও কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। রাষ্ট্রীয়ভাবে সংখ্যালঘুদের চিহ্নিত করে তাদের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য নানাবিধ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
প্রথমত, সরকার সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীকে দুটি প্রধান শ্রেণিতে ভাগ করেছে—
১. পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি উপজাতীয় ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী;
২. সমতলে বসবাসকারী ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীসমূহ (যেমন রাজশাহী, দিনাজপুর, ময়মনসিংহ, সিলেট, কক্সবাজার ও বরিশাল অঞ্চলের বিভিন্ন সম্প্রদায়)।
এরা সাধারণত স্থানান্তর ভিত্তিক কৃষিকাজ, জুমচাষ বা নিজস্ব ঐতিহ্যবাহী পেশার ওপর নির্ভরশীল। স্বাধীনতার পর থেকে রাষ্ট্রীয় নীতিতে তাদের উন্নয়ন ও সুরক্ষার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। ১৯৯২ সালে জাতিসংঘ ‘আন্তর্জাতিক আদিবাসী বর্ষ’ ঘোষণা করলে বাংলাদেশের সংখ্যালঘুরাও নিজেদের ‘আদিবাসী’ পরিচয়ে ঐক্যবদ্ধ হয়। বাংলাদেশ এই ঘোষণার অন্যতম সাক্ষরকারী দেশ হিসেবে তাদের অধিকার রক্ষায় পদক্ষেপ নিতে অঙ্গীকারবদ্ধ হয়।
তবে ২০১১ সালের সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সরকার সংখ্যালঘুদের ‘আদিবাসী’ না বলে ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী’, ‘উপজাতি’ বা ‘জাতিগত সম্প্রদায়’ হিসেবে অভিহিত করে। এই সংশোধনীতে সংবিধানের ৬(২) অনুচ্ছেদে বলা হয়— “বাংলাদেশের সকল নাগরিকই বাঙালি,” অর্থাৎ নাগরিকত্বের ভিত্তিতে সবাই সমান মর্যাদাপূর্ণ নাগরিক হিসেবে স্বীকৃত।
এছাড়া সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি (১৯৯৭) স্বাক্ষরের মাধ্যমে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর ভূমি, সংস্কৃতি, ভাষা ও প্রশাসনিক অধিকার সংরক্ষণের পথে একটি ঐতিহাসিক পদক্ষেপ নেয়। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর শিক্ষা উন্নয়নে মাতৃভাষাভিত্তিক প্রাথমিক শিক্ষা চালু করা হয়, তাদের সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ও উৎসব উদযাপনে রাষ্ট্রীয় অনুদান প্রদান করা হচ্ছে। তাছাড়া জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত আসন ও সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থার মাধ্যমে সংখ্যালঘুদের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা হয়েছে।
সব মিলিয়ে বলা যায়, সরকার সংবিধান ও নীতিমালার মাধ্যমে সংখ্যালঘুদের মৌলিক মানবাধিকার, শিক্ষা, কর্মসংস্থান, স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে ক্রমাগত সচেষ্ট।
সংখ্যালঘুদের অধিকার রক্ষায় আন্তর্জাতিক উদ্যোগ
বিশ্বব্যাপী সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর অধিকার রক্ষায় জাতিসংঘ ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থা নানা পদক্ষেপ নিয়েছে। এসব উদ্যোগের উদ্দেশ্য হলো বিশ্বজুড়ে বৈষম্য, নিপীড়ন ও জাতিগত সংঘাত কমিয়ে একটি সমঅধিকারভিত্তিক সমাজ গঠন করা।
প্রথমত, আন্তর্জাতিকভাবে সংখ্যালঘুদের সংজ্ঞা নির্ধারণের প্রচেষ্টা নেওয়া হয়, যাতে প্রতিটি রাষ্ট্র তাদের নিজস্ব সংখ্যালঘু গোষ্ঠীকে সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করতে পারে এবং তাদের অধিকার সংরক্ষণের জন্য আইন প্রণয়ন করতে পারে।
দ্বিতীয়ত, জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো সংখ্যালঘুদের অধিকার রক্ষায় বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ও মানবাধিকার ফোরামকে আর্থিক ও নৈতিক সহায়তা প্রদান করে। এসব সংগঠন মাঠপর্যায়ে সংখ্যালঘুদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ভূমি ও নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় কাজ করে থাকে।
তৃতীয়ত, জাতিসংঘের মানবাধিকার সনদ, আন্তর্জাতিক নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার সনদ (ICCPR), অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার সনদ (ICESCR) প্রভৃতি আন্তর্জাতিক চুক্তি সংখ্যালঘুদের অধিকারকে বৈশ্বিকভাবে স্বীকৃতি দেয়। এছাড়া ১৯৯২ সালে গৃহীত “Declaration on the Rights of Persons Belonging to National or Ethnic, Religious and Linguistic Minorities” দলিলের মাধ্যমে সংখ্যালঘুদের সুরক্ষা নিশ্চিতের আন্তর্জাতিক বাধ্যবাধকতা তৈরি হয়।
চতুর্থত, আন্তর্জাতিক মহল জাতিগত বৈষম্য দূর করতে ‘বিশ্ববর্ণবৈষম্যবিরোধী কর্মসূচি’ চালু করেছে, যার লক্ষ্য সমাজে সমান সুযোগ সৃষ্টি করা ও বৈষম্যহীন পরিবেশ প্রতিষ্ঠা করা।
পঞ্চমত, সংখ্যালঘুদের মানবিক নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী মিশন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, কমনওয়েলথ ও অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মতো সংস্থাগুলোও নিয়মিত প্রতিবেদন প্রকাশ করে এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপের জন্য সরকারগুলোর ওপর চাপ সৃষ্টি করে।
উপসংহার: সবশেষে বলা যায়, সংখ্যালঘুদের অধিকার রক্ষায় বাংলাদেশ সরকার ও আন্তর্জাতিক সংস্থা উভয়ই ইতিবাচক ভূমিকা পালন করছে। সংবিধানে নাগরিক সমঅধিকার ও ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি সংখ্যালঘুদের মর্যাদা ও নিরাপত্তার ভিত্তি গড়ে দিয়েছে। তবে শুধুমাত্র নীতি বা আইন থাকলেই যথেষ্ট নয় প্রয়োজন বাস্তব প্রয়োগ, সামাজিক সচেতনতা ও সহনশীলতা।
জাতীয় পর্যায়ে শিক্ষা, কর্মসংস্থান ও প্রশাসনে সংখ্যালঘুদের অংশগ্রহণ বাড়ানো এবং তাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রক্ষায় দীর্ঘমেয়াদি নীতি গ্রহণই পারে বাংলাদেশকে সত্যিকারের অন্তর্ভুক্তিমূলক রাষ্ট্রে পরিণত করতে। একইভাবে, আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও মানবাধিকার চর্চা যদি আরও জোরদার করা যায়, তাহলে বিশ্বব্যাপী সংখ্যালঘুদের নিরাপদ, মর্যাদাপূর্ণ ও ন্যায্য জীবনযাপন নিশ্চিত হবে।

No comments:
Post a Comment