স্বজাতিকতাবাদের সাম্প্রতিক ধারা আলোচনা কর

নৃগোষ্ঠী/ বর্ণবাদ/ স্বজাতিকতাবাদের সাম্প্রতিক ধারা আলোচনা

ভূমিকা: স্বজাতিকতাবাদ (Ethnocentrism বা Racism) একটি সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি, যেখানে মানুষ নিজেদের জাতি, গোষ্ঠী বা সংস্কৃতিকেই শ্রেষ্ঠ মনে করে এবং অন্য জাতিগোষ্ঠীর প্রতি নেতিবাচক মনোভাব পোষণ করে। এটি কেবল গায়ের রঙ, চেহারার গঠন বা শারীরিক বৈশিষ্ট্যের ওপর নির্ভর করে না, বরং সাংস্কৃতিক, ভাষাগত ও ধর্মীয় বৈচিত্র্যের বিরুদ্ধেও অবস্থান নিতে পারে। আধুনিক বিশ্বায়নের যুগে এ প্রথার রূপ অনেকটাই পরিবর্তিত হয়েছে। তবে এখনো বিভিন্ন সমাজে এর প্রভাব বিদ্যমান।
স্বজাতিকতাবাদের সাম্প্রতিক ধারা আলোচনা


সাম্প্রতিক ধারায় স্বজাতিকতাবাদ/ নৃগোষ্ঠী/ বর্ণবাদ:

১. সংখ্যালঘু বৈষম্য:

বিশ্বের বিভিন্ন উন্নত দেশ, যেমন- যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, অস্ট্রেলিয়ায় এখনো সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীর প্রতি বৈষম্যের চিত্র স্পষ্ট। বিশেষ করে আফ্রো-আমেরিকান, মুসলিম, লাতিনো, এশিয়ানদের চাকরি, শিক্ষালাভ ও ন্যায্য বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হতে হয়। 'Black Lives Matter' আন্দোলন এ বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে।


২. ভারতের বর্ণবাদ:

ভারতে ঐতিহাসিকভাবে প্রচলিত ব্রাহ্মণ্যবাদ বা বর্ণব্যবস্থা (ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র) এখন অনেকটাই কমে এলেও, সমাজে এখনো দলিত ও অনগ্রসর জাতিগোষ্ঠীর প্রতি বৈষম্য রয়ে গেছে। তবে শহরাঞ্চলে শিক্ষিত সমাজে এই প্রথার বিরুদ্ধে সচেতনতা বেড়েছে, যা একটি ইতিবাচক পরিবর্তন।


৩. আঞ্চলিক স্বজাতিকেন্দ্রিকতা:

নৃগোষ্ঠীগত স্বাতন্ত্র্য এখনো বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে রক্ষা করা হচ্ছে। যেমন- নিউজিল্যান্ডের মাওরি জনগোষ্ঠী, অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসী ‘অ্যাবরিজিন’ সম্প্রদায়, আফ্রিকার বিভিন্ন উপজাতি, দক্ষিণ আমেরিকার ইনকা-জাতিগোষ্ঠী নিজেদের ভাষা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য ধরে রাখার চেষ্টা করছে। এটি এক ধরনের সাংস্কৃতিক স্বজাতিকেন্দ্রিকতা।

৪. আমেরিকান স্বজাতিকতা ও শ্রেষ্ঠত্ববাদ:

যুক্তরাষ্ট্রে একশ্রেণির শ্বেতাঙ্গ নাগরিক নিজেদের শ্রেষ্ঠ মনে করে এবং অভিবাসী বা সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর ওপর ভিন্ন মনোভাব পোষণ করে। মার্কিন রাজনীতিতে এই মনোভাব ‘White Supremacy’ নামে পরিচিত। এর ফলে সমাজে বিভাজন ও উত্তেজনা বাড়ছে।


৫. বিশ্বায়ন ও গ্লোবাল ভিলেজ:

বর্তমান বিশ্বে জাতি, ধর্ম, ভাষা ও সংস্কৃতির সীমারেখা ভেঙে যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক যোগাযোগ, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, অভিবাসন ও প্রযুক্তির প্রসারের ফলে বিশ্ব এখন 'গ্লোবাল ভিলেজ'। এক্ষেত্রে স্বজাতিকতাবাদের সীমাবদ্ধতা ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে, যদিও এটি পুরোপুরি বিলুপ্ত হয়নি।


৬. সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য ও ঐতিহ্য:

বিশ্বায়নের মধ্যে থেকেও অনেক নৃগোষ্ঠী নিজেদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। যেমন- বাংলাদেশে গারো, চাকমা, মারমা প্রভৃতি আদিবাসী জনগোষ্ঠী তাদের নিজস্ব পোশাক, ভাষা ও উৎসব পালন করে। এটিও এক ধরনের ইতিবাচক স্বজাতিকতাবাদ।


৭. শারীরিক বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে পার্থক্য:

নাক-মুখের গঠন, ত্বকের রঙ, চুলের ধরন ইত্যাদির ভিত্তিতে জাতিগত বৈশিষ্ট্য শনাক্ত করা হয়। তবে আধুনিক সমাজে এসব পার্থক্য এখন আর শ্রেষ্ঠত্ব বা অধমতার মানদণ্ড হিসেবে গণ্য করা উচিত নয়।


৮. বাংলাদেশে স্বজাত্যবোধ ও সংখ্যালঘু অবস্থা:

বাংলাদেশে বর্ণবাদের প্রকটতা নেই, তবে স্বজাত্যবোধের ভিত্তিতে কিছু সামাজিক বৈষম্য রয়েছে। আদিবাসী জনগোষ্ঠী এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা (যেমন- হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান) মাঝে মাঝে বৈষম্যের মুখোমুখি হয়। তবে রাষ্ট্রীয়ভাবে তাদের অধিকার রক্ষায় বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।


৯. জিনতত্ত্ব ও রক্তের গ্রুপ:

বর্তমানে জিনতাত্ত্বিক গবেষণায় বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর শারীরিক বৈশিষ্ট্য ও রক্তের গ্রুপের বৈচিত্র্য চিহ্নিত করা সম্ভব হয়েছে। এতে বোঝা যায়, মানুষ একে অপরের থেকে শারীরিকভাবে কিছুটা আলাদা হলেও, মৌলিকভাবে সবাই একই মানবজাতির অন্তর্ভুক্ত।


১০. সামাজিক উন্নয়ন ও সাম্যচেতনা:

আধুনিক শিক্ষা ও মানবাধিকারের চেতনার প্রসারে স্বজাতিকতা ও বর্ণবাদের বিরুদ্ধাচরণ বেড়েছে। অধিকাংশ রাষ্ট্র এখন বহুজাতিক ও বহু-সংস্কৃতির সমাজ গঠনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, যেখানে জাতি, ধর্ম ও বর্ণ নির্বিশেষে মানুষ সমান অধিকার ভোগ করে।


উপসংহার: সবশেষে বলা যায়, স্বজাতিকতাবাদ বা বর্ণবাদ আগের মতো প্রকাশ্য না থাকলেও এখনো বিভিন্ন রূপে সমাজে বিরাজমান। আধুনিক যুগে প্রযুক্তি, শিক্ষা ও মানবাধিকারের বিকাশ এই নেতিবাচক প্রবণতা হ্রাসে সহায়ক হচ্ছে। তবে সামাজিক ন্যায্যতা ও সমান সুযোগ নিশ্চিত করতে হলে এখনো আমাদেরকে জাতি, ধর্ম, বর্ণভেদ ভুলে মানুষকে মানুষ হিসেবে সম্মান করতে হবে। একমাত্র মানবিক চেতনার বিকাশই পারে স্বজাতিকতাবাদের নেতিবাচক প্রভাব দূর করে একটি সাম্যভিত্তিক সমাজ গড়ে তুলতে।

No comments:

Post a Comment