বাংলাদেশের উপজাতি গোষ্ঠীর অর্থনৈতিক কাঠামো সম্পর্কে আলোচনা কর।
বাংলাদেশের এথনিক গোষ্ঠীর অর্থনৈতিক কাঠামো সম্পর্কে যা জান লেখ।
উত্তর: বাংলাদেশে বসবাসরত উপজাতি সম্প্রদায়ের অর্থনৈতিক কাঠামোতে স্বতন্ত্র ধারা লক্ষ করা যায়। আদিকাল থেকেই তারা উৎপাদনক্ষেত্রে তাদের নিজস্ব ধারা অনুসরণ করে আসছে। তাদের ঐতিহ্যগত পেশা হচ্ছে জুমচাষ। বর্তমানে জুমচাষ থেকে বেরিয়ে এসে নানা স্থানে নানাভাবে অর্থ উপার্জন করতে শুরু করেছে। বিশেষ করে শিক্ষার ছোঁয়া পাওয়ায় তাদের অর্থনৈতিক কাঠামোতে পরিবর্তন পরিলক্ষিত হচ্ছে।
বাংলাদেশের উপজাতি গোষ্ঠী/এথনিক গোষ্ঠীর অর্থনৈতিক কাঠামো:
নিম্নে বাংলাদেশের উপজাতি গোষ্ঠী/এথনিক গোষ্ঠীর অর্থনৈতিক কাঠামো সম্পর্কে আলোচনা করা হলো-
১. জুমচাষ: উপজাতি সম্প্রদায়ের অনেকেরই অর্থনৈতিক কাঠামো অনেকটা কৃষিনির্ভর, বিশেষ করে তারা পাহাড়ি অঞ্চলে পাহাড়ের গায়ে খনন করে চাষাবাদ করে, ফসল উৎপন্ন করে, যা 'জুমচাষ' নামে পরিচিত। এ চাষের ফলে যে খাদ্যদ্রব্য উৎপন্ন হয় তা দ্বারা তাদের জীবন যাত্রা নির্বাহ করে থাকে। তবে জুমচাষ অনেকাংশে প্রকৃতিনির্ভর। তাই উৎপাদন সর্বদা সাফল্যজনক নাও হতে পারে। যেমন- গারোরা জুমচাষের ওপর বেশি নির্ভরশীল।
২. হাল চাষ: উনিবংশ শতাব্দী থেকেই উপজাতিরা বাঙালিদের থেকে হালচাষ পদ্ধতি শিখেছে। দুই পাহাড়ের মধ্যবর্তী সমতল ভূমিতে ধান, গম প্রভৃতি চাষ করে তাদের জীবিকানির্বাহ করে থাকে। তা ছাড়া সরকারি বিভিন্ন উদ্যোগের ফলে তারা উদ্যান কৃষি বা Horticulture পদ্ধতিতে বিভিন্ন ধরনের ফল যেমন- কাঁঠাল, আনারস, কলা ইত্যাদি উৎপাদন করছে। তা ছাড়া তারা সাম্প্রতিককালে রবার চাষ, কাঠের গাছ লাগানো ইত্যাদি পেশায় নিয়োজিত হচ্ছে।
৩. পশুপালন ও হস্তশিল্প: উপজাতি সম্প্রদায়ের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে পশুপালন ও হস্তশিল্পের মাধ্যমে বিভিন্ন বস্তু তৈরি। তাঁরা হাঁস-মুরগিসহ বিভিন্ন ধরনের পশু পালন করে অর্থনৈতিক সচ্ছলতা আনয়ন করে থাকে। তাছাড়া নানা ধরনের হস্তশিল্পজাত দ্রব্য যেমন- খড়ি, বাঁশ দিয়ে বিভিন্ন ধরনের শিল্পজাত দ্রব্য তৈরির ক্ষেত্রে তাদের জুড়ি নেই। তাছাড়া চাকমা উপজাতিদের কাপড় বেশ বিখ্যাত।
৪. প্রকৃতিনির্ভর অর্থনৈতিক কাঠামো: আদিবাসী সম্প্রদায় প্রত্যন্ত সনাতন পদ্ধতিতে জীবনযাপনে অভ্যন্ত। তারা প্রকৃতির ওপর নির্ভর করে সবকিছু সমাধা করতে চায়। তাই তাদের অর্থনৈতিক জীবনধারা প্রকৃতিনির্ভর। তাদের অর্থনৈতিক জীবনের প্রধান দিক হলো শিকার ও খাদ্য সংগ্রহ। শিকার করে এবং বনজঙ্গল থেকে বিভিন্ন ধরনের দ্রব্যসামগ্রী সংগ্রহ করে তাদের জীবিকানির্বাহ করে থাকে। যেমন- খড়ি সংগ্রহ করা, পশু শিকার করা ইত্যাদি। মুরংরা বন থেকে কাঠ কেটে বাজারে বিক্রি করে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে অবদান রাখে।।
৫. প্রধান জীবিকা শিকার: পশু শিকার হলো আদিবাসী সম্প্রাদায়ের অর্থনৈতিক কাঠামোর প্রধান দিক। তারা বিভিন্ন ধরনের শিকার করে খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করে থাকে। খাদ্য ব্যতীত অন্যান্য বিষয়েও তারা জীবজন্তর অপর নির্ভরশীল। পোশাক-পরিচ্ছদ, শিকারের যন্ত্রসহ যাবতীয় সামন্ত্রীর আগাজেও তারা জীবজন্তুর ওপর বহুলাংশে নির্ভরশীল। পশুর মাংস খাদ্য হিসাবে ব্যবহারের পর চামড়া থেকে (পাশাক এবং শিং ও হাড় নিয়ে হাতিয়ার তৈরি করে।
৬. অস্ত্র তৈরি: অস্ত্র তৈরিতে তারা অভ্যস্ত নিপুণ। বিশেষ কার বন্দুক বা অন্যান্য মারণাস্ত্র একমাত্র তাদেরই প্রথম সৃষ্টি। তীর, সড়কি, বর্শা, ডলোয়ার একমাত্র তাদের তৈরি, যা পরবর্তীতে নতুনভাসে সংস্কার করা হয়েছে। কথিত আছে বাংলাদেশের সুরং উপজাতিরাই প্রথম বন্দুকজাতীয় হাতিয়ার তৈরি করে। এগুলোর মাধ্যমে তারা পশুশিকার করে জীবিকানির্বাহ করে।
৭. খাদ্যসংগ্রহ: মূলত খাদ্যসন্তাহের জন্য আরা প্রকৃতির ওপর নির্ভরশীল। গাছ থেকে ছাল ও পাতা সংগ্রহ করে তারা খাদ্য ও বাসস্থানের সরঞ্জাম হিসেবে ব্যবহার করে। তা ছাড়া কাঠ দিয়ে শিকারের হাতিয়ারও তৈরি করা হয়। প্রাচীন ফালে তারা গাছের পাতাকে পরিধেয় বস্তু হিসেবে ব্যবহার করত। বর্তমানে তারা আরও উন্নত পদ্ধতি অবলম্বন করতে শিখেছে। খাদ্য হিসেবে তারা চাষাবাদ পেশাকে বেছে নিয়েছে, যার দ্বারা জীবিকা নির্বাহ করে থাকে।
৮. দ্রব্যাদি বিনিময়: তারা নিজেরা দ্রব্য প্রস্তুত করতেও স্বনির্ভর জীবনযাপন করতে অভান্ত। তাদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সহজ-সরল ও সাধারণ প্রকৃতির। তবে তার দ্রব্য বিনিময় প্রথায় আভ্যস্ত। অর্থাৎ নিজেদের মধ্যে দ্রব্য বিনিময় করে নিজেদের জীবিকা নির্বাহ করার প্রচেষ্টায় তারা অভ্যন্ত।
৯. পাহাড়ি জীবজন্তুর সাথে প্রতিযোগিতামূলক জীবনযাপন: আদিবাসী সম্প্রদায় পাহাড় ও বনজঙ্গলে তাদের বসবাস গড়ে তুলেছে। তারা নিজেদের স্বতন্ত্র জাতি হিসেবে পাহাড়ি জনগোষ্ঠী হিসেবে নিজেদের পরিচয় দিয়ে থাকে। আদিম অবস্থা থেকে নিজেরা বিভিন্ন ধরনের জীবজন্তু ও পশুর সাথে মাড়াই করে নিজেদে অস্তিত্বকে টিকিয়ে রেখেছে। তার জন্য তাদেরকে কঠোর পরিশ্রম ও সাহসী হতে হয়েছে। তারা পশুজগতের সাথে প্রতিযোগিতা করে নিজেদের জীবিকানির্বাহ করে থাকে।
১০. বিভিন্ন দ্রব্য উৎপাদন: উপজাতিরা বিভিন্ন ধরনের দ্রবাদি উৎপাদন করে থাকে। যেমন- মারমারা কাপড়, চুরুট ও নকশা করা শাল তৈরি করে।
১১. বাঁশ ও বেত শিল্প: পাহাড়ি অঞ্চলগুলো বাঁশ ও বেতের জন্য বিখ্যাত। পাহাড়ি অঞ্চলগুলোতে প্রচুর পরিমাণে বাঁশ ও বেত হয়। এগুলো দিয়ে উপজাতিরা বিভিন্ন দ্রব্যাদি তৈরি করে। যেমন- বাঁশের ঝুড়ি, বেত দিয়ে শীতল পাটি, বিভিন্ন বয়সের খেলনা ইত্যাদি, যা বাজারে বিক্রি করে উপজাতিতা অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে বিশেষ অবদান রাখে।
১২. মৎস্য আহরণ: আদিবাসীরা শাহাড়ি অঅ্যাসের মদীগুলো থেকে মাছ শিকার করে থাকে। তারা তাদের আহরণকৃত মাছ স্থানীয় বাজারে বিক্রি করে অর্থনৈতিক ভিত্তি সুদৃঢ় করার ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রাখে।
১৩. ফলমূল চাষ ও সংগ্রহ: পাহাড়ি অঞ্চলগুলোতে প্রাকৃতিকভাবে অনেক ফলমূল জংলু থাকে। আনক আদিবাসী সম্প্রদায় নিজস্ব উদ্যোগে সে ফলমূল সংগ্রহ করে। আবার কিছু কিছু আদিবাসী সম্প্রদায় নিজস্ব উদ্যোগে পাহাড়ি অঞ্চলে রপ্তানিযোগ্য ফলের চাষ করে। যেমন- কমলা, আনারস, বাতাবিলেবু ইত্যাদি। এর মাধ্যমেও আদিবাসী সম্প্রদায় তাদের অর্থনৈতিক ভিত্তি মজবুত করছে।
১৪. চা চাষ: বর্তমান কালের আদিবাসী সম্প্রাদায়ের মধ্যে চায়ের বাগানে কাজ করা ও চা চাষের প্রতি ঝুঁকে যেতে দেখা যায়। যেমন- সিলেট ও চট্টগ্রামের উপজাতিদের মধ্যে চা চাষের প্রতি ঝুঁকতে দেখা যায়। তারা সাধারণ চায়ের পাতা সংগ্রহ করে নিজেদের জীবিকানির্বাহ করতে অভ্যস্ত। বিশেষ করে নারীদের মধ্যে এ প্রবণতা বেশি লক্ষণীয়। তাদের সন্তানদের পিঠে বেঁধে নিয়ে চায়ের পাতা সংগ্রহ করে জীবিকানির্বাহ বর্তমান কালের আদিবাসী নারী সম্প্রদায়।
১৫. কর্মসংস্থান: বর্তমানে উপজাতিরা উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করে কোটা সুবিধায় বা যোগ্যতার ভিত্তিতে বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি চাকরিতে নিয়োগ পাচ্ছে। বিভিন্ন এনজিও ও সেবামূলভপ্রতিষ্ঠানে নিজেদের সম্পৃক্ত করছে। কেউ কেউ ব্যবসা-বাণিজ্য করছে। আবার কেউ কেউ বিদেশে পাড়ি দিচ্ছে। এভাবেই উপজাতিদের কর্মসংস্থানের মাধ্যমে তাদের অর্থনৈতিক কাঠামোতে পরিবর্তন সূচিত হচ্ছে। শিক্ষার মাধ্যমে তাদের কুসংস্কারও দূর হচ্ছে।
উপসংহার: উপর্যুক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, আদিবাসী সম্প্রদায় একটি বিশেষ সংস্কৃতি ও ভাষা নিয়ে বাংলাদেশে বসবাস করে আসছে। তাদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড প্রকৃতিনির্ভর ও পশুশিকার হলেও বর্তমানে সভ্যতার ছোঁয়ায় কিছুটা পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে। তবে তার। তাদের নিজস্ব ঐতিহ্য স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠা করতে বদ্ধপরিকর। বাংলাদেশের উপজাতিদের জীবনযাত্রা লক্ষ করলে এটি সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে।

No comments:
Post a Comment