পরিসংখ্যানের ব্যবহার ও গুরুত্ব লেখ
বিজ্ঞানের কয়েকটি শাখায় পরিসংখ্যানের ব্যবহার উল্লেখ কর।
ভূমিকা: অতি প্রাচীনকাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত জ্ঞানবিজ্ঞানের অনেক ক্ষেত্রে পরিসংখ্যানের ব্যবহার হচ্ছে। সমাজ বা রাষ্ট্রে একটা বিশাল ক্ষেত্র এবং এ বিশাল ক্ষেত্র নিয়ে কাজ করতে গেলে অনেক সময় ও শ্রমের প্রয়োজন। তাই সীমিত উপাত্তের উপর নির্ভর করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করাই প্রকৃতপক্ষে পরিসংখ্যানের কাজের আওতাভুক্ত। পরিসংখ্যান শুধু বর্তমানকে নিয়েই আলোচনা করে না সাথে সাথে অতীতকে এবং বর্তমানে ও অতীতের আলোকে ভবিষ্যৎকে নিয়েও আলোচনা করে। যার জন্য পরিসংখ্যানের ব্যবহার দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।
পরিসংখ্যানের ব্যবহারঃ পরিসংখ্যানের উৎপত্তি হয়েছিল রাষ্ট্রীয় হিসাবনিকাশের জন্য। বর্তমানে রাষ্ট্রীয় কার্যের পাশাপাশি সামাজিক, অর্থনৈতিক, ব্যবসায়িক, রসায়ন, জীববিদ্যা, কৃষি প্রভৃতি ক্ষেত্রে এর ব্যাপক ব্যবহার হচ্ছে। বিজ্ঞানের কয়েকটি শাখায় পরিসংখ্যানের ব্যবহার নিয়ে আলোচনা করা হলো।
১. সমাজবিজ্ঞানে পরিসংখ্যানঃ সমাজবিজ্ঞানের মূল আলোচ্য বিষয় মানুষ ও সমাজ। মানুষ কিভাবে সমাজে বসবাস করে। বিভিন্ন সমস্যা ও তার প্রতিকার, স্তরবিন্যাস প্রভৃতি দিয়ে সমাজবিজ্ঞান আলোচনা করে। সমাজের অধিকাংশ ক্ষেত্রে গবেষণা পরিচালনায় পরিসংখ্যানের ব্যবহার প্রাচীনকাল থেকেই চলে আসছে। সভ্যতার শুরু থেকেই অর্থাৎ, সমাজে যখন থেতে কৃষিয় আবিষ্কার ও ব্যবহার শুরু হয়, মানুষ তখন থেকেই পরিসংখ্যান ব্যবহার করে আসছে। ক্রমে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। মানুষ নানামুখী উৎপাদন কাজে ছড়িয়ে পড়ে। সমায়ে নতুন নতুন সমস্যার সৃষ্টি হতে থাকে এবং সাথে সাথে পরিসংখ্যানের উন্নয়ন হয়। বর্তমানে সমাজবিজ্ঞানের অনেক জটিল বিষয়ের গবেষণায়ও এর ব্যবহার হয়।
২. রাষ্ট্রবিজ্ঞানে পরিসংখ্যান: রাষ্ট্রপরিচালনায় রাষ্ট্রবিজ্ঞান তার সম্যক আলোচনায় ব্যাপৃত। রাষ্ট্রের বিভিন্ন নীতি নির্ধারণ, কর্মপরি কল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে পরিসংখ্যান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। রাষ্ট্র কোন উৎস থেকে কত আয় করল য ব্যয় করল এবং সেগুলো কোন খাতে, কি পরিমাণে ব্যয় করা হলো এগুলোর জন্য পরিসংখ্যানের সাহায্য নেয়। রাষ্ট্র প্রতি বহন যে বাজেট প্রণয়ন করে সেটি একটা পরিসংখ্যান মাত্র। রাষ্ট্রের চলমান রাজনৈতিক, অবস্থা, বিচার বিশ্লেষণে এর ব্যবহার হয়। কোন ধরনের রাষ্ট্রব্যবস্থা, ক্ষমতাসীন সরকার রাষ্ট্র পরিচালনায় কতটুকু সার্থক প্রকৃতি এর ব্যবহার হয়।
৩. অর্থনীতিতে পরিসংখ্যানঃ অর্থনীতি অর্থসংক্রান্ত বিষয় নিয়ে আলোচনা করে। মানুষের অসীম অভাব এবং সাহিত সম্পদ। সীমিত সম্পদের সাহায্যে কিভাবে অসীম অভাব দূর করা যায় অর্থনীতির আলোচ্য বিষয় সেটাই। আর অর্থনীতি রায় আলোচনায় পরিসংখ্যানকে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করে। ওসোর উৎপাদন, বণ্টন, বিনিময়, ভোগ প্রভৃতি আলোচনায় পরিসাংখিত পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়। বর্তমান ও অতীতের অর্থনৈতিক অবস্থার মধ্যে তুলনামূলক আলোচনা ও সে অনুযায়ী ভবিষন সম্পর্কে ধারণা লাভের জন্য এর ব্যবহারের বিকল্প নেই। কোনেব নির্দিষ্ট সময়ের প্রেক্ষিতে দ্রব্যের চাহিদা, যোগান, মজুদ এসবের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণে পরিসংখ্যান ব্যবহৃত হয়।
৪. কৃষিতে পরিসংখ্যান: মানুষের বেঁচে থাকার জন্য যে মৌলিক চাহিদাগুলো প্রয়োজন সেগুলো পূরণ করে কৃষি। কৃষিতে উৎপাদন, বণ্টন, বিনিময়, ভোগ এসবের হিসাব রাখার প্রয়োজন পড়ে। কৃষিতে কি পরিমাণ বিনিয়োগ করলে অধিক উৎপাদন সম্ভব, সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতি মহামারি, প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রভৃতির হিসাব রাখতে হয়। এর জন্য প্রয়োজন পরিসংখ্যান। দেশের হৎস্য সম্পদ, বনজ ও পশু সম্পদের সঠিক ব্যবহার ও বিশ্লেষণে পরিসংখ্যানের ব্যবহার হয়।
৫. ব্যবসায়িক পরিসংখ্যানঃ পরিসংখ্যানের ব্যবহার ব্যবসায়-বাণিজ্য ক্ষেত্রে ব্যাপক। ব্যবসায় বাণিজ্যের বর্তমান ও অতীত এবং সে আলোকে ভবিষ্যৎকে নিয়ে আলোচনা করে। হায়সায়ীগণ তাদের পণ্যের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ চাহিদা ও যোগান সম্বন্ধে ধারণা নেওয়ার জন্য তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণে পরিসংখ্যানের ব্যবহার করেন। ব্যবসায় বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বিরাজমান প্রতিযোগিতায় টিকে থাকলে হলে কিভাবে কম খরচে অধিক দ্রব্য উৎপাদন, অপচয় রোধ, কর্মদক্ষতা বৃদ্ধি প্রভৃতি করা যায় তার জন্য পরিসংখ্যানের জ্ঞান প্রয়োজন।
৬. ব্যবস্থাপনায় পরিসংখ্যানঃ দ্রব্যের চাহিদা ও যোগানের প্রেক্ষিতে গৃহীত ব্যবস্থা কেমন হবে, পূর্বে কেমন ছিলো, কতটুকু পরিবর্তন করতে হবে এগুলো জানতে হয়। ব্যবসায়ের গড়ি, বাজার ব্যবস্থা, মুদ্রাস্ফীতি, ক্ষয়ক্ষতি প্রভৃতির হিসাব জানা প্রয়োজন। সম্ভাব্য সকল অশুভ শক্তির হাত থেকে কিভাবে সর্বোচ্চ রক্ষা পাওয়া যায় নিজেদের অবস্থান কোথায়। কোন পথ ধরে এগিয়ে যেতে হবে এরূপ সকল ধরনের গবেষণায় পরিসংখ্যানের ব্যবহার হয়। উৎপাদনের কর্মদক্ষতা বৃদ্ধি, পতি নিরীক্ষা, কাজের মূল্যায়ন, বাজার গবেষণায় অর্থাৎ, কারবার প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনায় পরিসংখ্যানের ভূমিকা অনস্বীকার্য।
৭. পদার্থ বিজ্ঞান ও রসায়নে পরিসংখ্যান: মানুষের জীবন বাঁচাতে ও জীবন সাজাতে পদার্থ বিজ্ঞান ও রসায়নের বিকল্প নেই। পদার্থবিজ্ঞান বিভিন্ন পদার্থের ওজন, আয়তন, উচ্চতা প্রভৃতি নির্ণয়ে পরিসংখ্যানের ব্যবহার হয়। চন্দ্রগ্রহণ, সূর্যগ্রহণ, দিন, রাত্রি, আবহাওয়া প্রভৃতি গবেষণায় পরিসংখ্যানের ব্যবহার - হয়। বিভিন্ন অনু পরমাণুর আয়তন পরিবেশ দূষণ, বিপাক প্রভৃতি গবেষণায় পরিসংখ্যান ব্যবহৃত হয়।
৮. জীববিজ্ঞানে পরিসংখ্যানঃ জীববিজ্ঞান মানুষকে অন্যান্য পদার্থ ও জীব থেকে পৃথক করেছে। আদমশুমারি, জিনের বংশ পরস্পরায় বৈশিষ্ট্য, জীবের আয়ুষ্কাল প্রভৃতি নিয়ে জীববিজ্ঞানে পরিসংখ্যান ব্যবহার হয়।
উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, পরিসংখ্যানের সার্বিক ব্যবহার ব্যতিরেকে কোন সমাজ বা রাষ্ট্রের টেকসই কোনো উন্নয়ন সম্ভব নয়। ব্যবসায় বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সরকারের যাবতীয় রাষ্ট্রীয়কাজে সমাজবিজ্ঞানসহ অন্যান্য বিজ্ঞানে বিশেষ করে অর্থনীতি, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, ব্যবস্থাপনা এবং প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের পদার্থবিজ্ঞান এমন কোনো ক্ষেত্র নেই যেখানে পরিসংখ্যান ব্যবহার নেই।
পরিসংখ্যানের গুরুত্ব আলোচনা কর
পরিসংখ্যানের সংজ্ঞা হতে এর ব্যবহার সম্বন্ধে ধারণা করা যায়। প্রাচীনকালে পরিসংখ্যানকে রাজাদের বিজ্ঞান বলা হাত। কিন্তু বর্তমানে মানবজীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে পরিমাপ ও হিসাব নিকাশ প্রধানত মুখ্য ভূমিকা পালন করে। পরিসংখ্যান পরিধি ও পদ্ধতির উন্নয়নের সাথে সাথে একে আর শুধু উপাত্ত সংগ্রহের পদ্ধতি হিসেবে চিহ্নিত করা যায় না, বরং এটা উপাত্তের বিশ্লেষণ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের একটা শক্তিশালী পদ্ধতি।
পরিসংখ্যানের গুরুত্বঃ রাষ্ট্রীয় কল্যাণের চিন্তা যত বৃদ্ধি পায় উপযুক্ত পরিকল্পনা প্রণয়নের জন্য এবং তা বাস্তবায়নের জন্য পরিসংখ্যানের ব্যবহার বা গুরুত্ব তত বৃদ্ধি পাবে। যাতায়াত ব্যবস্থা থেকে শুরু করে পরিবার পরিকল্পনা, প্রহামুল্য, উৎপাদন, আয়, ব্যয়, লাজ, বিনিয়োগ ইত্যাদির জন্য সরকার পরিসংখ্যান পদ্ধতির গুরুত্ব অনুভব করে। উপযুক্ত জনসংখ্যার নীতির জন্য জন্ম, মৃত্যু বয়স এবং লিঙ্গ অনুসারে জনসংখ্যার বিন্যাস, পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রমে পরিসংখ্যানের প্রয়োজন। মৃত্যু পরিসংখ্যান দেখে স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা পয়ল্পপ্রণালির উন্নয়ন, চিকিৎসা সুবিধা বৃদ্ধি এবং জনগণকে সচেতন করে তোলার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেন।
জনসংখ্যা বিষয়ে যে সমস্ত উপাত্তের কথা বলা হয়েছে সেগুলো আদমশুমারি বা জীব পরিসংখ্যান থেকে পাওয়া যায়। আদমশুমারি ছাড়াও গৃহ গুমারি, শিল্প শুমারি, কৃষি শুমারি উপাত্ত যথেষ্ট তথ্য সরবরাহ করে থাকে। এই সমস্ত তথ্য উৎপাদন বৃদ্ধি হার থেকে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার যাতে না বাড়ে সে ব্যাপারে পরিকল্পনা প্রণয়ন সাহায্য করে।
ব্যবসায় বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বা শিল্পের ক্ষেত্রে উৎপাদন, বিনিয়োগ বা উৎপাদিত পণ্যের বাজারজাতকরণ মাঝে মাঝে পরিবর্তনশীল। ফলে শিল্প বা ব্যবসায় বাণিজ্যের প্রসার করতে হলে এ বিষয় সংক্রান্ত উপাত সপ্তাহ ও বিশ্লেষণ করতে হবে। এটা পরিসংখ্যান পদ্ধতির সাহায্যে করা যায়। আমদানি রপ্তানি মূল্য নিয়ন্ত্রণ, কর হ্রাস করার জন্য উপাত্ত সপ্তাহ করা সরকারের একান্ত প্রয়োজন। শস্যের আমদানি, রপ্তানি কী পরিমাণ হবে তা নির্ধারণের জন্য খাদ্যশস্যের উৎপাদন, বণ্টন ব্যবস্থা, চাহিদা ইত্যাদির পরিসংখ্যান জান্য থাকতে হবে। কৃষি উৎপাদনের জন্য সার প্রয়োগ, সারের কার্যকারিতা, বীজের প্রভাব, সার ও বীজের যৌথ ক্রিয়া এবং পানি সেচের সুবিধা ইত্যাদি তথ্য জানা একান্ত প্রয়োজন। পরিকল্পিত নিরীক্ষণের সাহায্যে এই সমস্ত উপাত্ত সংগ্রহ করা যায়।
উপরিউক্ত গুরুত্ব ছাড়াও আরো কিছু গুরুত্ব সংক্ষেপে নিচে দেওয়া হলো।
১. পরিসংখ্যান মানবকল্যাণের অংকশান্ত।
২. পরিসংখ্যান ঘটনা বা অবস্থার পূর্বাভাস দেয়।
৩. পরিসংখ্যান দ্বারা নীতি নির্ধারণ করা যায়।
৪. পরিসংখ্যান প্রশাসন কার্যে সহায়তা দান করে।
৫. পরিসংখ্যান ব্যবসায় বাণিজ্যে সহায়তা দান করে।
৬. পরিসংখ্যান অতীত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার সংরক্ষক।
৭. পরিসংখ্যান রাষ্ট্রের আইন প্রণয়নে সহায়তা করে।
৮. বিজ্ঞানের প্রতিটি শাখায় পরিসংখ্যানের ব্যবহার হয়েছে।
উপসংহারঃ উপরিউক্ত আলোচনার ক্ষেত্রে প্রতীয়মান হয় যে সামাজিক গবেষণার ক্ষেত্রে পরিসংখ্যান পদ্ধতি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তথ্য প্রদান ও তথ্য বিশ্লেষণপূর্বক সঠিক ফলাফল প্রদানে ক্ষেত্রে পরিসংখ্যান পদ্ধতির বিকল্প নেই। ব্যক্তিজীবন ও সমা জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে পরিসংখ্যানের গুরুত্ব অনেক।