পরিসংখ্যান কী? পরিসংখ্যানের বৈশিষ্ট্য, প্রকৃতি ও পরিধি সম্পর্কে আলোচনা কর

পরিসংখ্যান কী? পরিসংখ্যানের বৈশিষ্ট্য, প্রকৃতি ও পরিধি সম্পর্কে আলোচনা কর

পরিসংখ্যান কাকে বলে? পরিসংখ্যানের বৈশিষ্ট্য, প্রকৃতি ও পরিধি সম্পর্কে লিখ

ভূমিকা: অতি প্রাচীনকাল হতে পরিসংখ্যানের যাত্রা শুরু হয়েছে। অর্থাৎ, যেদিন থেকে মানবগোষ্ঠী ভাষা ব্যবহার করে আসছে সেদিন থেকেই পরিসংখ্যানের ব্যবহৃত হয়ে আসছে। বর্তমানে পৃথিবীয় বিভিন্ন দেশের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রার সাথে পরিসংখ্যানের ব্যাপক ব্যবহার লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বর্তমানে পরিসংখ্যান বলতে বিভিন্ন কলাকৌশল বা পদ্ধতির সমন্বয়ে এমন একটি বিজ্ঞানকে বুঝায় যা সংখ্যা যা রাশি তথ্য নিয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খ আলোচনা করে।

পরিসংখ্যান কাকে বলে পরিসংখ্যানের বৈশিষ্ট্য, প্রকৃতি ও পরিধি সম্পর্কে লিখ

পরিসংখ্যানঃ ইংরেজি statistics এর বাংলা প্রতিশব্দ হলো পরিসংখ্যান। এর অর্থ হলো সংখ্যাত্মক তথ্য বা সংখ্যা নিয়ে গবেষণা বিজ্ঞান। এটি ল্যাটিন শব্দ status, ইতালীয় শব্দ statista বা জামনি শব্দ statistic হতে উদ্ভূত হয়েছে।

এক বচন অর্থে পরিসংখ্যানঃ একবচন অর্থে পরিসংখ্যান হলো তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লষণের পদ্ধতি। অর্থাৎ, বিজ্ঞানের একটি শাখা হিসেবে পরিসংখ্যান যখন কোন বিষয়ের উপর তথ্য সংগ্রহ, বিশ্লেষণ ও উপস্থাপনের পদ্ধতি নির্দেশ করে তখন তাকে একবচন অর্থে পরিসংখ্যান হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়।

বহুবচন অর্থে পরিসংখ্যান: বহুবচন অর্থে পরিসংখ্যান হলো কোন বিষয় না ঘটনার সংখ্যাতাত্ত্বিক বর্ণনা। যেমন- একটি জনসংখ্যার আকার, এর জন্ম ও মৃত্যুর হার ও পরিমাণ ইত্যাদি।

প্রামাণ্য সংজ্ঞাঃ বিভিন্ন পরিসংখ্যানবিদগণ বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে পরিসংখ্যানের বিভিন্ন সংজ্ঞা প্রদান করেছেন। নিম্নে সেগুলো আলোচনা করা হলো।

অধ্যাপক এইচ স্যাকরিস্ট (Prof. H. Secrist) বলেন, পরিসংখ্যান বলতে আমরা কোন পূর্বনির্ধারিত উদ্দেশ্যে প্রণালিবদ্ধভাবে যুক্তিসংগত মান অনুসারে সংখ্যায় প্রকাশিত গণনাকৃত এবং বহুবিধ কারণ দ্বারা লক্ষণীয় মাত্রায় প্রভাবিত তথ্যবলির সমষ্টিকে বুঝে থাকি।

ড. বাউলি (Dr. A. L. Bowley) তাঁর 'An Elementary Manual of statistics' গ্রন্থে পরিসংখ্যাসের সংজ্ঞা নিতে গিয়ে উল্লেখ করেন Statistics are numerical statements of facta in any department of enquiry placed in relation vo each olicy অর্থাৎ, পরিসংখ্যান হলো যে কোন অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে প্রাপ্ত তথ্যের সংখ্যাত্মক বর্ণনা।

ওয়েবস্টার (Webster) এর মতে, "পরিসংখ্যান হলো কোন দেশের জনসাধারণের অবস্থা সম্পর্কিত শ্রেণিবদ্ধ তথ্যাবলি, বিশেষ করে যে তথ্যাবলি সংখ্যায় অথবা সংখ্যার সারণি বা শ্রেণিবিন্যাসকৃতভাবে সাজিয়ে প্রকাশ করা যায়।

জন সি রাচ (John C. Ruch) পরিসংখ্যান সম্পর্কে বলেন, The numerical procedures that allow phenomena to be measured and results compared are called statistics অর্থাৎ, পরিসংখ্যান হলো সেই সংখ্যাবাচক প্রক্রিয়া যা ঘটনার পরিমাপ এবং ফলাফল তুলনা করে।

রুনিয়ন এবং কোলম্যান (Runyon and Coleman) বলেন, "Statistics is the process of collecting data ina systematic mannet examining thuse data and making inferetices from those data অর্থাৎ, পরিসংখ্যান হলো নিয়মতান্ত্রিকভাবে উপাত্ত সংগ্রহ, উপাত্ত যাচাই এবং উপাত্ত থেকে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার প্রক্রিয়া।

অধ্যাপক ডঃ এ কে এম নূর উন নবী তার সামাজিক পরিসংখ্যান পরিচিতি গ্রন্থে বলেন, পরিসংখ্যান হলো উপায় সংগ্রহ, সুসংবদ্ধকরণ সংক্ষিপ্তকরণ, উপস্থাপন, বিশ্লেষণ এবং উক্ত বিশ্লষণের ভিত্তিতে যথাযথ উপসংহার প্রণয়ন ও যৌক্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিসমূহের নিয়মবন্ধ পাঠ।

উপসংহার: উপর্যুক্ত সংজ্ঞা ও আলোচনা থেকে পরিসংখ্যান বলতে আমরা বুঝি যা কোন জনসমষ্টি যা বস্তুসমষ্টি সর্ম্পকে সংখ্যার দ্বারা নির্দেশযোগ্য কতকগুলো তথ্য বা ঘটনার সপ্তাহ ও শ্রেণিকরণের কাজে নিযুক্ত থাকে এবং এর সাহায্য সংখ্যায় প্রকাশযোগ্য নতুন তথ্যের উপর আলোকপাত করে। তবে আমরা বলতে পারি পরিসংখ্যানের উপযুক্ত সংজ্ঞাসমূহ কোনভাবে স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়।

পরিসংখ্যানের বৈশিষ্ট্যগুলো লিখ

পরিসংখ্যান হলো তথ্য সংগ্রহ, বিশ্লেষণ পদ্ধতি এবং কৌশলের বিজ্ঞান। এর কতিপয় স্বকীয় বৈশিষ্ট্য রয়েছে। পরিসংখ্যানবিদদের থেকে এর নিম্নলিখিত বৈশিষ্ট্যগুলো পাওয়া যায়। যেমন-

১. পরিসংখ্যানে সংখ্যাত্মক প্রকাশ আবশ্যকঃ পরিসংখ্যানে কোনো গুণবাচক তথ্যকে পরিসংখ্যান হিসেবে গণ্য করা যায় না। এটি অবশ্যই সংখ্যাবাচক হতে হবে। যেমন কোনো শিক্ষ প্রতিষ্ঠানের পরীক্ষার্থীদের ফলাফল ভালো, এটি কোনে পরিসংখ্যান হবে না। যদি বলা হয় গাসের হার ৮০টি বা ৬০% বা ৭০% তাহলে এটি পরিসংখ্যান হবে।

২. পরিসংখ্যান একাধিক ঘটনার সমষ্টিঃ একটি বিচ্ছিন্ন সংখ্যাকে পরিসংখ্যান বলা যাবে না। কিন্তু একাধিক সংখ্যাকে পরিসংখ্যান বলা যায়। যেমন- একজন ছাত্রের উচ্চতা দুই এটি কোনো পরিসংখ্যান হলো না। যদি বলা যায়, একাটি ছাত্রের গড় উচ্চতা ৬ ফুট, তাহলে এটি পরিসংখ্যান হয়।

৩. পরিসংখ্যানের অনুসন্ধান কোনো একটি নির্দিষ্ট ক্ষেত্রের সাথে সম্পর্কযুক্ত হতে হবেঃ পরিসংখ্যানের উদ্দেশ্য পূর্বনির্ধারিত হতে হবে এবং সেই উদ্দেশ্য সাধনের জন্য অনুসন্ধান ক্ষেত্র হতে সংখ্যাত্মক তথ্য সংগ্রহ করতে হবে, তাহলে তাকে পরিসংখ্যান বলা যাবে।

৪. পরিসংখ্যান তথ্য অনেক কারণ দ্বারা প্রভাবিত হয়ঃ পরিসংখ্যান এমন একটি বিষয় যা ঘটনায় সমতি এবং আরক শক্তির ঘাত প্রতিঘাতে প্রভাবিত হয়ে থাকে। যেমন ধানের উৎপাদন সাত, পানি, আলো, আবহাওয়া, পরিচর্যা ইত্যাদি কারণ দ্বারা প্রভাবিত হয়।

৫. সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও সাধারণীকরণঃ পরিসংখ্যান অধ্যায়নের ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত গ্রহন করে। এটি প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করে এবং সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও সাধারণীকরণ করে থাকে।

পরিসংখ্যানের প্রকৃতি ও পরিধি সম্পর্কে আলোচনা কর।

পরিসংখ্যানের সংজ্ঞা হতে এর প্রকৃতি ও পরিধি সম্বন্ধে ধারণা পাওয়া যায়। প্রাচীনকালে পরিসংখ্যানকে রাজাদের বিজ্ঞান বলা হতো। কিন্তু বর্তমানে মানবজীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে পরিমাপ ও হিসাব নিকাশে প্রধানত মুখ্য ভূমিকা পালন কয়ে। পরিসংখ্যান পদ্ধতির উন্নয়নের সাথে সাথে একে আর শুধু উপাত্ত সংগ্রহের পদ্ধতি হিসেবে চিহ্নিত করা যায় না। বরং এটি উপাত্তের বিশ্লেষণ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের একটি শক্তিশালী পদ্ধতি।

পরিসংখ্যানের প্রকৃতি ও পরিধিঃ রাষ্ট্রীয় কল্যাণের চিন্তা যত বৃদ্ধি পাবে উপযুক্ত পরিকল্পনা প্রণয়নের জন্য এবং তা বাস্ত যায়নের জন্য পরিসংখ্যানের ব্যবহার তত বৃদ্ধি পাবে। যাতায়াত ব্যবস্থা থেকে শুরু করে পরিবার পরিকল্পনা, দ্রব্যমূল্য, উৎপাদন, আয় ব্যয়, লাভ, বিনিয়োগ ইত্যাদির জন্য সরকার পরিসংখ্যানিক পদ্ধতির ব্যবহার করে থাকে। উপযুক্ত জনসংখ্যা প্রীতির জন্য জন্ম, মৃতু, বন্ধন এবং লিঙ্গ অনুসারে জনসংখ্যা বিন্যাস পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রমে পরিসংখ্যান প্রয়োজন। মৃতা পরিসংখ্যান দেখে স্বাস্থ্য কমকর্তারা পয়ঃপ্রণালি উন্নয়ন, চিকিৎসা সুবিধা বৃদ্ধি এবং জনগণকে সচেতন করে তোলার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করাতে পাবেন।

জনসংখ্যা বিষয়ে যে সমস্ত উপাত্তের কথা বলা হয়েছে সেছালা আদমশুমারি বা জীব পরিসংখ্যান থেকে পাওয়া যায়। আদমশুমারি ছাড়াও গৃহ শুমারি, শিল্প গুমারি, কৃষি শুমারি এবং পশু শুমারি পরিচালনা করা হয়। কৃষিক্ষেত্রে বিজ্ঞান ভিত্তিক পরিকল্পনার জন্য কৃষি শুমারির উপাত্ত যথেষ্ট তথ্য সরবরাহ করে থাকে। এ সমস্ত তথ্য উৎপাদন বৃদ্ধির হার থেকে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ধাতে না বাড়ে সে ব্যাপারে পরিকল্পনা প্রণয়নে সাহায্য করে।

কন্নর এর মতে, পরিসংখ্যান হলো উপাত্তের জন্য গাণিতের একটি ফলিত শাখা। সপ্তদশ শতাব্দীতেই গণিত এবং পরিসংখ্যানের ক্রিয়া শুরু হয়েছে। পরিসংখ্যান গণিতের দক্ষিণ হস্তস্বরূণ।

ব্যবসায় বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বা শিল্পের ক্ষেত্রে উৎপাদন, বিনিয়োগ উৎপাদিত পণ্যের বাজারজাতকরণ মাঝে মাঝে পরিবর্তনশীল। ফলে শিল্প বা ব্যবসায় বাণিজ্যের প্রসার করতে হলে এ বিষয় সংক্রান্ত উপাত্ত সল্লাহ ও বিশ্লেষণ করতে হবে। এটা পরিসংখ্যান। পদ্ধতির সাহায্যে করা যায়। আমদানি, করানি, মূল্য নিয়ন্ত্রণ, কর ধার্য করার জন্য উপাত্ত সংগ্রহ সরকারের একান্ত প্রয়োজন, খাদ্যশস্যের আমদানি রপ্তানি কি পরিমাণ হবে তা নির্ধারণের জন্য খাদ্যশস্যের উৎপাদন কটন ব্যবস্থা, চাহিলা ইত্যাদির পরিসংখ্যান জানা থাকতে হয়। কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য সার প্রয়োগ, সাহের কার্যকারিতা, বীজের প্রতাব, সার ও বীজের যৌথ ক্রিয়া, পানি সেচের সুবিধা ইত্যাদি তথ্য জানা একান্ত প্রয়োজন, পরিকল্পিত নিরীক্ষণের সাহায্যে এ সমস্ত উপার সংগ্রহ করা যায়।

উপসংহার: উপরের আলোচনা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, সামাজিক গবেষণার ক্ষেত্রে পরিসংখ্যান একটি অপরিহার্য পদ্ধতি। আর এ দৃষ্টিকোণ থেকে  কৃষি, শিক্ষা জনসংখ্যা, হিসাব নিকাশ, ব্যবস্থাপনা, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, জীববিজ্ঞান, ইতিহাস, দর্শন, অর্থনীতি প্রতিটি ক্ষেত্রেই পরিসংখ্যানের ব্যবহার বা পরিধি বা ক্ষেত্র হতে পারে।

Post a Comment (0)
Previous Post Next Post