পরিসংখ্যানের ক্রমবিকাশ বিশ্লেষণ কর

পরিসংখ্যানের ক্রমবিকাশ বিশ্লেষণ কর

পরিসংখ্যানের ক্রমবিকাশ ব্যাখ্যা কর।

অথবা, পরিসংখ্যানের ক্রমবিকাশ ব্যাখ্যা কর।

ভূমিকা: অতি প্রাচীনকাল হতে পরিসংখ্যানের যাত্রা শুরু হয়েছে। অর্থাৎ, যেদিন থেকে মানবগোষ্ঠী 'ভাষা ব্যবহার করে আসছে। বর্তমানে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রার সাথে পরিসংখ্যানের ব্যাপক ব্যবহার লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বর্তমানে পরিসংখ্যান বলতে বিভিন্ন কলাকৌশল বা পদ্ধতির সমন্বয়ে এমন একটি বিজ্ঞানকে বুঝায় যা সংখ্যা বা রাশি তথ্য নিয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খ আলোচনা করে।

পরিসংখ্যানের ক্রমবিকাশ বিশ্লেষণ কর

পরিসংখ্যানের ক্রমবিকাশঃ আমরা বর্তমানে তথ্য প্রযুক্তির যুগে বসবাস করছি। মানুষ গ্রহ থেকে গ্রহান্তার পাড়ি জমাচ্ছে। নিত্য নতুন প্রযুক্তির উদ্ভাবন করছে। জ্ঞানবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে মানুষ অনেক এগিয়ে গেছে। সবাই সমাজ ও সভ্যতার ক্রমবিবর্তনের ফুল। বিজ্ঞানের একটি শাখা হিসেবে পরিসংখ্যানের গুরুত্ব অনেক। বর্তমানে বিভিন্ন ক্ষেত্রে এর ব্যবহার হচ্ছে। সরকারি, বেসরকারি, অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক প্রভৃতি তথ্য নিয়ে পরিসংখ্যান প্রকাশিত হয়। পরিসংখ্যানের উদ্ভব সুপ্রাচীনকাল থেকেই। বিজ্ঞানীরা বলেছেন, খ্রিস্টের জন্মের ৫০,০০০ বছর পূর্বেও মানুষ পৃথিবীতে বসবাস করত, যেখানে পৃথিবীর বয়াদ বর্তমানে ৫০০ কোটি বছর। মানুষ প্রথম দিকে জীবনধারনের জন্য সম্পূর্ণভাবে প্রকৃতির উপর নির্ভর করত। বিভিন্ন যুগ পেরিয়ে মানুষ বর্তমানে এসেছে। বলা হয়ে থাকে, খ্রিস্টপূর্ব ৫০০ অব্দে বিশ্বসভ্যতার যাত্রা শুরু। আর এ সময় থেকেই পরিসংখ্যানের অগ্রযাত্রা শুরু। আর এ সময় থেকেই পরিসংখ্যানের অগ্রযাত্রা শুরু হয়। রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন হিসাবনিকাশ সংরক্ষণের জন্যই মূলত পরিসংখ্যানের প্রয়োজন হয়। এছাড়াও ধর্মমন্দির নগর পরিকল্পনা সমাধি প্রভৃতি তৈরিতেও এর ব্যবহার হতো। প্রাচীন সভ্যতাসমূহের মধ্যে মিশরীয় সভ্যতাই সর্বগ্রাচীন। খ্রিস্টপূর্ব ৫০০০ অব্দ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ৩২০০ অব্দ পর্যন্ত এ সভ্যতা টিকে ছিল। তারা বিভিন্ন ক্ষেত্রে পরিসংখ্যানের ব্যবহার করত। পরিসংখ্যানের ক্রমবিবর্তন সম্পর্কে নিচে আলোচনা করা হালা


১. খ্রিস্টপূর্বাব্দ ৩০৫০ঃ পিরামিড নির্মাণে তথ্য সংগ্রহের জন্য পরিসংখ্যান ব্যবহার হতো।

২. খ্রিস্টপূর্বাব্দ ২৭০০ঃ সিন্ধু সভ্যতার লোকেরা নগর পরিকল্পনা, বাটখারা তৈরি ও স্কেল তৈরিতে এর ব্যবহার করত।

৩. খ্রিস্টপূর্বাব্দ ২০৫০ঃ বাবিলনীয়য়া চাঁদ পর্যবেক্ষণে এর ব্যবহার করত।।

৪. খ্রিস্টপূর্বাব্দ ১৪০০ঃ মিশরের রাজা দ্বিতীয় রেমেসিস। নীলনদের বন্যায় ভেসে যাওয়া জমি সঠিকভাবে চিহ্নিত করে এর প্রকৃত মালিকের কাছে ফিরিয়ে দিতে এর ব্যবহার করেন।

৫. খ্রিস্টপূর্বাথ ১২০০-৩৩৭ঃ গ্রিকরা ক্রীতদাস, জমিজমা, সৈনা, সামরিক ব্যয় প্রস্তুতিতে এর ব্যবহার করত। খ্রিস্টপূর্ব ৬ষ্ঠ অর্থে বিখ্যাত গণিতবিদ পিথাগোরাস এ সময়ে জন্মগ্রহণ করেন। হয়রত মুসা (আ.) ও হযরত দাউদ (আ) আদমশুমারি ও সামরিক শক্তি নির্ণয়ের জন্য এর ব্যবহার করত।

৬. খ্রিস্টপূর্ব ৪৭৬ পর্যন্তঃ রোমানরা স্থাপত্য নির্মাণ ভূমি, ক্রীতদাস ও সামরিক শক্তি প্রভৃতিতে হিসাব রাখার জন্য এর ব্যবহার করত।

৭. খ্রিস্টপূর্বাব্দ ৩০০ঃ কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে এর কথা বলত হয়েছে।

৮. ৭ম থেকে ১৩ শতাব্দীঃ ৭ম থেকে ১৩শ শতাব্দী পর্যন্ত সময় কালকে সামন্ততান্ত্রিক যুগ বলে অভিহিত করা হয়।এ সময়ে লর্ডদের জমি, ভূস্বামী, কর ও খাজলা ও সাময়িক শক্তি প্রকৃতির হিসাবের জন্য এর ব্যবহার হতো।

৯. ১৬ শতকঃ সম্রাট আকবর ভূমি জরিপ ও আদমশুমারির জন্য এর ব্যবহার করতেন। আইন-ই-আকবরী গ্রন্থে এর প্রমাণ মেলে।

১০. ১৭ শতকঃ ব্যবসা, বাণিজ্য, শিল্পক্ষেত্রের পূর্ব পর্যন্ত হিসাব রাখার জন্য এর ব্যবহার শুরু হয়। মূলত এ সময়ের পূর্ব পর্যন্ত রাজা বাদশারা রাষ্ট্রীয় কার্যেই পরিসংখ্যানের ব্যবহার সীমাবদ্ধ রেখেছিলেন। এ সময় থেকেই রাষ্ট্রীয় কাজের বাইরে পরিসংখ্যানের ব্যবহার শুরু হয়। ইউরোপে বিবাহ, জন্ম, মৃত্যু এসবের পরিসংখ্যান শুরু হয়। প্রোটেস্ট্যান্ট চার্টসমূহ এ সময়ে অবৈধ জন্ম নিরোধের জন্য মুলত এর ব্যবহার করে।

১১. ১৬১২ খ্রিস্টাব্দঃ দৈব ও অপরাধ পরিমাপের জন্য জার্জ অবরেক্ট দৈব ও অপরাধ পরিসংখ্যানের উদ্ভব ঘটান।

১২. ১৬২৩-১৬৬২ খ্রিস্টাব্দঃ ফ্রান্সে প্যাসকেল বিন্দু সমস্যার সমাধানের জন্য সম্ভাবনা তত্ত্বের উদ্ভব ঘটান।

১৩. ১৬৬১ খ্রিস্টাব্দঃ ক্যপসার নিউম্যান মানুষের আয়ুষ্কাল সম্পর্কে বিভিন্ন গাবেষনা পরিচালনা করেন।

১৪. ১৬৫৪-১৭০৫ খ্রিসটাব্দঃ অধ্যাপক জে বার্ণলি সম্ভাবনা তত্ত্বের উপর ব্যাপক গবেষণা চালান।

১৫. ১৮শ শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্তঃ গ্রন্ট, হ্যালি, ছাসমিলচ তাঁদের গুরুত্বপূর্ণ গবেষণাকর্ম পরিচালনা করেন।

১৬. ১৭৪৯ খ্রিস্টাব্দঃ পরিসংখ্যান একটি পূর্ণাঙ্গ ও স্বতন্ত্র বিষয়ের মর্যাদা পায়। আর এ কাজটি সম্পাদনে যিনি সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন তিনি হলেন, ডগফ্রিড এাকেনওয়াল। তিনি ইংরেজি statistics শব্দটি ইতালীয় শব্দ Statista হতে চয়ন করেন। Statista শব্দের অর্থ রাষ্ট্র সংক্রান্ত কার্যকলাপ। প্রথম দিকে 'statistics শব্দটি রাষ্ট্রীয় কার্যকলাপ বুঝাতে ব্যবহৃত হতো। পরবর্তীতে এর ব্যাপকতা বৃদ্ধি পায়।

১৭. ১৭৬১ খ্রিস্টাব্দঃ জে বি ছাসমিলস-এর গবেষণার পথ ধরে Doctrine of Natural order গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়।

১৮. ১৭৯৬-১৮৭৪ খ্রিস্টাব্দঃ এল.এ. জে.কুইটিলেট "Constancy of Great Numbers -এর প্রবর্তন করেন।

১৯. ১৭৪৯-১৮২৭ খ্রিস্টাব্দঃ ল্যাপসাস গাণিতিক সম্ভাবনা তত্ত্বের উপর রচনা প্রকাশ করেন।

২০. ১৮২২-১৯১১ খ্রিস্টাব্দঃ স্যার ফ্রান্সিস গ্যালটন মানুষের বংশগত পরিবর্তন, দৈহিক ও মানসিক বৈশিষ্ট্য গবেষণার জন্য পরিসংখ্যানের ব্যবহার করেন। এ পথ ধরে তিনি নির্ভরণ রেখার ধারণা দেন।

২১. ১৮৭১ খ্রিস্টাব্দঃ ডব্লিউ এস, জেবনস অর্থনৈতিক চলকগুলো বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে পরিসংখ্যান নিয়মসমূহ প্রয়োগ করেন।

২২. ১৮৫৭-১৯০০ খ্রিস্টাব্দ: কার্ল পিয়ারসন X2 টেস্ট সহসম্পাদক বিশ্লেষণ উদ্ভাবন করেন। তিনি এ বিষয়ে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ জার্নাল ও গ্রন্থ রচনা করেন।

২৩. ১৮৯০-১৯৬২ খ্রিস্টাব্দঃ আর এ ফিসারকে পরিসংখ্যানের জনক বলা হয়। তিনি পরিসংখ্যানের কয়েকটি মৌলিক ও গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেন। যার উপর ভিত্তি করে জেনেটিক্স, বায়োমেট্রিক ও কৃষিতে ব্যাপক প্রয়োগ শুরু করেন।

২৪. ১৮৯৩-১৯৭২ খ্রিস্টাব্দঃ প্রশান্ত চন্দ্র মহালানবিশ নমুনা চয়ন এবং নমুনা তথ্যের বিশ্লেষণে ব্যাপক গবেষণা করেন।

২৫. ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দঃ ডব্লিউ এস গসেট student ছদ্মনামে টি টেস্ট এর প্রবর্তন করেন।

  

উপসংহারঃ পরিসংখ্যানের উৎপত্তিলগ্ন থেকে এটি রাষ্ট্র, সমাজ ও অর্থনীতি প্রভৃতি সামাজিক ক্ষেত্রের পাশাপাশি জ্ঞানবিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় ব্যবহৃত হয়ে আসছে। পরিসংখ্যান বলতে এবং এর ক্রমবিকাশ হালো জনসমষ্টি বা বস্তুসমটি সম্পর্কে সংখ্যার দ্বারা নির্দেশযোগ্য কতকগুলো তথ্য বা ঘটনা সংগ্রহ ও শ্রেণিকরণের কাজে নিযুক্ত থাকে। সভ্যতা বিকাশের সাথে সার জ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্রে এর ব্যবহার ব্যাপকতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে।

Post a Comment (0)
Previous Post Next Post