সাক্ষাৎকার গ্রহণের জন্য প্রয়োজনীয় কৌশলসমূহ আলোচনা কর।
ভূমিকা: সাক্ষাৎকার সমাজকর্ম পদ্ধতির এক অন্যতম প্রধান প্রক্রিয়া যা তথ্য সংগ্রহ ও সমস্যা সমাধানের হাতিয়ার। একজন দক্ষ সমাজকর্মীর সাক্ষাৎকার এমন গতিশীল ও স্বতঃস্ফূর্ত হয়ে থাকে যাতে মনে হতে পারে এটি খুবই সাবলীল প্রক্রিয়া। সাক্ষাৎকার এমন একটি আন্তঃক্রিয়ামূলক প্রক্রিয়া যেখানে সামান্য ত্রুটি-বিচ্যুতি সম্পূর্ণ ভুল ফলাফলের দিকে টেনে নিতে পারে। সাক্ষাৎকারের এ শিক্ষা মূলত কতগুলো কৌশলের সমষ্টি। এ কৌশলগুলোর সমন্বিত রূপই সাক্ষাৎকার।
সাক্ষাৎকারের কৌশলসমূহ
'Encyclopedia of Social Work' এ সাক্ষাৎকারের কৌশলকে প্রারম্ভিক ও প্রাথমিক পর্যায়, মধ্যবর্তী বা কার্যক্রম পর্যায়, শেষ পর্যায় প্রভৃতি ভাগ করেছেন। সাক্ষাৎকারের কৌশল সম্পর্কে আরো যারা মতামত ব্যক্ত করেছেন তারা হলেন Annette Garrett, Gordon Hamitton এর. এ. হোসাইন, এম. আলাউদ্দিন প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ। Annette Garrett-এর মতে সাক্ষাৎকারের কৌশল সাতটি।
যথা: ১. পর্যবেক্ষণ (observation)
২. শ্রবণ (listening);
৩. প্রশ্নকরণ (Questioning);
৪. মন্তব্য করা বা কথা বলা (Talking);
৫. ব্যক্তিগত প্রশ্নের উত্তরদান (Answering personal question);
৬. নেতৃত্বদান বা পরিচালনা (leadership or diection);
৭. ব্যাখ্যাকরণ (Interpretation)।
যেকোনো সাক্ষাৎকার তখনই অর্থপূর্ণ হয়ে উঠে যখন সে সাক্ষাৎকার লক্ষ্য অর্জনে সমর্থ হয়। লক্ষ্য কতটা অর্জিত হয়েছে তা নির্ভর করে কতিপয় কলাকৌশলের ওপর।
বিশ্লেষণজ্ঞদের মতামতের ভিত্তিতে সাক্ষাৎকারের কৌশলগুলো আলোচনা করা হলো:
১. গ্রহণ (Acceptance);
২. পর্যবেক্ষণ (Observation);
৩. শ্রবণ (Listening);
৪. কথা বলার পূর্বে শ্রবণ (Listening before skill);
৫. প্রশ্নকরণ (Questioning);
৬. কথা বলা (Talking);
৭. ব্যক্তিগত প্রশ্নের উত্তরদান (Answering personal question)
৮. নেতৃত্ব ও পরিচালনা (leadership & direction);
৯. ব্যাখ্যাদান (Interpretation);
১০. সমাপনী (closing)
নিচে সাক্ষাৎকারের কৌশলগুলো বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হলো:-
১.: সাক্ষাৎকারের প্রথম এবং প্রধান উদ্দেশ্য হলো সমাজকর্মী কর্তৃক সাক্ষাৎপ্রার্থীকে সহজ, সাবলীল ও আন্তরিকতার সাথে গ্রহণ করা। এ অস্থায় সাহায্যার্থী সমাজকর্মীকে বন্ধু, গাইড, চিকিৎসক, ত্রাণকর্তা মনে করে অকপটে সব খুলে বলে। ফলে একদিকে তার ব্যথার ভাব লাঘব হয় অন্যদিকে সমাজকর্মী সাহায্যার্থীর সমস্যার বিষয় ও কারণ সম্পর্কে বাস্তব ধারণা অর্জনের মাধ্যমে সমাধানের সহজ দিকনির্দেশনা দিতে সক্ষম হয়।
২. পর্যবেক্ষণ: সঠিকভাবে অনুধাবন করলে গোটা মানুষকে জানা হয়ে যায়। এ অনুধাবনের জন্য প্রয়োজন সঠিক পর্যবেক্ষণ। সঠিক পর্যবেক্ষণ সঠিক তথ্য সংগ্রহের চাবিকাঠি। পর্যবেক্ষণের ক্ষেত্রে নিম্নলিখিত বিষয়ে প্রতি লক্ষ্য রাখা জরুরি। -কথা বলার ধরন ও স্বর।
-মুখের বচনভঙ্গি খেয়াল করা।
-চোখের ভাষা বোঝার চেষ্টা করা।
-বসার ধরন লক্ষ্য করা।
-হাত, পা নড়াচাড়ার প্রতি খেয়াল করা।
-পোশাকের প্রতি নজর দেওয়া ইত্যাদি।
৩. শ্রবণ : সাহায্যার্থী সমস্যার এমন এক পর্যায়ে উপনীত হন যখন তিনি চান যে তার সমব্যথী ও হিতাকাঙ্ক্ষী ধৈর্য্যসহকারে তার সকল দুঃখ, বেদনা, হতাশা, শুনুক এবং তার ভার লাঘবে সহায়তা করুক বস্তুত সক্রিয় শ্রোতাই সাক্ষাৎকারের ক্ষেত্রে বেশি প্রয়োজনীয়। শ্রোতার বৈশিষ্ট্য নিম্নরূপ- -সাক্ষাৎকার প্রদানকারী বক্তব্যের প্রতি মনোযোগ দেন।
- সাক্ষাৎকার প্রদানকারী চোখে চোখ রেখে কথা শোনেন।
- সাহায্যার্থীর বক্তব্য শোনার চেষ্টা করেন।
- সমাজকর্মীর কথা মনোযোগ দিয়ে শোনে না।
৪. কথা বলার পূর্বে শ্রবণ: সাহায্যার্থীর তার নিজের পূর্বনির্ধারিত ধারণা বা বক্তব্য প্রকাশের সুযোগ পায়। সমাজকর্মী আগে কথা বলতে শুরু করলে সাহায্যার্থীর স্বতঃস্ফূর্ততা বিনষ্ট হয়, তিনি নিরুৎসাহিত হয়ে নিজেকে গুটিয়ে নেন। সমাজকর্মীকে কতকগুলো বিশ্লেষণ দিকে খেয়াল করতে হবে। যেমন-
-ব্যক্তি যেকোনো কথা বলতে চাইলে সমাজকর্মীকে মনোযোগ দিয়ে শুনতে হবে।
-সমাজকর্মীর বেশি কথা বলা যাবে না।
-ব্যক্তি বেশি কথা বললে তাকে নিরুৎসাহিত করা যাবে না।
৫. প্রশ্নকরণ: সাহায্যার্থীর বক্তব্য থেকে তথ্য যখন অপ্রতুল তি হয়ে দেখা দেয় কিংবা তথ্যের শূন্যতা পরিলক্ষিত হয় তখনই প্রশ্নকরণের মাধ্যমে সমাজকর্মী প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। অহেতুক প্রশ্ন করা, জটিল প্রশ্ন করা কিংবা বিব্রত করার মতো প্রশ্ন এক্ষেত্রে সমাজকর্মী এড়িয়ে চলেন। প্রশ্ন বিভিন্ন ধরনের হতে পারে। যেমন-
- মুক্ত প্রশ্নকরণ;
- সীমিত প্রশ্নকরণ;
- একসাথে অনেক প্রশ্নকরণ;
- কেন দিয়ে প্রশ্নকরণ।
৬. কথা বলা বা মন্তব্য করা: সমাজকর্মীর পক্ষ থেকে সাহায্যার্থীর সাথে কথা বলা ও সাক্ষাৎকারের একটি অন্যতম কৌশল। সমাজকর্মী কেবল মাত্র প্রশ্ন করেই তার দায়িত্ব শেষ করতে পারেন। কিন্তু এতে সাহায্যার্থীর সাথে তার সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতা বাধাপ্রাপ্ত হতে বাধ্য। কারণ সাহায্যার্থী শুধুমাত্র প্রশ্নই শুনতে চান না, বরং কিছু কিছু অন্তরঙ্গ কথা, সহানুভূতির কথা, আশ্বাস ও নিরাপত্তার কথা শুনতে চান। সুতরাং এক্ষেত্রে সমাজকর্মীর উচিত লক্ষ্যের সাথে সামঞ্জস্য বজায় রেখে সাহায্যার্থীর ভাষায়, সাহায্যার্থীর সন্তুষ্টি বিধানে কিছু কথা বলা।
৭. ব্যক্তিগত প্রশ্নের উত্তরদান: সমস্যাগ্রস্ত হিসাবে র : সাহায্যার্থীকেই বেশিরভাগ প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে এ প্রতিশ্রুতি নিয়েই তিনি সাক্ষাৎকার অনুষ্ঠানে উপস্থিত হন এবং অধিকাংশ প্রশ্নের উত্তর দিয়েও থাকেন। কিন্তু সম্পর্কের ধারাবাহিকতায় তার মনেও সমাজকর্মী সম্পর্কে বিভিন্ন প্রশ্নের উদ্রেক হয় এবং সে প্রশ্নের জবাবও তিনি পেতে চান। সুতরাং এক্ষেত্রে সমাজকর্মী অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তার সাথে সাহায্যার্থীর প্রশ্নের জবাব দিতে সচেষ্ট হবেন। সমাজকর্মীকে এক্ষেত্রে কিছু কৌশলের আশ্রয় নিতে হবে। যেমন-
-সমাজকর্মীকে প্রথমেই তার পরিচয় তুলে ধরতে হবে;
-ব্যক্তিগত প্রশ্নের উত্তর প্রদানে অন্যের উদাহরণ দিতে হবে।
- ব্যক্তির কিছু গুণের প্রশংসা করতে হবে পেশাগত স্বার্থ অক্ষুণ্ণ রেখে প্রশ্নের জবাব দান।
৮. নেতৃত্বদান ও পরিচালনা: সমাজকর্মী তার মেধা, জ্ঞান, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা দিয়ে সেগুলো উত্তরণ ও বর্জনের মাধ্যমে সাক্ষাৎকার অনুষ্ঠানের অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌছার গুরুদায়িত্ব পালন করেন। তার নেতৃত্বের শিথিলতা ও দুর্বল পরিচালনা গোটা সাক্ষাৎকার প্রক্রিয়াকে ব্যর্থতার গ্লানিতে পরিপূর্ণ করে তুলতে পারে। এক্ষেত্রে সমাজকর্মী নিচের কৌশলগুলোর আশ্রয় নিবেন:
-সমাজকর্ম প্রতিষ্ঠানের সাথে সামঞ্জস্য রেখে আলোচনা বিষয় ঠিক করবেন।
-সাহায্যার্থীর কী ধরনের সাহায্যের প্রয়োজন তা সমাজকর্মী নির্ধারণ করবেন।
-প্রয়োজনে সমাজকর্মী সাহায্যার্থীকে অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানে প্রেরণ করবেন।
- সাহায্যার্থীকে সরাসরি প্রশ্ন করবেন যেন তার অতিরিক্ত কথা বলা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।
৯. ব্যাখ্যাদান: সাহায্যার্থীর আচার-আচরণ, বক্তব্য, দৃষ্টিভঙ্গি, চিন্তা-চেতনা অনেক অসংগতি দেখা দেয়। এসব অসংগতি ও বৈপরীত্য তাকে সমস্যার প্রকৃত স্বরূপ অনুধাবনে বাধাগ্রস্ত করে তোলে। সমাজকর্মীর দায়িত্ব হলো এক্ষেত্রে সহানুভূতির সাথে সব বিষয়ে সুস্পষ্ট ব্যাখ্যাদান করে সমস্যার প্রকৃতি অনুধাবনে সহায়তা এবং করণীয় সম্পর্কে সচেষ্ট করে তোলা।
১০. সমাপনী : একটা সময় উপনীত হয় যখন নির্দিষ্ট সাক্ষাৎকারের সমাপ্তি টানায় প্রয়োজন হয়ে পড়ে। এ পর্যায়ে সমাজকর্মী সাক্ষাৎকারের ফলপ্রসূ দিকগুলো সম্পর্কে সাহায্যার্থীকে সংক্ষেপে অবহিত করতে পারেন। পরবর্তীতে আবার বসার প্রয়োজন হলে সে ব্যাপারে স্থান সময় সম্পর্কে ঐকমত্যে পৌঁছে এবং সবশেষে সাহায্যার্থীর সহযোগীর জন্য তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় নিবেন।
উপসংহার: পরিশেষে বলা যায়, মক্কেলের সমস্যা সমাধানে সাক্ষাৎকার একটি উত্তম হাতিয়ার। সাক্ষাৎকার একটি উত্তম হাতিয়ার। সাক্ষাৎকারকে সফল করে তোলার জন্য এর কৌশল অপরিহার্য উপাদান। তাই সাহায্যার্থীর সার্বিক অবস্থা অনুধাবন করার জন্য সাক্ষাৎকার পদ্ধতির গুরুত্ব অপরিসীম। সমাজকর্মী সাক্ষাৎকারের ব্যবস্থা করবেন।