শ্রমের লৈঙ্গিক বিভাজন কী?
ভূমিকা: সমাজতাত্ত্বিক আলোচনায় একটি বহুল পরিচিত প্রত্যয় হলো শ্রমবিভাজন বা Division of labour. শ্রমবিভাজন বলতে সাধারণত কোনো অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় অংশগ্রহণকারীরা যাতে বিশেষায়িত হতে পারে তার জন্য কাজের পৃথকীকরণকে বুঝায়। তবে মার্কসীয়রা শ্রমবিভাজনকে একটি বিচ্ছিন্নতাবোধ প্রক্রিয়া হিসেবে দেখেন যেখানে বিশেষায়িত শ্রমিকরা বারংবার একই কাজ করার মাধ্যমে উৎপাদন প্রক্রিয়া থেকে সম্পূর্ণরূপে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। শ্রমবিভাজনের দুটি প্রেক্ষিত রয়েছে। একটি হলো শ্রমের সামাজিক বিভাজন এবং অপরটি হলো শ্রমের লৈঙ্গিক বিভাজন।
শ্রমবিভাজন (Division of labour)
সাধারণ অর্থে কোনো অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় অংশগ্রহণকারীরা যাতে বিশেষায়িত হতে পারে তার জন্য কাজের পৃথকীকরণকে শ্রমবিভাজন বা Divison of labour বলে। কিন্তু মার্কসবাদীদের নিকট শ্রমবিভাজন হলো একটি বিচ্ছিন্নতাবোধ প্রক্রিয়া (A process of alienation) যেখানে বিশেষায়িত শ্রমিকরা বারবার একই কাজ করার মাধ্যমে উৎপাদন প্রক্রিয়া থেকে সম্পূর্ণরূপে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এই প্রক্রিয়ায় শ্রমিকরা পুরোপুরি যন্ত্ররূপে আবির্ভূত হয়।
শ্রমের লৈঙ্গিক বিভাজন (Sexual Division of labour)
মার্কসের শ্রমের লৈঙ্গিক বিভাজন তত্ত্বটি নারীবাদের একটি শাখা। যা মনে করে ব্যক্তিগত ও পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় লৈঙ্গিক শ্রমবিভাজনের ফলে নারীরা নির্যাতিত। মার্কসীয় নারীবাদী ফার্গুনসন এ সম্পর্কে বলেন, "Women liberation can only be achieved through a radical restructuring of the current capitalist economy, in which much of women is labour is uncompensated." অর্থাৎ, বর্তমান পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে মহিলাদের শ্রমটি প্রতিদানহীন বা অপরিশোধিত। তাই নারীমুক্তি অর্জিত হতে পারে একমাত্র বর্তমান পুঁজিবাদী অর্থনীতির বৈপবিক পুনর্গঠনের মাধ্যমে। শ্রমের লৈঙ্গিক বিভাজন বুঝার ক্ষেত্রে এর তাত্ত্বিক দিক এবং উৎপাদনশীলও পুনরুৎপাদনশীল শ্রম সম্পর্কে জানা প্রয়োজন। এই দুটি বিষয় আলোচনার মাধ্যমে নীচে শ্রমের লৈঙ্গিক বিভাজনের আলোচনা তুলে ধরা হলো:
তাত্ত্বিক পটভূমি (Theoritical background)
কার্ল মার্কস ও Frederick Engels কর্তৃক রচিত, 'The Communist Manifesto' (1848) এবং মার্কস কর্তৃক রচিত 'A contribution to the critique of political economy' (1859)-এর লেখনী লৈঙ্গিক শ্রমবিভাজন তত্ত্বের ভিত্তিভূমি রচনা করেছেন। এখানে তারা ঐতিহাসিক বস্তুবাদ (Historical Materialism), পুঁজিবাদ, লৈঙ্গিক শ্রমবিভাজন ও নির্যাতন এ তিনটি প্রত্যয়ের মধ্যে সম্পর্কের উপর আলোকপাত করেছেন।
মার্কসের ভাষায়, "Historical materialism recognizes the ways in which economic systems structure society as a whole and influence eveyday life and experiences." অর্থাৎ ঐতিহাসিক বস্তুবাদ সেই ধরনকে উপলব্ধি করে যেখানে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা সার্বিক সমাজ গঠন করে এবং প্রতিদিনের জীবন এবং অভিজ্ঞতাকে প্রভাবিত করে।
ঐতিহাসিক বস্তুবাদ সমাজের মৌল কাঠামো নির্ধারণের ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত অনুঘটকগুলোর ভূমিকার উপর বিশাল গুরুত্বারোপ করেছেন। মৌল কাঠামো এমন কতকগুলো প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা তৈরি করে যা শ্রমিক শ্রেণিকে শোষণের মাধ্যমে ক্ষমতাশীলদের স্বার্থকে এগিয়ে নিয়ে যায়। লেনিনের ভাষায় "These systems are set by the ruling class in accordance with their need to maintain on increasse class conflict in order to remain in power." অর্থাৎ, এই ব্যবস্থা শাসক গোষ্ঠীর ক্ষমতায় থাকা বা শ্রেণিসংগ্রামের বৃদ্ধির মাধ্যমে ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য শাসকগোষ্ঠীর দ্বারা স্থাপিত ব্যবস্থা। তবে মার্কসবাদীরা মনে করে শ্রমিক শ্রেণির সেই সামর্থ্য আছে এ কাঠামোর পুনর্গঠন করে নতুন শাসক শ্রেণির ক্ষমতায়ন করার।
এ সম্পর্কে লেনিন বলেন, "The organization of social consciousness by a vanguard party is vital to the working class revolutionary process." অর্থাৎ সামাজিক সচেতনতা গড়ে উঠে Vanguard Party-এর মাধ্যমে যা শ্রমজীবী শ্রেণির বৈপবিক প্রক্রিয়ায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
এঙ্গেলস বলেন, সামন্ততন্ত্র থেকে পরিবর্তিত হয়ে ভূমিতে ব্যক্তিগত মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সাথে সাথে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে নারী পুরুষের কর্মক্ষেত্র আলাদা হয়ে গেল এবং সামঞ্জস্যহীনভাবে মজুরি শ্রমে নারীদের বাদ দিয়ে পুরুষদের প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করা হলো। এঙ্গেলস আরো বলেন, জৈবিক কারণে নয় বরং সামাজিক সম্পর্কের কারণে নারীরা পুরুষের অধীনস্থ। একক পরিবারের আবির্ভাবের মাধ্যমে নারীদের শ্রমকে নিয়ন্ত্রণ করার পুরুষদের প্রচেষ্টাগুলো প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করলো।
ফার্গুনসনের ভাষায়, "Gender oppression is closely related to class oppression and the relationship between men and women in society is similar to the relationship between proletariat and bourgeoisie." অর্থাৎ, "জেন্ডার নিপীড়ন সামাজিক নিপীড়নের সাথে গভীরভাবে জড়িত এবং সমাজে নারী পুরুষের মধ্যকার সম্পর্ক অনেকটা প্রলেতারিয়েত বুর্জোয়া সম্পর্কের মতো।"
উপসংহার: উপর্যুক্ত আলোচনা পরিশেষে বলা যায় যে, শ্রমের লৈঙ্গিক বিভাজন নারীর প্রতি বৈষম্য ও নির্যাতনের অপর নাম। জৈবিক নয়, বরং সামাজিক সম্পর্কের কারণে নারীদেরকে পুরুষের অধীনস্ত করে রাখা হয় এবং তাদেরকে গৃহের অভ্যন্তরে পুনরুৎপাদনশীল কর্মে নিযুক্ত করা হয় যার কোনো আর্থিক মূল্য বা স্বীকৃতি থাকে না। নারীর শ্রমের লৈঙ্গিক বিভাজনকে মার্কসবাদীরা ও নারীবাদীরা নারী শোষণের ভিত্তি বলে মনে করেন। বস্তুত শ্রমের লৈঙ্গিক বিভাজন নারী পুরুষের কর্মক্ষেত্রকে পৃথক এবং সকল ক্ষেত্রে পুরুষের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত করেছে।
সামাজিক ও লৈঙ্গিক শ্রমবিভাজনের মধ্যে পার্থক্য লিখ।
ভূমিকা: সাধারণ অর্থে কোনো অর্থনৈতিক ব্যবস্থার অংশগ্রহণকারীরা যাতে বিশেষায়িত হতে পারে তার জন্য কাজের -পৃথকীকরণকে শ্রম বিভাজন বলে। মার্কসবাদীদের নিকট শ্রম বিভাজন হলো একটি বিছিন্নতাবোধ প্রক্রিয়া যেখানে বিশেষায়িত - শ্রমিকরা, বারংবার একই কাজ করার মাধ্যমে উৎপাদন প্রক্রিয়া থেকে সম্পূর্ণরূপে বিচ্ছিন্ন হয়ে যয়। সামাজিক ও লৈঙ্গিক শ্রম বিভাজন শ্রমবিভাজনের দুটি প্রেক্ষিত।
সামাজিক ও লৈঙ্গিক শ্রমবিভাজনের মধ্যে পার্থক্য
সাধারণত নিম্নলিখিত বিষয়াবলির দৃষ্টিকোণ থেকে সামাজিক ও লৈঙ্গিক শ্রমবিভাজনের মধ্যে পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়।
ক. সংজ্ঞাগত পার্থক্য: শিল্প, ব্যবসালয় ও শ্রমিকের পেশার মধ্যে বিভক্ত, বিশেষায়িত পণ্য উৎপাদনের সামাজিক কাঠামোগত ভিত্তি হলো শ্রমের সামাজিক বিভাজন। শ্রমের সামাজিক বিভাজন সম্পর্কে ম্যান্ডেল (Mandel) বলেন, "Social division of labour, one of the two aspects of the division of labour is the social structural foundation of the specialized commodity production divided between industries, firms and occupations of workers or the technical division of tasks."
অপরপক্ষে, শ্রমের লৈঙ্গিক বিভাজন বা লৈঙ্গিক শ্রমবিভাজন মার্কসীয় দৃষ্টিকোণ বিবেচনায় নারীবাদের একটি শাখা, যা মনে করে, ব্যক্তিগত ও পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় লৈঙ্গিক শ্রমবিভাজনের ফলে নারীরা নির্যাতিত।
খ. তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গিগত পার্থক্য: নিচে শ্রমের সামাজিক ও লিঙ্গভিত্তিক বিভাজনের তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গির উল্লেখ করা হলো:
i. শ্রমের সামাজিক বিভাজন শ্রমের সামাজিক বিভাজন বুঝতে হলে দুইটি বিষয় সম্পর্কে জানা প্রয়োজন। বিষয় দুটি হলো সম্পত্তি বনাম শ্রম এবং শ্রেণিসংগ্রাম।
সম্পত্তি বনাম শ্রম: মার্কস সবসময় নিখুঁত একটি সমাজের স্বপ্ন দেখতেন। তিনি বলেন, এ পৃথিবীতে পূর্বে মানুষ বিচ্ছিন্নতা অনুভব করেনি। কারণ, তখন বিচ্ছিন্ন উৎপাদন ছিল না। শ্রমের সামাজিক বিভাজনের মাধ্যমে মানুষ যখন বিচ্ছিন্ন উৎপাদন। ব্যবস্থায় পতিত হলো তখনই এই সমাজে ব্যক্তিগত সম্পত্তির জন্ম হলো। সময়ের পরিক্রমায় মানুষ স্বীয় স্বার্থে অন্যের শ্রমের পণ্যকে আত্মসাৎ করতে লাগল। এভাবে একজন মানুষের স্বহস্তে তৈরি পণ্যই তাকে অন্যের দাসে পরিণত করতে লাগল। শ্রমের সামাজিক বিভাজনের মাধ্যমে গড়ে উঠা বিচ্ছিন্ন শ্রম ব্যবস্থায় মানুষের জীবনীশক্তি হরণ করতে লাগল।
শ্রেণি সংগ্রাম : কার্ল মার্কসের শ্রমবিভাজন তত্ত্ব
উল্লেখযোগ্যভাবে রুশোর শ্রমবিভাজন তত্ত্বের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। উভয়ের যুক্তি হলো ব্যক্তিগত সম্পত্তির আকাঙ্ক্ষা সমাজকে শ্রমবিভাজনের দিকে ধাবিত করে, শ্রমবিভাজনের মাধ্যমে অর্থনৈতিক বৈষম্য, সৃষ্টি হয়। আর অর্থনৈতিক বৈষম্যের ওপর ভিত্তি করেই পৃথক সামাজিক শ্রেণির অস্তিত্ব জন্মলাভ করে। আর বুর্জোয়া শ্রেণির স্বার্থরক্ষা বা আধিপত্য বজায় রাখার যন্ত্র হিসেবে রাষ্ট্রের জন্ম। দ্বান্দ্বিকতার মাধ্যমে, সর্বহারার বিপ্লব সংঘটিত হলে সর্বহারা বুর্জোয়া পুঁজিবাদের শেষ চিহ্নটুকু ধ্বংস করতে রাষ্ট্রকে ব্যবহার করবে। শ্রমবিভাজন উঠে যাবে এবং পুঁজিবাদের শেষ চিহ্নটুকু থাকবে না এবং রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে যাবে।
ii. শ্রমের লৈঙ্গিক বিভাজন: বর্তমান পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে মহিলাদের শ্রমটি প্রতিদানহীন বা অপরিশোধিত। তাই নারীমুক্তি অর্জিত, হতে পারে একমাত্র বর্তমান পুঁজিবাদী অর্থনীতির বৈপ্লবিক পুনর্গঠনের মাধ্যমে। পুঁজিবাদী সমাজে বিদ্যমান উৎপাদনশীল ও পুনরুৎপাদনশীল শ্রম দুটোই অপরিহার্য। পুনরুৎপাদশীল শ্রম ব্যক্তিগত পর্যায়ের সাথে সংশ্লিষ্ট এবং এমন বিষয়কে অন্তর্ভুক্ত করে যা নিজের জন্য মানুষকে করতেই হয়। এ ধরনের কাজ মজুরি লাভের উদ্দেশ্য করা হয় না। উভয় ধরনের শ্রমই প্রয়োজনীয় কিন্তু ব্যক্তিগত পরিচয়ের ভিত্তিতে এ ধরনের শ্রমে মানুষের প্রবেশাধিকার ভিন্ন ভিন্ন পুঁজিবাদী ব্যবস্থা নারীদের আবদ্ধ করে রেখেছে যেখানে শ্রম পুনরুৎপাদনশীল বিনিময়হীন ও অস্বীকৃত। অন্যদিকে, পুঁজিবাদ উৎপাদনশীল শ্রমে। পুরুষদের একচেটিয়া প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করেছে। এভাবে শ্রমের লৈঙ্গিক বিভাজন হলো সরকারি ও বেসরকারি স্বার্থে শ্রম শোষণের একটি সস্তা পদ্ধতি।
উপসংহার: উপর্যুক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে একথা বলা যায় যে, সামাজিক শ্রমবিভাজন ও লৈঙ্গিক শ্রমবিভাজন শ্রমবিভাজনের দুইটি প্রকরণ। দৃষ্টিভঙ্গীর দিক থেকে এ দুই প্রকারের শ্রমবিভাজনের মধ্যে পার্থক্য বিদ্যমান। শ্রমের সামাজিক বিভাজন মূলত বুর্জোয়া শ্রেণি তাদের স্বার্থে করে থাকে এবং এই বিভাজনের মাধ্যমে তারা অর্থনৈতিকভাবে শ্রমিকদের শোষণ করে। অন্যদিকে শ্রমের লৈঙ্গিক বিভাজন নারী পুরুষের কর্মক্ষেত্রকে পৃথক করে এবং সকল ক্ষেত্রে পুরুষের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে।