মার্কসের 'কমিউনিস্ট মেনিফেস্টোর' কি? মার্ক্সীয় বস্তুবাদ ও হেগেলীয় ভাববাদের পার্থক্য তুলে ধর।
ভূমিকা: আধুনিক সমাজতন্ত্রের প্রবক্তা হলেন কার্ল মার্কস। তিনি তার জীবনের অধিকাংশ সময় ব্যয় করেছেন শ্রমিক শ্রেণি ও নিপীড়িত মানুষের মুক্তির চিন্তা করে। তিনি গ্রন্থ ও গবেষণা পত্র রচনা করেছেন। তার এসব কাজে প্রধান সহযোগী ছিলেন ফ্রেডরিক এঙ্গেলস। মার্কস ও এঙ্গেলস প্রবর্তিত আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়েই রাশিয়াসহ পূর্ব ইউরোপ, চীন, উত্তর কোরিয়া, ল্যাটিন আমেরিকা প্রভৃতি দেশে বা অঞ্চলে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। মার্কস এর Communist Manifesto-কে সমাজতন্ত্রের সংবিধান হিসেবে গণ্য করা হয়।
Communist Manifesto এর পরিচয়
Communist manifesto হলো একটি বই যেটি কার্ল মার্কস এবং এঙ্গেলস যৌথভাবে ১৮৪৮ সালে ফেব্রুয়ারি মাসে প্রকাশ করেন। একই বছর জুলাই মাস থেকে এটি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়।
কমিউনিস্ট মেনিফেস্টো গ্রন্থটির গুরুত্ব
১৮৪৭ সালে Communist league এর ইশতেহার হিসেবে এটি প্রকাশিত হয়। আকারে গ্রন্থটি খুবই ছোট হলেও এর গুরুত্ব ও তাৎপর্য সুবিশাল। প্রথমত ১৮৪৭ সালে সমগ্র ইউরোপে এটি ছিল বিপ্লবের সময়। অন্যদিকে এই গ্রন্থ প্রকাশের সাথে সাথে সারা পৃথিবীর সমাজতান্ত্রিকদের আন্দোলনের হাতিয়ার হয়ে দাঁড়ায়।
গ্রন্থের বিষয়বস্তু: ১৮৪৭ সালে Communist league এর ইশতেহার হিসেবে এটি প্রকাশিত হয়। গ্রন্থের শুরুতেই মার্কস ও এঙ্গেলস পৃথিবীর শ্রমিক শ্রেণিকে একত্র হওয়ার আহ্বান জানান। 'দুনিয়ার মজদুর এক হও' এই শ্লোগানকে সামনে রেখে বলা হয় যে পৃথিবীতে যে সমাজব্যবস্থা গড়ে উঠেছে তার ইতিহাস মূলত শ্রেণি সংগ্রামের ইতিহাস। মার্কস ও এঙ্গেলস দর্শনের দ্বন্দ্ব তত্ত্বকে গ্রহণ করেছেন এবং নিজেদের মতো করে ব্যাখ্যা করেছেন। এ গ্রন্থে বলা হয় আদর্শের সংঘাত নয় বরং শ্রেণি সংঘাতই ইতিহাসকে পরিচালিত করে। সমাজ ব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটে উৎপাদন পদ্ধতির কারণে, কোনো আদর্শিক সংঘাতের কারণে নয়। তারা এই গ্রন্থের মাধ্যমে পৃথিবীর দরিদ্র মানুষকে সংগঠিত হয়ে পুঁজিবাদীদের ক্ষমতা কেড়ে নেওয়ার কথা বলেন।
উপসংহার: পৃথিবীর আলোড়ন সৃষ্টিকারী গ্রন্থসমূহের মধ্যে Communist manifesto অন্যতম। আকারে ছোট হলেও এই গ্রন্থ প্রকাশের পর পরই সারা পৃথিবীতে আলোড়ন সৃষ্টি করে। এটা সমাজতান্ত্রিকদের আন্দোলনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়। মার্কস ও এঙ্গেলস এ গ্রন্থের মাধ্যমে পৃথিবীর দরিদ্র মানুষদেরকে একত্রিত হয়ে সর্বহারাদের একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠার আহ্বান করেন। পাশাপাশি পুঁজিবাদীদের থেকে ক্ষমতা গ্রহণ এবং উৎপাদন ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ গ্রহণেরও আহ্বান জানানো হয়।
মার্ক্সীয় বস্তুবাদ ও হেগেলীয় ভাববাদের মধ্যে পার্থক্য।
ভূমিকা- দ্বান্দ্বিক পদ্ধতি মার্কসীয় চিন্তাধারায় গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে বিবেচিত। 'A Dictionary of Marxist Thought গ্রন্থে টম বটোমোর বলেন, "দ্বান্দ্বিক পদ্ধতি প্রত্যয়টি প্রথম ব্যবহার করেন প্লেখানভ তবে দ্বান্দ্বিক প্রক্রিয়ার কথা প্রথমে বলেন জার্মান দার্শনিক হেগেল। পরবর্তীতে কার্ল মার্কস হেগেলের চিন্তাধারার বিশেষ করে দ্বান্দ্বিক প্রক্রিয়া যারা অনুপ্রাণিত হয়ে দ্বান্দ্বিক প্রক্রিয়া এক নয়। একথা মার্কস নিজেও বলেছেন, আমরা দ্বন্দ্বমূলক পদ্ধতি হেংগলীয় পদ্ধতি থেকে কেবল স্বতন্ত্রই নয় বরং তাঁর বিপরীত।" মার্কস হেগেলের নিকট থেকে দ্বান্দ্বিক প্রক্রিয়ার সূত্র গ্রহণ করেছেন তবে তাঁর ভাববাদী ব্যাখ্যা গ্রহণ করেননি। বরং মার্কস দ্বান্দ্বিক পদ্ধতির বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা উপস্থাপন করেছেন।
বস্তু ও ভাববাদ: বিশ্ব ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে দুটি গুরুত্বপূর্ণ অভিমত হলো বস্তুবাদ ও ভাববাদ। মানুষের চেতনার বিকাশের আসিকাল থেকে এ দুই মতবাদের দ্বন্দ্ব চলে আসছে। বস্তুবাদকে দুইভাবে ভাগ করে বিবেচনা করা হয়। সাধারণ বস্তুবাদ ও দার্শনিক বস্তুবাদ। সাধারণ বস্তুবাদ বলতে জগৎ সম্পর্কে সাধারণ মানুষের মতবাদ বুঝায়। চারপাশের জগৎ সত্য না মিথ্যা, মায়া না যথার্থ এ সম্পর্কে মানুষের মনে আদিকাল থেকেই প্রশ্ন জেগেছে। সাধারণ মানুষ গভীর যুক্তিতর্ক ব্যতিরেকেই জীবনযাপনের বাস্তব প্রয়োজনে জগৎ এবং বাস্তবতাকে সত্যা বলে মেনে নেয়। এ সাধারণ বস্তুবাদের বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ ঘটেছে দার্শনিক বস্তুবাদ।
অন্যদিকে ভাববাদ জগৎ ব্যাখ্যার এমন এক পদ্ধতি যা বস্তুর তুলনায় আত্মা বা চৈতন্যকে আদি মনে করে। ভাববাদ মনে করে সমস্ত বস্তুই আত্মা জাতীয় কিছুর নির্ণায়ক। ভাববাদ মূলত ধর্ম বা ঈশ্বরতত্ত্ব। লেনিন বলেছেন- ভাববাদ হলো যাজকতন্ত্র। বিশেষ কোনো ভাববাদী তত্ত্ব ধমের খোলস ত্যাগ করলেও সমস্ত ভাববাদই বিভিন্ন প্রশ্নে ধর্মীয় দৃষ্টিএডির অনুবর্তন মাত্র। কুসংস্কার অতিপ্রাকৃত। গুপ্ত রহস্য ও জ্ঞানাতীত কিছুতে বিশ্বাস, আর ভাববাদ অবিচ্ছেদ্য। অতএব ধর্ম ও ভাববাদের মূল একই।
বস্তুবাদ ও ভাববাদের পার্থক্য:
১. বস্তুবাদ ভাববাদের পরিপন্থি কারণ ভাববাদ যেখানে আত্মা বা মানসকে বস্তুর আগে স্থান দেয়। বস্তুবাদ সেখানে বস্তুাকই প্রধান বলে স্বীকার করে।
২. ভাববাদ একটি রক্ষণশীল ও প্রতিক্রিয়াশীস শক্তি। অন্যদিকে বস্তুবাদ যৌক্তি ও বাস্তববাদসম্মত ধারণা। বাস্তুবাদ প্রতিটি প্রশ্নকে বিচার করা, অনুধাবন করা ও ব্যবস্থা করার একটি উপায়।
৩. ভাববাদ মূলত ধর্ম বা ঈশ্বরতত্ত্ব। কুসংস্কার অতিপ্রাকৃত, রহস্য ও জ্ঞানাতীত কিছুতে বিশ্বাস ভাববাদের আলোচ্যবিষয়। পক্ষান্তরে বাস্তব জীবনের যে সব বিষয়বস্তু আমরা যাচাই করে নিতে পারি, বুঝতে পারি ও নিয়ন্ত্রণ করতে পারি। বস্তুবাদ তাদের সাহায্যেই বিশ্লেষণ ও ব্যাখ্যা করে।
৪. ভাববাদ মনে করে সবসময়েই একটি উচ্চতর আয়ো বেশি বাস্তব ও অবস্তুময় জগতের অস্তিত্ব আছে যা চূড়ান্ত উৎস ও কারণ আছে। যার দ্বারা মন্ত্রময় জগৎ নিয়ন্ত্রিত। অন্যদিকে বস্তুবাদ মনে করে, জগৎ একটাই আর তা হলো বস্তুময় জগৎ।
৫. ভাবধান মূলত দুই জগতে বিশ্বাসী যথা- ভাবগত ও বস্তুগত এবং ভাবজগতে বস্তুজগতের উপর প্রধান স্থান দিয়ে থাকে। অপরদিকে বস্তুজগতে একটি জগৎকেই প্রাধান্য দেয়া হয়। সেটি হলো বাস্তবজগৎ।
৬. ভাববাদ অনুযায়ী বাস্তবয়জগৎ ভাবজগতের উপর নির্ভরশীল। অন্যদিকে, বস্তুবাদের শিক্ষা হলো এ যে, প্রকৃতিগত কারণেই এ বিশ্ব বস্তুময় প্রতিটি জিনিসের উৎপত্তি বাস্তব কারণে এবং প্রতিটি জিনিসের উদ্ভব ও বিকাশ প্রকৃতির গতির নিয়মের অনুগামী।
৭. ভাববাদ মনে করে চৈতন্য অথবা মন অথবা ভাব এর বস্তু থেকে স্বতন্ত্র অস্তিত্ব থাকতে পারে এবং আছে। অন্যদিকে, বস্তুবাদের শিক্ষা হলো এই যে, মনের বাইরে মন নিরপেক্ষ বস্তুর বাস্তব অস্তিত্ব আছে এবং মানসিক ব্যাপার বাস্তব থেকে বিচ্ছিন্ন তা নয়ই বরং যা কিছু আত্মিক বা মানসিক তা বাস্তব প্রক্রিয়ার ফল।
৮. ভাববাদের মতে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা এবং বিজ্ঞানের সাহায্যে আমরা যা জানতে পারি তার উর্ধ্বে একটি রহস্যময় অম্লানা বজগৎ আছে। অন্যদিকে, বস্তুবাদের শিক্ষা হলো বিশ্ব ও তার নিয়ম পুরোপুরি জানান সম্ভব এবং বেশি কিছু জানা না গেলেও এমন কিছু নেই যা প্রকৃতিগত কারণেই অজানা।
উপসংহার: উপর্যুক্ত আলোচনা প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, মার্ক্সীয় বস্তুবাদ ও হেগেলীয় ভাববাদের মধ্যে অনেক পার্থক্য থাকলে এদের মধ্যে এক ধরনের সম্পর্ক বিদ্যমান। এর মাধ্যমে ভাববাদ এবং বস্তুবাদ সম্পর্কে বিশদ জানা সম্ভব হয়।