সামাজিক গবেষণা কাকে বলে? সামাজিক গবেষণার বিভিন্ন স্তর আলোচনা কর।

সামাজিক গবেষণা কাকে বলে? সামাজিক গবেষণার বিভিন্ন স্তর আলোচনা কর।

সামাজিক গবেষণা কী? সামাজিক গবেষণার স্তরসমূহ  

ভূমিকাঃ গবেষণা হলো মূলত বিশেষ ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট বিষয়ের উপর বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি প্রয়োগ। স্বাভাবিকভাবে সামাজিক বিভিন্ন বিষয়ের উপর বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি প্রয়োগের মাধ্যমে কোন সাধারণ নিয়ম পরিস্ফুটনের জন্য পরিচালিত অনুসন্ধান কাজই সমাজিক গবেষণা। ইচ্ছা, উদ্দেশ্য, সামর্থ্য ও সুবিধার পরিপ্রেক্ষিতে গবেষক তার গবেষণার বিষয়, পদ্ধতি, উপকরণ ইত্যাদি নির্বাচন করে থাকেন। এ কারণে একই বিষয়ে অনুসন্ধান কাজে গবেষকদের নির্বাচন ভিন্নতা হয়ে থাকে। ভিন্নতার বিস্তৃতি ও ব্যাপকতা ছাড়াও সমাজ ও কৌশলও নানাবিধ। নতুন নতুন সামাজিক বিষয়ের উপর গবেষণা করার ক্ষেত্রে গবেষকদের নিত্য নতুন কৌশল ও পর্যায়ের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে হয়। এতে কিছু সত্বেও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনুসরণে অনুকল্প পরীক্ষা করার জন্য সকল গবেষণাকেই সাধারণ নিয়ম আবিষ্কারের জন্য প্রত্যেক সমাজ গবেষকই অনুকল্প আকারে তার নির্ধারিত গবেষণা সমস্যা বা বিষয়কে সুনির্দিষ্ট করেন। এর ভিত্তিতে তিনি অনুসন্ধান কাজের একটি প্রাসঙ্গিক নকশাই বা পরিকল্পনা তৈরি করেন যাতে করে প্রয়োজনীয় তথ্য কিভাবে সংগ্রহ বিশ্লেষণ করা সম্ভব হয়।

সামাজিক গবেষণা কাকে বলে? সামাজিক গবেষণার বিভিন্ন স্তর


সামাজিক গবেষণাঃ গবেষণা বলতে সমাজ ও ব্যক্তির বিশ্লেষণকে বুঝায়। সাধারণভাবে বলা যায় যে বিজ্ঞানের যে কোন শাখা-প্রশাখায় বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া বা প্রণালী অনুসরণ করে যে অনুসন্ধান করা হয় তাকেই সামাজিক গবেষণা বলে। অন্যভাবে বলা যায় বৈজ্ঞানিক উপায়ে সমাজ সম্পর্কে বলাকেই সামাজিক গবেষণা বলে।

K.D Bailey তার Methods of social Research গ্রন্থে বলেন- সামাজিক গবেষণা উপাত্ত সংগ্রহের সাথে সম্পৃক্ত বিভিন্ন উপাদান সম্বন্ধে উত্তর দিতে সহায়তা করে।

P.V. Young এর মতে সামাজিক গবেষণাকে সমাজ জীবনের অন্বেষণ, বিশ্লেষণ ও ধ্যানধারনার একটি পদ্ধতিরূপে আখ্যা দেওয়া যেতে পারে, যার উদ্দেশ্য জ্ঞান বিস্তার, সংশোধন ও যাচাই।

B and Champion বলেছেন- বৈজ্ঞানিক গবেষণার মূল উপাদান হচ্ছে অভিজ্ঞতামূলক পর্যবেক্ষণের সাহায্য তথ্য প্রাপ্তি যা বিভিন্ন চলকের মধ্যে কার্যকর সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে যৌক্তিকভাবে সম্পর্কযুক্ত প্রস্তাবনাসমুহের সুশৃংখল উন্নয়নের জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে।

Green এর মতে জ্ঞান অনুসন্ধানের জন্য মানসম্মত পদ্ধতির প্রয়োগককেই গবেষণা হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়।


Earl R. Babbir এর মতে, একটি অনুসন্ধান পদ্ধতি স্যার পাশে জগৎ সম্পর্কে জানার পদ্ধতি।


উপরোক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায়, সামাজিক গবেষণা হলো এমন একটি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি যার মাধ্যমে যুক্তিসঙ্গত ও সুশৃঙ্খলভাবে সমাজের নতুন ঘটনা আবিষ্কার ও অতীত বিষয়ের সভ্যতা নিরূপণ পরীক্ষা করা ও তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক আবিষ্কার, ব্যাখ্যা প্রদান, নতুন বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির ধারণা তথ্য ও পদ্ধতির উদ্বোধন করা ব্যবহারের মূল্যায়ন কর।

সামাজিক গবেষণার বিভিন্ন স্তর আলোচনা কর।

সামাজিক গবেষণার বিভিন্ন স্তর সমূহ নিম্নে আলোচনা করা হলো। 

১। গবেষণা সমস্যা বা বিষয় চিহ্নিতকরণ ও নির্বাচনঃ সামাজিক পরিবেশের প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে নির্বাচন করে তার সংবেদনশীল বিষয়কে গবেষণার সমস্যা বা বিষয় হিসেবে গ্রহণ করা। যেমন জনসংখ্যা সমস্যাকে ক্ষেত্র হিসেবে চিহ্নিত করে পরিবার পরিকল্পনায় শিশু মৃত্যুর প্রভাব বিষয়টিকে গবেষণা সমস্যা হিসেবে নির্বাচন করা হলো।

২। প্রচলিত জ্ঞানের সাথে পরিচিতি লাভঃ নির্বাচিত গবেষণা সমস্যার প্রাসঙ্গিক বিভিন্ন রচনা, লেখা বই পুস্তক, গবেষণা রিপোর্ট ইত্যাদি খুঁজে বের করে সেগুলোর সাথে সম্যক পরিচিতি লাভের চেষ্টা এই স্তরে করা হয়ে থাকে। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে গবেষণা সমস্যার সাথে সংশ্লিষ্ট প্রচলিত জ্ঞান গবেষক কে সঠিক ও মিতব্যয়ী পথে এগিয়ে যেতে সাহায্য করে। 

৩। গবেষণা সমস্যা কে উপযোগী করে তোলাঃ গবেষণার বিষয় বা সমস্যাকে বাস্তবে অনুসন্ধান উপযোগী করে তোলা হলো এ পর্যায়ে। অর্থাৎ, গবেষণার বিষয়টিকে প্রশ্নাকারে এখানে উপস্থাপন করার চেষ্টা করা হয় যাতে করে সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রগুলিকে চিহ্নিত ও পর্যবেক্ষণযোগ্য করে তোলা যায়। উদাহরণস্বরূপ, জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহারের বিষয়ে অধিক শিশু মৃত্যুধারী দম্পতির ঝোঁক প্রবণতা কোন দিকে? এ প্রশ্নটি জনসংখ্যার সমস্যা মোকাবেলার ক্ষেত্রে একটি গবেষণার উপযুক্ত বিষয়।

৪। উপযুক্ত গবেষণা অনুকল্প ও উদ্দেশ্য পূরণয়ন করাঃ গবেষণা সমস্যা মধ্যকার ধারণাগুলির পারস্পরিক সম্পর্ক নির্ধারণের মাধ্যমে গবেষণা সমস্যার সম্ভাব্য সমাধানদানের একটি আনুমানিক বিবৃতিই হলো অনুকল্প। উদাহরণস্বরূপ এখানে অধিক শিশু মৃত্যুধারী দম্পতি জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি কম ব্যবহার করবে এ অনুকল্পটি গ্রহণ করা হলো। যে কেউ এ অনুকল্প মধ্যস্থ ধারণাগুলোকে চলকে পরিণত করে তা পরিমাপের মাধ্যমে অনুকল্পের সঠিকতা প্রমাণ করতে পারবে।গবেষণার উদ্দেশ্য যেকোন সামাজিক গবেষণার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়।

৫। প্রাসঙ্গিক চলক নির্বাচনঃ গবেষণা সমস্যা ও অনুকল্প মধ্যস্থ ধারণাগুলোর মধ্যে কার্যকারণ সম্পর্ক স্থাপনের উপযোগী সংশ্লিষ্ট চলক গুলো এখানে চিহ্নিত করা হয়। চিহ্নিত চলকের ভিত্তিতেই প্রয়োজনীয় তথ্যাবলী সংগ্রহ করা হয়। এতে করে গবেষণার প্রাসঙ্গিকতা বজায় থাকে। অনুকল্পের সত্যতা যাচাই করা যায় এবং অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব হয়। 

৬। তথ্য সংগ্রহের উৎস চিহ্নিতকরণঃ গবেষণার সমস্যা অনুকল্পের উদ্দেশ্য ও চলকের প্রকৃতি বিবেচনা করে কাদের কাছে থেকে উল্লিখিত তথ্যাবলি সংগ্রহ করা যাবে তা এই স্তরের নির্ধারণ করা হয়। এক্ষেত্রে উৎস কোন ব্যক্তি, পরিবার প্রধান, সংস্থা কর্মী ইত্যাদি যে কেউ হতে পারে। তথ্য উৎস দুই প্রকার যথাঃ প্রাইমারি সোর্স, সেকেন্ডারি সোর্স।  

৭। তত্ত্ব সংগ্রহের হাতিয়ার গঠন ও সব নকশা প্রনয়নঃ গবেষণার প্রকৃতি,তথ্য সংগ্রহের উৎসের অবস্থান এবং সমর্থ্যর ভিত্তিতে উপযুক্ত তথ্য সংগ্রহের মাধ্যমে তৈরি করা হয়ে থাকে, যাতে করে সংশ্লিষ্ট উৎস হতে প্রাসঙ্গিক তথ্য সংগ্রহ করে নির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব হয়। সাক্ষাৎকার, সিডিউল, প্রশ্নপত্র ইত্যাদি সামাজিক গবেষণার মানসম্মত তথ্য সংগ্রহের হাতিয়ার।সাথে সাথে এ পর্যায়ে সংগৃহীত তথ্যর উপস্থাপনযোগ্য ছকসমূহের নকশাও তৈরি করা হয়। এতে করে তথ্যের পরিমাপ যোগ্যতার বৈশিষ্ট্য বজায় থাকে এবং তথ্য সংগ্রহের অব্যবহিত করেই সুশৃংখলভাবে তথ্য বিশ্লেষণ করা সম্ভবপর হয়ে ওঠে।

৮। তথ্য সংগ্রহ মাধ্যমে পূর্ব যাচাই ও পরিমার্জনঃ তথ্য সংগ্রহ মাধ্যম যথোপযুক্তকরণ, মানসম্মতকরণ এবং প্রাসঙ্গিককরণের উদ্দেশ্যে এ পর্যায়ে কিছু সংখ্যক হাতিয়ার কে বাস্তব ভিত্তিকভাবে যাচাই করে দেখা হয়। যেমন- সিডিউল, প্রশ্ন পত্র ইত্যাদি যদি কোন পরিবর্তন পরিমার্জন প্রয়োজন হয় তবে তা এই স্তরেই সমাধান করে সংশ্লিষ্ট হাতিয়ারের চূড়ান্ত রূপ দেয়া হয়।

৯।তথ্য সংগ্রহঃ উদ্ভাবিত তথ্য সংগ্রহের হাতিয়ার নিয়ে সংশ্লিষ্ট উৎস হতে প্রয়োজনীয় তথ্যাবলী সরেজমিনে সংগ্রহ করায় স্তরের দায়িত্ব।এক্ষেত্রে গবেষক নিজ অথবা পূর্ব প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত তার বেতনভোগী মাঠকর্মীদের নিয়ে তথ্য সংগ্রহ করাতে পারেন।

১০। তথ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বিশ্লেষঃ মাঠ পর্যায়ে সংগৃহীত তথ্যাবলী যথাযথভাবে সম্পাদনার পর তা শ্রেণীবদ্ধভাবে নানা ধরনের ছকে উপস্থাপন করা হয়। এরপর বিভিন্ন পরিসংখ্যানগত পদ্ধতি ও কৌশলের আশ্রয়ে ওই তথ্যগুলিকে বিশ্লেষণ করা হয় এবং গবেষণা অনুকল্পের সঠিকতা যাচাই করার চেষ্টা করা হয়। 

১১। ফলাফল উপস্থাপন ও প্রতিবেদন প্রকাশঃ তথ্য বিশ্লেষণের পর প্রাপ্ত ফলাফল প্রতিবেদন আকারে প্রকাশ করা গবেষকের সর্বশেষ দায়িত্ব। প্রতিবেদনে প্রাসঙ্গিক সুপারিশ উল্লেখ করা হয় যাতে করে সহধর্মী গবেষণার খোরাক পরবর্তী গবেষক এবং নীতিনির্ধারণকরা পেতে পারে। 

উপসংহারঃ পরিশেষে বলা যায় যে, বর্তমানে সামাজিক গবেষণার ক্ষেত্রে যেমন ব্যাপকভাবে বিস্তৃতি লাভ করেছে তেমনি গবেষণার বিষয়ে জটিল থেকে জটিলতার হয়েছে। সমাজের কোন সমস্যায় পুরোপুরি নির্মূল করা সম্ভব নয়। সামাজিক গবেষণার মাধ্যমে সমাজের সমস্যা চিহ্নিত করা হয় এবং সমাধানের উপায় অনুসন্ধান করা হয়।

Post a Comment (0)
Previous Post Next Post