জাতিবর্ণ প্রথা কী? জাতিবর্ণ প্রথার প্রকারভেদ ও বৈশিষ্ট্য

 জাতিবর্ণ প্রথা কী?

ভূমিকাঃ- সামাজিক স্তরবিন্যাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ ধরণ হলো জাতিবর্ণ প্রথা। প্রাচীন কাল থেকে ভারতীয় সমাজ ব্যবস্থায় বিশেষ করে  হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে এ প্রথার প্রচলন বেশি লক্ষ্য করা যায়। হিন্দুদের প্রাচীন শাস্ত্রবেদ বর্ণিত ৪টি বর্ণের কথা বলা হয়েছে। 

জাতিবর্ণ প্রথা কী?

যাদের বিভিন্ন শ্রেণি, বিভিন্ন পেশা, রীতিনীতি, আচর আচরণ, সুযোগ সুবিধা মূল্যবোধ ইত্যাদির ভিন্নতা বিদ্যমান।আর এসব পার্থক্য তাদের বংশধারা  এবং ধর্মীয় বিশ্বাস দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। আর এসবের স্থানে যারা জড়িত তারাই জাতিবর্ণ প্রথার অন্তর্ভূক্ত। জাতিবর্ণ প্রথা যে শুধু ভারতীয় সমাজ ব্যবস্থায় দেখা যায় তা নং বরং প্রাচীন মিশর, জাপান, আধুনিক মিয়ানমার, আমেরিকা ও ইউরোপেও জাতিবর্ণ প্রথা ব্যবস্থা পরিলক্ষিত হয়। তবে জাতিবর্ণ প্রথা হিন্দু ধর্মে বেশি দেখা যায়।

জাতিবর্ণঃ সাধারণত জাতিবর্ণ প্রত্যয়টি হিন্দু ধর্মের সাথে সম্পর্কিত। জাতি বর্ণের ইংরেজি প্রতিশব্দ Caste. যা এসেছে স্প্যানিশ শব্দ Casta থেকে। Casta শব্দটির অর্থ হলো কুলজাতি বা বংশ ধারা। ঐতিহ্যবাহী ভারতীয় সমাজের অসমতা বোঝাতে পর্তুগিজরা জাতিবর্ণ শব্দটি ব্যবহার করেন। সুতরাং জাতিবর্ণ প্রথা বলতে বুঝায় অন্তর্গোত্র বিবাহভিত্তিক এমন একগোষ্ঠী যার একটি সাধারণ নাম থাকে, যাদের সদস্যদের সামাজিক মেলামেশার ক্ষেত্রে কতিপয় বিধিনিশেষ মেনে চলতে হয়।

প্রামাণ্য সংজ্ঞাঃ বিভিন্ন চিন্তাবিদ ও জাতিতাত্ত্বিক জাতিবর্ণ প্রথাকে বিভিন্নভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন । নিম্নে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি সংজ্ঞা প্রদান করা হলো-

এম এন শ্রীনিবাস তার Social change in modern india গ্রন্থে বলেন “জাতি প্রথা হচ্ছে নিঃসঙ্গ এক বিশেষ সর্বভারতীয় ব্যবস্থা এই অর্থে যে, তার মধ্যে সকলেরই স্থান জম্মসূত্রে নির্ধারিত।”

Dictionary of sociology গ্রন্থে B Bhushan বলেন জাতিবর্ণ প্রথা ব্যবস্থা হচ্ছে সামাজিক স্তরবিন্যাসের একটি রুপ, যেখানে বর্ণগুলো বংশগতভাবে সংগঠিত একে অন্যর সাথে পৃথকীকরণ রীতি ও আচার অনুষ্ঠানের বিশুদ্ধতার জন্যই জাতিবর্ণ গঠিত।”

C. H. Colly জাতিবর্ণের সংজ্ঞায় বলেন যখন একটি শ্রেণী কঠোরভাবে বংশগতি হয়, তখন আমরা তাকে জাত বলতে পারি।


জাতিবর্ণ প্রথার প্রকারভেদ:

১. বর্ণভিত্তিক প্রথা: এটি হিন্দু ধর্মীয় ভিত্তিতে গঠিত চারটি মূল বর্ণ (ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র) অনুযায়ী সমাজকে ভাগ করে। এই বিভাজন জন্মসূত্রে এবং পেশাভিত্তিক।

২. উচ্চ-নিম্ন শ্রেণিভিত্তিক প্রথা: এই প্রথায় সমাজের কিছু গোষ্ঠীকে "উচ্চ" ও কিছু গোষ্ঠীকে "নিম্ন" হিসেবে দেখা হয়। উচ্চবর্ণের মানুষরা ধর্মীয় ও সামাজিকভাবে বেশি সুযোগ সুবিধা পায়, যেখানে নিম্নবর্ণ বা দলিত শ্রেণির মানুষরা অবহেলিত হয়।

৩. আঞ্চলিক বা জাতি ভিত্তিক প্রথা: কিছু অঞ্চলে জাতি পরিচয়ের ভিত্তিতে সামাজিক বিভাজন হয় যেমন রাজপুত, যাদব, কায়স্থ ইত্যাদি।


জাতিবর্ণ প্রথার বৈশিষ্ট্যসমূহ:

১. জন্মসূত্রে নির্ধারিত: জাতিতে স্থান নির্ধারিত হয় জন্ম অনুযায়ী, কেউ নিজের ইচ্ছায় জাত পরিবর্তন করতে পারে না।

২. বংশানুক্রমিক পেশা: প্রত্যেক জাতির নির্দিষ্ট পেশা থাকে যা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে পালন করা হয়। যেমন ব্রাহ্মণরা পুরোহিত, বৈশ্যরা ব্যবসায়ী ইত্যাদি।

৩. অন্তর্গোত্র বিবাহ (Endogamy): জাতির সদস্যরা কেবল নিজেদের জাতির মধ্যেই বিয়ে করতে পারে। বাইরের জাতির সঙ্গে বিবাহ নিষিদ্ধ বা অগ্রহণযোগ্য।

৪. সামাজিক যোগাযোগে বাধা: উচ্চ ও নিম্নবর্ণের মধ্যে খাওয়া-দাওয়া, সহাবস্থান, স্পর্শ ইত্যাদিতে নানা রকম বিধিনিষেধ থাকে। এটি “স্পর্শবঞ্চনা” প্রথার জন্ম দেয়।

৫. ধর্মীয় ও সামাজিক নিয়ন্ত্রণ: ধর্মগ্রন্থ, পুরোহিত ও সমাজপতিরা জাতিভিত্তিক নিয়মনীতি প্রণয়ন ও রক্ষণাবেক্ষণ করে।

৬. স্থানান্তরের অযোগ্যতা: জাতিবর্ণ প্রথায় একজন ব্যক্তি সামাজিকভাবে উন্নীত হওয়ার সুযোগ প্রায় নেই। এটি একটি বন্ধ সমাজব্যবস্থা।

৭. সামাজিক বৈষম্য: জাতি ব্যবস্থায় উচ্চবর্ণের মানুষরা প্রাধান্য পায় এবং নিম্নবর্ণের মানুষেরা সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে বঞ্চিত থাকে।

উপসংহার: জাতিবর্ণ প্রথা হলো এমন একটি সামাজিক কাঠামো, যা জন্ম, পেশা, ধর্মীয় বিশ্বাস ও আচার আচরণের উপর ভিত্তি করে গঠিত। এটি মূলত একটি বন্ধ সমাজ ব্যবস্থা, যেখানে ব্যক্তির সামাজিক অবস্থান পরিবর্তনের সুযোগ সীমিত বা নেই বললেই চলে। হিন্দু ধর্মে এটি সবচেয়ে বেশি বিস্তৃত, তবে পৃথিবীর অন্যান্য সমাজেও এ প্রথার ছায়া পাওয়া যায়।

No comments:

Post a Comment