রাজনৈতিক সামাজিকীকরণ কাকে বলে ও গুরুত্ব লিখো
ভূমিকাঃ- রাজনৈতিক সামাজিকীকরণ হচ্ছে প্রকৃত সামাজিকীকরণের একটি বিশেষ রুপ।রাজনৈতিক সামাজিকীকরণের মাধ্যমে মানুষ রাজনৈতিক বিষয়ের জ্ঞান অর্জন করতে পারে। রাজনৈতিক সামাজিকীকরণ একটি রাজনৈতিক শিক্ষার প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে রাজনৈতিক বিশ্বাস অনুভূতি রীতিনীতি আদর্শ ইত্যাদি বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করা যায়। অর্থাৎ রাজনৈতিক শিক্ষা ও জ্ঞান অর্জনই হলো রাজনৈতিক সামাজিকীকরণ।
রাজনৈতিক সামাজিকীকরণ
রাজনৈতিক সামাজিকীকরণ হলো এমন একটি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে শিশুর প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পথে রাজনৈতিক মূল্যবোধ ও মনোবৃত্তি জাগরিত করা যায় এবং প্রাপ্ত বয়স্কদের বিভিন্ন রাজনৈতিক উপাত্তের উপযোগী করে গড়ে তোলা যায়।
রাজনৈতিক সামাজিকীকরণের প্রামাণ্য সংজ্ঞা:
বিভিন্ন সমাজতাত্ত্বিক ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রাজনৈতিক সামাজিকীকরণ কে বিভিন্নভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন তার মধ্যে কয়েকটি সংজ্ঞা নিম্নে দেওয়া হলো-
ডেভিট ইষ্টন ও জেক ডেনিস এর মতে রাজনৈতিক সামাজিকীকরণ হলো একটি বিশেষ পথ। এই পথে সমাজ তার রাজনৈতিক জ্ঞান, মনোভাব, রীতিনীতি ও মূল্যবোধকে এক প্রজন্ম হতে অন্য প্রজন্মে প্রভাবিত করে।
সমাজবিজ্ঞানী কিংসলে ডেভিসের মতে, "সামাজিকীকরণ এমন প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে একজন ব্যক্তি পুরোপুরি সামাজিক মানুষে পরিণত হয়।
Langton বলেন মৌলিক অর্থে রাজনৈতিক সামাজিকীকরণ বলতে একটি সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক অব্যাহত প্রক্রিয়াকে বুঝায়।
অ্যালন বল তার Modern Politics and Government গ্রন্থে বলেন বিদ্যমান রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রতি মনোভাব ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা সম্পর্কে বিশ্বাস প্রতিষ্ঠা ও প্রসারিত করাই হলো রাজনৈতিক সামাজিকীকরণ।
Herbert hyman এর মতে রাজনৈতিক সামাজিকীকরণ হলো আবেগ বিজড়িত ও ব্যক্ত রাজনৈতিক ভাবধারা বা আচার ব্যবস্থার শিক্ষালাভের এবং অন্তহীন প্রক্রিয়া।
অ্যালমন্ড বলেন রাজনৈতিক সংস্কৃতির সাথে ব্যক্তির পরিচিতি হওয়ার প্রক্রিয়াই হলো রাজনৈতিক সামাজিকীকরণ।
Wasby বলেন রাজনৈতিক সামাজিকীকরণ বলতে আমরা এমন কিছু বুঝি যা জনসাধারণ সচেতনভাবে রাজনৈতিক মূল্যবোধ অর্জন ও রাজনৈতিক কার্যকলাপে অংশগ্রহণের মাধ্যমে শিক্ষা লাভ করে।
অ্যালমন্ড ও ভার্বা বলেন রাজনৈতিক সামাজিকীকরণ হলো এমন একটি পদ্ধতি যার দ্বারা রাজনৈতিক সংস্কৃতির রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিবর্তন সাধিত হয়ে থাকে।
রবার্ট সিগেল বলেন রাজনৈতিক সামাজিকীকরণ হলো বিদ্যমান রাজনৈতিক ব্যবস্থায় স্বীকৃত ও অনুসৃত রীতিনীতি, মনোভাব ও আচার আচরণ ক্রমশ রপ্ত করার জন্য শিক্ষা গ্রহণের পদ্ধতি।
অ্যালমন্ড ও পাওয়েল বলেন রাজনৈতিক সামাজিকীকরণ হলো এমন একটি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে রাজনৈতিক সংস্কৃতি রক্ষিত ও পরিবর্তিত হয়ে থাকে।
পরিশেষে বলা যায় যে সমাজবদ্ধ মানুষের জন্য রাজনৈতিক সমাজিকীকরণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কেননা একজন মানুষের রাজনৈতিক সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে প্রচলিত রাজনীতি ব্যবস্থার সদস্য হতে পারে।
রাজনৈতিক সামাজিকীকরণের গুরুত্ব:
১. নাগরিক সচেতনতা বৃদ্ধি:
এটি মানুষের মধ্যে রাজনৈতিক জ্ঞান ও সচেতনতা তৈরি করে। ফলে একজন ব্যক্তি রাষ্ট্রের কাঠামো, সংবিধান, আইন, কর্তব্য ও অধিকার সম্পর্কে ধারণা লাভ করে।
২. সক্রিয় রাজনৈতিক অংশগ্রহণে উৎসাহ:
রাজনৈতিক সামাজিকীকরণের মাধ্যমে মানুষ নির্বাচন, মতপ্রকাশ, প্রতিবাদ, গণস্বাক্ষর ইত্যাদির মাধ্যমে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণে আগ্রহী হয়।
৩. রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করে:
রাজনৈতিক সামাজিকীকরণ এর ফলে নাগরিকরা যখন রাজনৈতিক ব্যবস্থা সম্পর্কে সচেতন ও দায়িত্ববান হয়, তখন সমাজে বিশৃঙ্খলার বদলে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান বজায় থাকে।
৪. প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে রাজনৈতিক উত্তরাধিকার স্থানান্তর:
রাজনৈতিক সামাজিকীকরণ একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে পুরোনো রাজনৈতিক আদর্শ, সংস্কৃতি ও চর্চা নতুন প্রজন্মের মাঝে পৌঁছে যায়।
৫. নেতৃত্ব গঠনে সহায়ক:
রাজনৈতিক সামাজিকীকরণ সমাজে রাজনৈতিকভাবে সচেতন জনগণের ভেতর থেকেই ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব গড়ে ওঠে। এ প্রক্রিয়া গণতান্ত্রিক নেতৃত্বকে শক্তিশালী করে।
৬. জাতীয় ঐক্য ও সংহতি রক্ষা:
রাজনৈতিক সামাজিকীকরণ মানুষকে জাতীয় চেতনা ও ঐতিহ্যের সঙ্গে যুক্ত করে, ফলে বিভাজন নয় বরং সমন্বয়ের মনোভাব গড়ে ওঠে।
রাজনৈতিক সামাজিকীকরণ একটি জাতির রাজনৈতিক জীবনকে সচল, সচেতন ও সংগঠিত রাখতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এটি ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রের মধ্যে একটি মিলবন্ধন তৈরি করে, যার ফলে গণতান্ত্রিক ও সুশাসন ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয়।

No comments:
Post a Comment