বাংলাদেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের রাজনীতি সম্পর্কে আলোচনা কর।

বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের রাজনৈতিক কার্যক্রম ব্যাখ্যা কর।


ভূমিকা: বাংলাদেশ একটি বহু জাতিগোষ্ঠীর দেশ। এখানে মূলধারার বাঙালি জনগোষ্ঠীর পাশাপাশি বহু সংখ্যালঘু জাতিসত্তার মানুষ বসবাস করে, যেমন চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, সাঁওতাল, হাজং, মণিপুরী, রাজবংশী, গারো, খাসিয়া প্রভৃতি। এদের অনেকে পাহাড়ি, আবার অনেকে সমতলে বসবাসকারী আদিবাসী ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ভুক্ত। তাদের রাজনৈতিক ইতিহাস, আচরণ ও দাবি-দাওয়ার পেছনে রয়েছে দীর্ঘ ইতিহাস, শোষণ ও বঞ্চনার চিহ্ন। ব্রিটিশ আমল থেকে শুরু করে পাকিস্তানি শাসন ও স্বাধীন বাংলাদেশেও তাদের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সবসময় ছিল জটিল, আন্দোলনমুখর এবং নানা সংঘাত-সংঘর্ষে পরিপূর্ণ।
বাংলাদেশে সংখ্যালঘু রাজনীতি সম্পর্কে আলোচনা কর

এথনিক সম্প্রদায়ের রাজনৈতিক আচরণ

নিম্নে এথনিক সম্প্রদায়ের রাজনৈতিক আচরণ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো-

১. কাপ্তাই বাঁধ প্রকল্প নিয়ে রাজনীতি:

১৯৬০এর দশকে পাকিস্তান সরকার কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামের সামাজিক, ভূ-রাজনৈতিক কাঠামোতে বড় রকমের পরিবর্তন আনে । কাপ্তাই বাঁধের কারণে রাঙামাটি শহর ডুবে যায়। ফলে চাকমারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হলেও তা উপযোগী ছিল না। পুনর্বাসন প্রক্রিয়া অব্যবস্থাপনার ফলে অসংখ্য চাকমা সংখ্যালয় পূর্ব পাকিস্তান ত্যাগ করে কারতে চলে যায়।

২. পার্বত্য আদিবাসীকে বাঙালি হিসেবে আখ্যায়িত করা:

১৯৭২ সালে গৃহীত সংবিধানে সকল নাগরিককে "বাঙালি" হিসেবে পরিচিত করায় আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রবল আপত্তি দেখা দেয়। তারা নিজেদের আলাদা জাতিগত পরিচয়ের স্বীকৃতি দাবি করে। মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা’র বক্তব্য, “আমি চাকমা, বাঙালি নই” এই বক্তব্য তাদের আত্মপরিচয় ও আত্মমর্যাদার প্রতি এক সুস্পষ্ট দাবির প্রকাশ। সংখ্যালঘুদের রাজনৈতিক আচরণ তাই হয়ে ওঠে নিজেদের পরিচয়ের লড়াইয়ে এক শক্তিশালী আন্দোলনের অংশ। একজন চাকমা হতে পারে না একজন মুরং, একজন চাকমা কোনো দিন বাঙালি হতে পারে না আমি চাকমা, আমি বাঙালি নয়। বাংলাদেশের নাগরিক বাংলাদেশি। আপনারাও ধাংলাদেশি কিন্তু আপনাদের জাতিগত পরিচয় আপনারা বাঙালি উপজাতীয়রা কখনো বাঙালি হতে পারে না।


৩. পার্বত্য অঞ্চলে সমতলের বাঙালিদের অনুপ্রবেশ:

সমতলের বাঙালিদের পার্বত্য অঞ্চলের অনুপ্রবেশের কারণে উপজাতিরা বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। সরকার অফিস আদালত ও বিভিন্ন প্রকল্প নির্মাণের সময় সমতলবাসীদের পার্বত্য এলাকায় নিয়ে আসে। সেই সাথে কৃষক ও ছোটোখাটো ব্যবসায়ীরাও। পার্বত্য এলাকায় গমন কয়ে ভূমিসংক্রান্ত ইস্যুতে উপজাতি ও অ-উপজাতিদের মধ্যে বিরোধ চরমে উঠে। সমতলের বাঙালিদের সরকারি জমি নিয়ে বিরোধ বাড়তে থাকে এবং পাহাড়িদের সাথে শত্রুতা তৈরি হয়।


৪. চন্দ্রঘোনা কাগজ কল নিয়ে রাজনীতি:

চন্দ্রঘোনায় ১৯৫২ সালে কাগজের কল প্রতিষ্ঠিত হলে উপজাতিদের বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। তখন কাগজ কলের জন্য দক্ষ ও অভিজ্ঞ শ্রমিক নিয়োগ দেওয়া হয় এবং এক্ষেত্রে উপজাতিরা বঞ্চিত হয়। বেশিরভাগ নিয়োগ পায় সমতলের লোকজন। কবে উপজাতিরা গতীয় অরণ্য থেকে বাঁশ কাটার কাজ পেয়েছিল।


৫. বাকশাল ও লারমার আন্ডারগ্রাউন্ডে গমন:

বাংলাদেশে কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ (বাকশাল) গঠিত হলে উপজাতিদের নেতা মানবেন্দ্র লারমা পার্বত্য চট্টগ্রামের স্বার্থে বাকশালে যোগ দেন। কিন্তু ১৫ আগস্ট বাকশালের প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একটি সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতাড়াত ও নিহত হলে মানবেন্দ্র লারমা সাংবিধানিক উপায়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের জন্য কিছু করার সকল আশা ভরসা হারিয়ে ফেলে। দেশে এমন অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ায় জনসংহতি সমিতির নেতারা তাদের সশস্ত্র শাখা শান্তি বাহিনীকে সুসংগঠিত কবে মানবেন্দ্র লারমা এ পরিস্থিতিতে আন্ডারগ্রাউন্ডে গিয়ে সশস্ত্র তৎপরতার নেতৃত্বে নিয়োজিত হন্।


৬. সংবিধানে উপজাতি এলাকা সংযোজন:

উপজাতি এলাকাকে ব্রিটিশ আমলে বিশেষ মর্যাদার এলাকা হিসেবে আখ্যায়িত করা হতো। কিন্তু ১৯৬২ সালে পাকিস্তানে নতুন সংবিধানে এ সুবিধা তুলে নেওয়া হয়। অথচ সংবিধান মোতাবেক উপজাতিদের সংখ্যালঘু জনগণ তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত হয় এবং অনেকেই এ সুযোগে দেশ ত্যাগ করে।


৭. আদিবাসী ফোরাম:

আদিবাসীদের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও মুক্তির লক্ষ্যে ঐক্য, সংহতি ও প্রগতি এ তিন মূলনীতিকে নিয়ে আদিবাসী ফোরামের যাত্রা শুরু করে। এ ফোরমের প্রথম কর্মসূচি ছিল ঢাকায় জাতীয়ভাবে আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস পালন করা। জাতিসংঘের আবাসিক প্রতিনিধির উপস্থিতিতে প্রায় দশ সহস্রাধির আদিবাসী অনুষ্ঠানে যোগদান করে। সংগঠনের মূল উদ্দেশ্য এদেশের বসবাসরত আদিবাসী জনগণের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠা, সংহতি জোরদার করা এবং প্রগতির পথে এগিয়ে নেওয়া।


৮. শান্তিচুক্তি:

শান্তিচুক্তির ধারা অনুযায়ী সরকারি দল একে পার্বত্য এলাকায় শান্তি প্রতিষ্ঠার মাইল ফলক হিসেছে আখ্যায়িত করে। অন্যদিকে, বিরোধী দল একে সংবিধান পরিপন্থি বলে উল্লেখ করে। তবে শান্তিচুক্তির সকল ধারা আজও বাস্তবায়িত হয় নি।


উপসংহার: বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের রাজনৈতিক আচরণ একটি জটিল ও বহুস্তরীয় বাস্তবতার প্রতিফলন। এই আচরণ কখনো আত্মপরিচয়ের দাবিতে দৃঢ়, কখনো বঞ্চনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদী, আবার কখনো রাষ্ট্রের সঙ্গে আপোষে আগ্রহী। তবে এখনো পর্যন্ত সংখ্যালঘুদের রাজনৈতিক দাবি ও চাহিদাগুলো পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি। সমতল ও পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, বোঝাপড়া ও সহাবস্থান নিশ্চিত না হলে এই রাজনৈতিক আচরণ আরও প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে উঠতে পারে।

No comments:

Post a Comment