এথনিক গোষ্ঠী বা উপজাতি সমাজের পরিবর্তনের ওপর প্রভাব বিস্তারকারী উপাদানসমূহ লেখ।

এথনিক গোষ্ঠী বা  উপজাতি সমাজের পরিবর্তনের ওপর প্রভাব বিস্তারকারী উপাদানসমূহ


ভূমিকা: বাংলাদেশ একটি বহুজাতিক ও বহুসাংস্কৃতিক দেশ। এখানে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর মধ্যে রয়েছে প্রায় ৩০টির মতো স্বতন্ত্র উপজাতি বা আদিবাসী সম্প্রদায়। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- চাকমা, মারমা, সাঁওতাল, গারো, খাসি, মণিপুরি, হাজং, মুরং, ত্রিপুরা, তঞ্চঙ্গ্যা প্রভৃতি।
এথনিক গোষ্ঠী বা  উপজাতি সমাজের পরিবর্তনের ওপর প্রভাব বিস্তারকারী উপাদানসমূহ



এই জনগোষ্ঠীগুলো দেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম, উত্তরবঙ্গ ও সিলেট অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসবাস করে। বহু প্রাচীনকাল থেকে তারা তাদের নিজস্ব রীতিনীতি, প্রথা, সংস্কৃতি ও ভাষা নিয়ে টিকে আছে। এদের সমাজব্যবস্থা মূলত গোষ্ঠীকেন্দ্রিক ও ঐতিহ্যনির্ভর। তবে আধুনিক বিশ্বের প্রভাব, উন্নয়ন প্রকল্প, শিক্ষার বিস্তার, প্রশাসনিক পরিবর্তনসহ বিভিন্ন কারণে এদের সমাজব্যবস্থায় পরিবর্তনের ছাপ পড়েছে।

এই পরিবর্তনের পেছনে কিছু গুরুত্বপূর্ণ উপাদান কাজ করেছে, যা নিচে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হলো।

উপজাতি সমাজের/এথনিক গোষ্ঠীর পরিবর্তনের ওপর প্রভাব বিস্তারকারী উপাদানসমূহ:

যে-সব উপাদান উপজাতি সমাজব্যবস্থার ওপর প্রভাব বিস্তার করছে সেগুলো নিম্নে আলোচনা করা হলো

১. রাজনীতি:

রাজনীতি একটি জাতির চিন্তাধারা, মূল্যবোধ ও আচরণে ব্যাপক প্রভাব ফেলে। সব মানুষই আধুনিক সভ্য সমাজের রাজনৈতিক সচেতন প্রাণী। বর্তমান সমাজে রাজনৈতিক আলোচনা এত বেশি প্রসারতা লাভ করেছে যে-কোনো মানুষই এখন আর রাজনীতি সম্পর্কে সচেতন। এক সময় উপজাতি সমাজ রাজনীতি থেকে অনেকটাই বিচ্ছিন্ন ছিল। তারা নিজেদের গোষ্ঠীপ্রধান বা দলনেতার কথায় বেশি বিশ্বাস করত এবং আধুনিক রাজনীতিকে অনেকটাই অচেনা মনে করত। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে রাজনৈতিক সচেতনতা তাদের মধ্যেও ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পায়। বিশেষ করে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি এবং আদিবাসী অধিকার আন্দোলনের পর তাদের রাজনৈতিক অংশগ্রহণ অনেক বেশি বেড়েছে। বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে পিছিয়ে পড়া উপজাতি জনগোষ্ঠীরাও রাজনীতি সম্পর্কে নতুন করে ভাবতে শুরু করেছে। রাজনীতি সচেতন জনগণ হিসেবে উপজাতিরা সমাজে তাদের স্থান মজবুত করে নিতে তৎপর হচ্ছে।

২. প্রশাসনিক ব্যবস্থা:

উপজাতি সমাজের পরিবর্তনের ক্ষেত্রে সরকারের প্রশাসনিক বাবস্থা ও ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। যেমন- গারো উপজাতি সমাজে কেন্দ্রীয় প্রশাসন যন্ত্রের বিকাশ ঘটেছে। এদের স্থানীয় অঞ্চলে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা বিকাশ লাভ করেছে।পূর্বে তারা স্বাভাবিকভাবে নিজেদের ঐতিহ্যবাহী শাসনব্যবস্থায় পরিচালিত হতো, যেখানে প্রধান বা 'হেডম্যান' শাসনের দায়িত্বে থাকতেন। কিন্তু বর্তমানে ইউনিয়ন পরিষদ, স্থানীয় থানা ইত্যাদি গড়ে উঠেছে। এর ফলে গারোদের রাজনীতিতে এসেছে আমূল পরিবর্তন। স্থানীয় পর্যায়ে নির্বাচিত কোনো মেম্বার, চেয়ারম্যানদের ক্ষমতা ঐতিহ্যবাহী গারো প্রধানদের চেয়ে এখন অনেক বেশি এবং স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা গারোদের পরিবর্তনশীলতার ওপর বেশ প্রভাব ফেলছে।

৩. সংগঠন সৃষ্টি:

উপজাতিরা তাদের ন্যায্য অধিকার ও অস্তিত্ব রক্ষার জন্য সংগঠিত হতে শুরু করেছে। উপজাতিরা তাদের অধিকার রক্ষা করার জন্য আদিবাসী ফেরাম নামে একটি সংগঠনের সৃষ্টি করেছে। আদিবাসী সংগঠনের সমগ্র বাংলাদেশের উপজাতিরা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ভূমি অধিকার নিশ্চিত করার জন্য সদা সচেষ্ট। মাঝে মাঝে উপজাতি জনগোষ্ঠী তাদের অধিকার আদায়ের জন্য সংগঠনের মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের মিটিং মিছিল ও মানববন্ধনের মতো কর্মসূচি পালন করে থাকে। বর্ণ ধর্ম, শ্রেণি ও জাতিগত বৈশিষ্ট্যসহ তাদের ওপর সকল প্রকার অন্যায়, অবিচার ও বৈষম্য দূর করার জন্য আদিবাসী সংগঠন বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।

৪. আদিবাসী ফোরামের তৎপরতা:

আদিবাসী ফোরাম বাংলাদেশের উপজাতিদের অধিকার আদায়ের জন্য গঠিত হয়। এ ফোরামের প্রথম কর্মসূচি ছিল আদিবাসী দিবস উদযাপন করা।আদিবাসী ফোরাম বাংলাদেশের সব উপজাতিদের একটি জাতীয় প্ল্যাটফর্ম হিসেবে কাজ করে। এ ফোরামের মাধ্যমে আদিবাসী জাতিসমূহের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও ভূমি অধিকার, ঐতিহ্য, দাবি-দাওয়া ও সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রসঙ্গে আলোচনা হয়। উপজাতিদের ফুরি, আইন, প্রথা, জ্ঞানবিজ্ঞান, ভাষ এবং নৃতাত্ত্বিক পরিচিতির সাংবিধানিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা আদিবাসী সংগঠনের অন্যতম উদ্দেশ্য। আদিবাসী ফোরাম প্রগতিশীল ঐক্য, সংহতি ও সম্পর্কের জোরদার করতে সদা সচেষ্ট থাকে। উপজাতিদের অঞ্চলভিত্তিক রাজনৈতিক দল গঠন ও বিভিন্ন সংগঠনের সাথে যোগাযোগ ও সম্পর্ক জোরদার করতে সদা সচেষ্ট থাকে। উপজাতি অধ্যুষিত অঞ্চলের জনগণের সংস্কৃতি ও পরিবেশের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ উন্নয়ন নিশ্চিত করতে সহায়তা করা থাকে। এ কারণে আমরা বলতে পারি উপজাতীয় সমাজের পরিবর্তনশীলতার ওপর আদিবাসী ফোরামের বিশেষ প্রভাব বিরাজমান।

৫. মিশনারি তৎপরতা:

উপজাতি সমাজে মিশনারিদের তৎপরতার প্রভাবও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।খ্রিস্টান মিশনারিরা ধর্মীয় দীক্ষার পাশাপাশি শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখছে। এদের প্রভাব বিশেষ করে চাকমা সমাজের ওপর প্রতিফলিত হচ্ছে। এদের একদিকে রয়েছে ঐতিহ্যবাহী সর্বপ্রাণবাদের প্রভাব আবার অন্যদিকে রয়েছে হিন্দুধর্মীয় বিশ্বাস ও আচরণের প্রভাব। চাকমারা এখন মিশনারি তৎপরতার প্রভাবে ক্রমেই বৌদ্ধধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ছে। এ উপজাতি সম্প্রদায় বর্তমানে বিশ্বধর্মের পতাকাতলে একত্রিত হচ্ছে। চাকমাদের মধ্যে বৌদ্ধধর্মের প্রভাব বা জাগরণ এসেছে মিশনারি তৎপরতার ফলশ্রুতিতেই।

৬. গণমাধ্যম:

বর্তমান বিশ্বে মানবকল্যাণের জন্য সবচেয়ে শক্তিশালী ও সময়োপযোগী হাতিয়ার হলো গণমাধ্যম। জাতির ভাগ্যোন্নয়নে গণমাধ্যম বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে। ইলেকট্রনিক মিডিয়ার মাধ্য আমরা দেখতে পাই টেলিভিশন, রেডিও ইন্টারনেট ইত্যাদি। আবার প্রিন্ট মিডিয়া হিসেবে আমরা সংবাদপত্রকে দেখতে পাই। গুরুত্বের দিক থেকে প্রিন্ট মিডিয়া ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া সমান গুরুত্বের দাবিদার। বিশ্বের নন্দিত প্রচার মধ্যমগুলোর মধ্যে টেলিভিশন অন্যতম। প্রযুক্তির বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বের প্রতিটি দেশেই তথ্য আদান-প্রদান সহজতর হচ্ছে। বিংশ শতাব্দীর এক বিশ্বয়কর প্রযুক্তি হচ্ছে ইন্টারনেট। এসব গণমাধ্যম সবগুলোই মানুষের কল্যাণে নিবেদিত। এ গণমাধ্যমগুলো পিছিয়ে পড়া উপজাতিদের জীবনযাপন, সংস্কৃতি ও সমস্যা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিসরে তুলে ধরছে। গণমাধ্যমসমূহের ভূমিকার প্রতি দৃষ্টি রেখেই একথা নিশ্চিত করে বলা যায়, একমাত্র গণমাধ্যমই পারে অবহেলিত ও পশ্চাৎগদ উপজাতি সমাজের করুণ চিত্র তুলে ধরতে। সমাজে তাদের অধিকার আগায়ের সহায়তা করতে। গণমাধ্যমের আলোচনা থেকে এ ধারণা পাওয়া যায়। গণমাধানও উপজাতি সমাজকে পরিবর্তনে বেশ প্রভাবিত করে থাকে।

৭. শিক্ষার বিস্তার:

শিক্ষা জাতির উন্নতির জন্য অপরিহার্য।শিক্ষা প্রত্যেক সমাজের নর-নারীর জন্য জরুরি। শিক্ষা ছাড়া কোনো জাতির পক্ষে উন্নতি লাভ করা সম্ভব নয়। মানুষের বিকাশের পূর্ণতা লাভ করার জন্য প্রয়োজন শিক্ষা। জাতির উন্নতি লাভ করার জন্য শিক্ষাও অপরিহার্য। উপজাতিরাও আমাদের সমাজের একটি অংশ। তাদের উন্নতি মানেই আমাদের উন্নতি, তাই তাদেরকে শিক্ষিত করে গড়ে তোলার জন্য সর্বজনীন শিক্ষা কার্যক্রম চালু করা রাষ্ট্রের প্রধান দায়িত্ব। উপজাতিদেরকে এ ব্যাপারে সরকারের প্রতি সহযোগিতামূলক মনোভাব প্রদর্শন করতে হবে। উপজাতি সমাজের অনেকেই শিক্ষার প্রতি অনুৎসাহী। বিভিন্ন উপজাতিদের মধ্যে চাকমারা বেশি শিক্ষিত। উপজাতিদের মধ্যে তাদের শিক্ষার হার সবচেয়ে বেশি। কারণ হিসেবে দেখা যায়, তারা বাংলা ও ইংরেজিকে অধিক হারে গ্রহণ করেছে। গারো এবং সাঁওতালরা সমান তালে শিক্ষার ক্ষেত্রে অগ্রসর হচ্ছে। বর্তমান কালে সাঁওতালদের অনেকে খ্রিষ্টধর্মে দীক্ষিত হয়ে তাদের দ্বারা কিছু পরিমাণে শিক্ষার মুখ দেখছে। খ্রিষ্টান মিশনারিরাও উপজাতিদেরকে শিক্ষিত করে তোলার ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রাখছে। আধুনিক শিক্ষার প্রসারের কারণে উপজাতি সমাজ ইদানীংকালে বেশি পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। শিক্ষা তাদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস ও নেতৃত্বগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে।

৮. অস্ত্র বিদ্রোহ:

পার্বত্য অঞ্চল উপজ্ঞাতি অধ্যুষিত বাংলাদেশের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ। এ অঞ্চলে দীর্ঘদিন ধরে অস্ত্রধারী বিদ্রোহ, বৈষম্য ও সংঘাত চলেছিল। স্বাধীনতার পর থেকেই পার্বত্য উপজাতিরা তাদের ভাষা, সংস্কৃতি, ভূমি ও অধিকার রক্ষার দাবিতে আন্দোলনে নামেন। তারা তাদের দাবি আদায়ের জন্য জনসংহতি সমিতি গঠন করে। পরবর্তী সময়ে এটি শান্তিবাহিনী নামে এদের একটি সামরিক শাখা গঠন করে। এ শাখার মাধ্যমে উপজাতিরা অস্ত্র বিদ্রোহ করে এবং অনেকবার এরা অস্ত্র বিরতি চুক্তি ভঙ্গ করে। বার বার তাদেয় অস্ত্র বিদ্রোহের কারণে তাদের অর্থাৎ উপজাতি সমাজের পরিবর্তনে বেশ প্রয়ান লক্ষ করা যায়। পরবর্তীতে ১৯৯৭ সালের চুক্তির মাধ্যমে পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হয়। তবে এই বিদ্রোহ ও সংঘাত উপজাতি সমাজের কাঠামোকে অনেকাংশে পরিবর্তন করেছে। অনেকে উদ্বাস্তু হয়েছে, আবার অনেকে মূলধারার সমাজের সঙ্গে মিশে গেছে। শান্তিচুক্তির পর রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ব্যবস্থায় অনেক পরিবর্তন এসেছে।

উপসংহার: উপর্যুক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায় যে উপজাতি সমাজ বিভিন্ন ঘটনার ধারাবাহিকতায় বিভিন্নভারে পরিবর্তিত হচ্ছে এবং তাদের এ পরিবর্তনের প্রভাবের কলে উপজাতি সমাজ প্রাচীন আমলের ব্যানধারণা পরিত্যাগ করছে। ধীরে ধীরে তারা সভ্য সমাজের মানুষ হিসেবে গণ্য হতে শুরু করছে।

No comments:

Post a Comment