সংখ্যালঘু বিষয়ে আন্তঃধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি ব্যাখ্যা কর
ভূমিকা: সংখ্যালঘু বিষয়ে আন্তঃধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি মূলত রক্ষণশীল প্রকৃতির। একবিংশ শতাব্দীর শুরুতে এ দৃষ্টিভঙ্গি পুরোনো প্রতিষ্ঠান, মূল্যবোধ ও রীতিনীতিকে টিকিয়ে আন্তঃধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি রক্ষণশীলভাবে গড়ে উঠে। আধুনিক সমাজে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অবস্থান এবং তাদের প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার বিষয়। বিশেষত, আন্তঃধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সংখ্যালঘুদের প্রতি যে মনোভাব প্রকাশ পায়, তা সাধারণত রক্ষণশীল ধ্যান-ধারণার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। একবিংশ শতাব্দীতে এসেও বহু সমাজে ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক সংখ্যালঘুরা পুরাতন প্রতিষ্ঠিত মূল্যবোধ ও প্রথার সঙ্গে খাপ খাওয়াতে গিয়ে নানা প্রতিকূলতার মুখোমুখি হয়। অন্যান্য তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গির তুলনায় এ দৃষ্টিভঙ্গি পৃথকভাবে খুবই ঐতিহ্যপূর্ণ।
সংখ্যালঘু বিষয়ে আন্তঃধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি:
সংখ্যালঘু বলতে সমাজের সেই সব অংশকে বোঝানো হয়, যাদের ধর্ম, ঐতিহ্য, বিশ্বাস ও মূল্যবোধ মূলধারার সমাজের সঙ্গে পুরোপুরি সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। বাংলাদেশ প্রসঙ্গে বলতে গেলে, সংখ্যাগুরু মুসলিম জনগোষ্ঠীর বাইরে থাকা হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, কাদিয়ানিসহ অন্যান্য ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলোকে সংখ্যালঘু হিসেবে গণ্য করা হয়ে থাকে। এদের ধর্মীয় বিশ্বাস ও ঐতিহ্য ভিন্ন হওয়ার কারণে অনেক সময় সমাজে তারা বঞ্চনা ও বৈষম্যের শিকার হন।
রক্ষণশীল দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে, মানুষ জন্মগতভাবে যুক্তিবাদী নয় বরং অনেকাংশেই অযৌক্তিক।এরা মনে করেন মানুষ যদি সবক্ষেত্রে যুক্তিবোধ দ্বারা সবকিছু বিচার করত তাহলে তারা টিকে থাকতে পারত না। টিকে থাকতে হলে অবশ্য তাদের অযৌক্তিক হতে হবে। এই দৃষ্টিভঙ্গিতে মনে করা হয়, যুক্তির চেয়ে বেঁচে থাকার সংগ্রামে অযৌক্তিকতা অনেক বেশি কার্যকর। অতএব, সমাজের স্থিতিশীলতা ও টিকে থাকার জন্য অনেক সময় অযৌক্তিক বিষয়গুলিকেও গ্রহণযোগ্য মনে করা হয়। এর ফলে সমাজে ধর্ম, জাতি ও অবস্থানভিত্তিক বিভাজনকে স্বাভাবিক ও প্রয়োজনীয় মনে করা হয়।
সামাজিক শৃঙ্খলা ও বৈষম্যের পক্ষে যুক্তি:
রক্ষণশীল মতবাদ অনুসারে, সমাজে শৃঙ্খলা বজায় রাখতে হলে একটি নির্দিষ্ট শ্রেণিগত কাঠামো বজায় রাখা জরুরি। এই কাঠামোয় সমাজের উচ্চবিত্ত ও সংখ্যাগুরু গোষ্ঠীর আধিপত্য স্বাভাবিক বলে বিবেচিত হয়। সামাজিক ও প্রশাসনিক কাঠামোয় সংখ্যালঘু ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণকে অনেকে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি হিসেবে দেখে। এই দৃষ্টিভঙ্গির অনুসারীরা মনে করেন, অর্থনৈতিক অভাব সংখ্যালঘুদের দুর্নীতির পথে ঠেলে দিতে পারে যার ফলে সমাজের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল হয়ে পড়বে।
এই কারণে প্রশাসন, আইন, নিরাপত্তা ও নীতিনির্ধারণী জায়গায় সংখ্যালঘুদের অংশগ্রহণ সীমিত রাখা উচিত এমনটাই তাদের ধারণা। যদিও এই দৃষ্টিভঙ্গি আধুনিক মানবাধিকার ও সাম্যবাদের পরিপন্থী, তবু রক্ষণশীল ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে এই চিন্তাভাবনার উপস্থিতি প্রবল।
সংস্কৃতির বিশুদ্ধতা ও সংখ্যালঘুদের বাদ দেওয়া:
অনেক রক্ষণশীল গোষ্ঠী মনে করে, সমাজের প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানগুলোই সংস্কৃতির বিশুদ্ধ রূপ ধারণ করে। অভিবাসন, শরণার্থী আগমন বা অভ্যন্তরীণ স্থানান্তরের মাধ্যমে নতুন মানুষ এলে সেই সংস্কৃতির বিশুদ্ধতা ক্ষুণ্ন হয়। তাদের মতে, এর ফলে সমাজের আদি সংস্কৃতির রূপটি বিলুপ্ত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়। তাই তারা নতুন আগত সংখ্যালঘুদের সামাজিক, সাংস্কৃতিক বা প্রশাসনিক অধিকার প্রদান করতে অনিচ্ছুক।
রক্ষণশীল দৃষ্টিভঙ্গিতে আরও বিশ্বাস করা হয়, সমাজে একটি অদৃশ্য শক্তি কাজ করে যা সমাজের ভারসাম্য রক্ষা করে চলে। মানুষ চাইলেও এই শক্তির অদৃশ্য ক্ষমতার বাইরে যাওয়ার ক্ষমতা মানুষের নেই।
যদি সংখ্যালঘুরা সংখ্যায় বাড়ে বা প্রশাসনিক ক্ষমতায় প্রবেশ করে, তবে এই ভারসাম্য বিনষ্ট হবে। এভাবেই তারা সংখ্যালঘুদের অধিকার সীমিত রাখাকে ন্যায্য বলে মনে করে।
ঐক্য ও আত্মরক্ষা:
রক্ষণশীল ধর্মীয় মতাদর্শ অনুসারীরা মনে করেন, দরিদ্র ও শরণার্থী সংখ্যালঘুদের হাত থেকে সমাজের উচ্চবিত্ত ও সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের মানুষদের নিজেদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি রক্ষায় ঐক্যবদ্ধ হওয়া জরুরি।একতাবদ্ধভাবে তাদের নিজেদের সমাজ ও সংস্কৃতিকে রক্ষা করতে হবে। তারা একটি ধরণের সামাজিক আত্মরক্ষার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন, যেখানে বহিরাগত প্রভাব থেকে সমাজকে রক্ষা করা মূল লক্ষ্য।
উপসংহার: পরিশেষে বলা যায়, সংখ্যালঘু বিষয়ে আন্তঃধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি রক্ষণশীল দৃষ্টিভঙ্গির মতো। সংখ্যালঘু বিষয়ক আন্তঃধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি মূলত রক্ষণশীল এবং পারস্পরিক বিভাজনকেই কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে। এ দৃষ্টিভঙ্গিতে সংখ্যালঘুরা সাধারণত তাদের ধর্মীয় গণ্ডির বাইরে বিবাহ, পরিবার গঠন বা অনুষ্ঠান পালনে আগ্রহী নয়। বরং তারা নিজ নিজ ধর্মীয় বিশ্বাস ও ঐতিহ্য অনুসারে জীবনযাপন করে এবং তা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বাহিত হয়। এই প্রেক্ষাপটে সংখ্যালঘুদের ধর্মীয় অবস্থান ও জীবনদর্শন সমাজে একটি বিশেষ তাৎপর্য বহন করে, যা গভীরভাবে অনুধাবনের প্রয়োজন রয়েছে।

No comments:
Post a Comment