বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের সংখ্যালঘু অবস্থানের জন্য শত্রুসম্পত্তি আইনের ভূমিকা
ভূমিকা: ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির পর থেকেই ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সীমান্তবিরোধ ও রাজনৈতিক টানাপোড়েন শুরু হয়। এই বিরোধের ধারাবাহিকতায় ১৯৬৫ সালে ভারত–পাকিস্তান যুদ্ধ সংঘটিত হয়। যুদ্ধ চলাকালে যারা পাকিস্তান ছেড়ে ভারতে গিয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেছিলেন, তাদের পরিত্যক্ত সম্পত্তিকে পাকিস্তান সরকার “শত্রুসম্পত্তি” ঘোষণা করে। এর মাধ্যমে সরকার ঘোষণা দেয় যে, ভারতে চলে যাওয়া ব্যক্তিরা রাষ্ট্রের শত্রু এবং তাদের সম্পত্তি রাষ্ট্রের অধীনে থাকবে।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশ নং ২৯ এর মাধ্যমে পাকিস্তান আমলের সেই ‘শত্রুসম্পত্তি আইন’-এর অনেক ধারাই হুবহু গ্রহণ করা হয়, যা পরবর্তীকালে “অর্পিত সম্পত্তি আইন” নামে পরিচিতি পায়। স্বাধীনতার চেতনার পরিপন্থী এই আইনের ফলে বাংলাদেশের সংখ্যালঘু, বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায় ভয়াবহভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাদের জমি, ঘরবাড়ি, বাণিজ্যিক সম্পত্তি এমনকি উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত সম্পত্তিও কেড়ে নেওয়া হয়।
শত্রুসম্পত্তি আইনের উৎপত্তি ও বিকাশ:
ভারত বিভক্তির পর পাকিস্তানের অংশ হিসেবে তৎকালীন পূর্ববাংলায় হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বীদের একটি অংশ নিরাপত্তার অভাবে ভারতে পাড়ি জমায়। যারা দেশত্যাগ করে যাননি, তারাও নানা কারণে ভীতসন্ত্রস্ত অবস্থায় দিন কাটাতে থাকেন।
প্রথমে ১৯৪৯ সালে প্রণীত হয় “পূর্ববঙ্গ বাস্তত্যাগী সম্পত্তি আইন”, যার আওতায় দেশত্যাগী হিন্দুদের সম্পত্তি সরকারের তত্ত্বাবধানে নেওয়া হয়। পরে ১৯৫০ সালে “লিয়াকত–নেহেরু চুক্তি”র মাধ্যমে ভারত ও পাকিস্তান উভয় দেশেই এ ধরনের সম্পত্তি ফেরত দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু পাকিস্তান সরকার সেই চুক্তি কার্যকর করেনি।
১৯৬১ সালে প্রণীত হয় “পূর্ববঙ্গ বাস্তত্যাগী (প্রত্যাবর্তন ও সম্পত্তি ব্যবস্থাপনা) আইন”, যার মাধ্যমে এসব সম্পত্তি সরকার সাময়িকভাবে লিজ দেওয়ার সুযোগ পায়। কিন্তু ১৯৬৫ সালের ৬ সেপ্টেম্বর ভারত–পাকিস্তান যুদ্ধ শুরু হলে পাকিস্তান সরকার জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে এবং প্রতিরক্ষা বিধি ১৮২ এর আওতায় “শত্রুসম্পত্তি অধ্যাদেশ” জারি করে। ওই সময় যারা ভারতে অবস্থান করছিলেন বা ভারতে গিয়েছিলেন, তাদের ‘শত্রু’ হিসেবে অভিহিত করা হয়।
যুদ্ধ শেষে ১৯৬৯ সালে জরুরি অবস্থা প্রত্যাহার হলেও “শত্রুসম্পত্তি আইন” বাতিল করা হয়নি। ফলে হাজার হাজার হিন্দু নাগরিক, যারা কখনো দেশ ছাড়েননি, তারাও “শত্রু” হিসেবে চিহ্নিত হন এবং তাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয়।
স্বাধীনতার পর আইনটির ধারাবাহিকতা:
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের পরও দুঃখজনকভাবে এই বৈষম্যমূলক আইনটি বিলুপ্ত হয়নি। বরং ১৯৭২ সালে রাষ্ট্রপতির আদেশ নং ২৯ এর মাধ্যমে প্রণীত হয় “দি বাংলাদেশ ভেস্টিং অফ প্রপার্টি অ্যান্ড অ্যাসেটস অর্ডার”, যা ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে কার্যকর বলে ঘোষণা করা হয়।
পরবর্তীতে ১৯৭৪ সালে প্রণীত “দি ভেস্টেড অ্যান্ড নন–রেসিডেন্ট প্রপার্টি (অ্যাডমিনিস্ট্রেশন) অ্যাক্ট” এবং ১৯৭৬ সালের “দি এনিমি প্রপার্টি (কন্টিনিউয়াল অফ ইমারজেন্সি প্রভিশন) রিপিল অ্যামেন্ডমেন্ট অর্ডিন্যান্স” আইন দুটির মাধ্যমে কার্যত “শত্রুসম্পত্তি” ধারণাটি টিকে যায়।
এই আইনের ফলে সরকারের হাতে থাকা সম্পত্তি আসল মালিক বা তার উত্তরাধিকারীদের কাছে ফেরত দেওয়ার কোনো বাধ্যবাধকতা ছিল না। এমনকি নতুন করে কোনো সম্পত্তি অধিগ্রহণ বন্ধ থাকলেও আগের সম্পত্তিগুলোর ফেরত প্রক্রিয়া শুরু হয়নি। ফলে বহু প্রজন্ম ধরে হিন্দু সম্প্রদায় তাদের পৈতৃক সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হয়ে আসছে।
হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর শত্রুসম্পত্তি আইনের প্রভাব:
এই আইনের মাধ্যমে হিন্দু সম্প্রদায় যে ভয়াবহ ক্ষতির শিকার হয়েছে, তা পরিসংখ্যানেও স্পষ্ট। গবেষণায় দেখা গেছে, প্রায় ৩৫ লাখ ৯০ হাজার হিন্দু নাগরিক তাদের সম্পত্তি হারিয়েছেন, নিঃস্ব হয়েছেন এবং অনেকে দেশত্যাগে বাধ্য হয়েছেন। অন্যভাবে বললে, প্রতি ৩৪টি হিন্দু পরিবারে একটি করে পরিবার এই আইনের কারণে সহায় সম্বল হারিয়েছে।
(১) সম্পত্তি হারানো: অনেক হিন্দু পরিবারকে তাদের নিজস্ব বাড়িঘর, জমি বা দোকান থেকে উচ্ছেদ করা হয়। স্থানীয় প্রভাবশালী মহল রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে “শত্রুসম্পত্তি” হিসেবে সরকারি তালিকাভুক্ত করে নিজেদের দখলে নেয়।
(২) সামাজিক বৈষম্য ও নিপীড়ন: এই আইনের ফলে হিন্দু সম্প্রদায় রাষ্ট্রীয়ভাবে “দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক” হিসেবে পরিণত হয়। তাদের সামাজিক মর্যাদা ক্ষুণ্ন হয় এবং তারা ব্যবসা-বাণিজ্য ও প্রশাসনিক পদে উপেক্ষিত হন।
(৩) আইনি জটিলতা ও হয়রানি: হিন্দু মালিকানাধীন সম্পত্তি পুনরুদ্ধারে আদালতে গিয়ে দীর্ঘদিন ধরে মামলা পরিচালনা করতে হয়। অনেক সময় বিচারিক প্রক্রিয়ায় দুর্নীতি ও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের কারণে ন্যায়বিচার পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে।
(৪) ধর্মীয় সংখ্যালঘুতার প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ: এই আইন শুধু সম্পত্তি কেড়ে নেয়নি, বরং হিন্দু সম্প্রদায়কে মানসিকভাবে দুর্বল ও অনিরাপদ করে তুলেছে। ধীরে ধীরে তারা রাষ্ট্রের মূলধারার বাইরে চলে যেতে বাধ্য হয়।
সাংবিধানিক অসঙ্গতি ও বৈষম্য:
বাংলাদেশের সংবিধানে বলা হয়েছে রাষ্ট্রের সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং ধর্ম, বর্ণ বা জাতিগত কারণে কারো সঙ্গে বৈষম্য করা যাবে না (অনুচ্ছেদ ২৭ ও ২৮)। কিন্তু “অর্পিত সম্পত্তি আইন” এই সাংবিধানিক প্রতিশ্রুতির পরিপন্থী।
এছাড়া অনুচ্ছেদ ১৩ (গ)-তে বলা হয়েছে, প্রত্যেক নাগরিকের ব্যক্তিগত সম্পত্তি অর্জন, ভোগ ও হস্তান্তরের অধিকার রয়েছে। কিন্তু শত্রুসম্পত্তি আইনের কারণে হিন্দু নাগরিকরা এই মৌলিক অধিকারের বাইরে থেকেছেন।
এই আইন সংবিধানের ১৪০ ও ১৪৪ অনুচ্ছেদের সাথেও অসামঞ্জস্যপূর্ণ, যেখানে স্পষ্ট বলা হয়েছে যে, সরকার কেবলমাত্র মালিকবিহীন সম্পত্তি রাষ্ট্রীয় তত্ত্বাবধানে নিতে পারবে। অথচ বাস্তবে দেখা গেছে, অধিকাংশ “অর্পিত সম্পত্তির” মালিক বা উত্তরাধিকারীরা বাংলাদেশেই অবস্থান করছিলেন।
আইন সংশোধন ও পুনরুদ্ধার আন্দোলন:
অন্যায়ের বিরুদ্ধে দেশের সচেতন নাগরিক, মানবাধিকারকর্মী ও অসাম্প্রদায়িক আন্দোলনকারীরা দীর্ঘদিন ধরে প্রতিবাদ জানিয়ে আসছেন। তাদের দাবি ছিল এই আইন বাতিল করে হিন্দু সম্প্রদায়ের বৈধ সম্পত্তি ফেরত দেওয়া।
দীর্ঘ আন্দোলনের ফলেই ২০০১ সালের ১১ এপ্রিল জাতীয় সংসদে পাস হয় “অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইন, ২০০১”। এই আইন অনুযায়ী, ১৯৭৪ সালের ২৩ মার্চের পর নতুন করে কোনো সম্পত্তিকে “শত্রুসম্পত্তি” হিসেবে ঘোষণা করা যাবে না।
বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টও এই বিষয়ে রায় দেয় যে, ১৯৬৯ সালের পর থেকে “শত্রুসম্পত্তি” ধারণাটি কার্যত বিলুপ্ত। এর ফলে সরকারের হাতে থাকা সম্পত্তি আসল মালিকদের ফিরিয়ে দেওয়ার পথ উন্মুক্ত হয়।
তবে আইন বাস্তবায়নে প্রশাসনিক জটিলতা, তালিকা ত্রুটি ও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের কারণে এখনো বহু হিন্দু পরিবার তাদের সম্পত্তি ফিরে পায়নি।
উপসংহার: সর্বোপরি বলা যায়, ১৯৬৫ সালের ভারত–পাকিস্তান যুদ্ধকে কেন্দ্র করে পাকিস্তান সরকার যে “শত্রুসম্পত্তি আইন” প্রবর্তন করেছিল, তা ইতিহাসে ধর্মীয় বৈষম্যের এক কালো অধ্যায়। স্বাধীন বাংলাদেশের মতো একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে এই আইন বহাল থাকা সংবিধান ও মানবাধিকারের পরিপন্থী ছিল।
অর্পিত সম্পত্তি আইন ২০০১ সালের মাধ্যমে এক নতুন দিগন্তের সূচনা হলেও বাস্তব প্রয়োগে এখনও অনেক দুর্বলতা রয়ে গেছে। এই আইনের ফলে হিন্দু সম্প্রদায়ের যে অগণিত পরিবার সহায়–সম্বল হারিয়েছে, তাদের পুনর্বাসন ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের নৈতিক দায়িত্ব।
একটি সত্যিকার গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গঠনের জন্য সকল নাগরিকের সমান অধিকার নিশ্চিত করতে হবে ধর্ম, বর্ণ বা রাজনৈতিক পরিচয় নির্বিশেষে। তবেই আমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সমৃদ্ধ একটি মানবিক রাষ্ট্র গঠন করতে পারব, যেখানে আর কোনো নাগরিককে তার ধর্মের কারণে “শত্রু” হিসেবে বিবেচনা করতে হবে না।

No comments:
Post a Comment