কেন্দ্রীয় রাজনৈতিক সংগঠন কি? উপজাতীয় রাজনৈতিক সংগঠনের প্রকারভেদ ও উপাদানসমূহ আলোচনা

কেন্দ্রীয় রাজনৈতিক সংগঠন কি? উপজাতীয় রাজনৈতিক সংগঠনের প্রকারভেদ  ও উপাদান আলোচনা


ভূমিকা: নৃবিজ্ঞানের একটি বিশেষ শাখা হলো রাজনৈতিক নৃবিজ্ঞান, যা মানুষের রাজনৈতিক জীবনের বিভিন্ন দিক অনুসন্ধান করে। এটি মূলত মানুষের সমাজে রাজনৈতিক আচরণ, ক্ষমতা, এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলির সম্পর্ক বিশ্লেষণ করে। রাজনীতি শুধুমাত্র রাষ্ট্রের কর্মকাণ্ডের সাথে সম্পর্কিত নয়, বরং এটি মানুষের জীবনযাত্রা, সামাজিক সম্পর্ক, এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সাথেও নিবিড়ভাবে জড়িত। রাজনৈতিক নৃবিজ্ঞান বিশেষভাবে দুটি ধরনের রাজনৈতিক সংগঠন কেন্দ্রীভূত (centralized) ও অ-কেন্দ্রীভূত (decentralized) এর বিশ্লেষণ করে। এই আলোচনায়, আমরা কেন্দ্রীয় রাজনৈতিক সংগঠন ও উপজাতীয় রাজনৈতিক সংগঠনের উপাদানসমূহ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করবো।
কেন্দ্রীয় রাজনৈতিক সংগঠন কি? উপজাতীয় রাজনৈতিক সংগঠনের প্রকারভেদ  ও উপাদানসমূহ


কেন্দ্রীয় রাজনৈতিক সংগঠন: কেন্দ্রীভূত রাজনৈতিক সংগঠন বা Centralized Political System হলো একটি সমাজব্যবস্থার এমন রূপ, যেখানে ক্ষমতা একটি কেন্দ্রে, বা বিশেষত কোনো এক ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর হাতে কেন্দ্রীভূত থাকে। প্রাচীন সমাজগুলোর মধ্যে Band এবং Tribe গোষ্ঠী যখন বড় হতে শুরু করে, তখন সমাজের অভ্যন্তরীণ সমস্যা এবং নতুন প্রযুক্তির বিকাশের সাথে সঙ্গে এক ধরনের কেন্দ্রীভূত শাসনব্যবস্থা গড়ে ওঠে। সমাজের জটিলতা বাড়ানোর সাথে সাথে, মানুষ বুঝতে পারে যে একটি স্থিতিশীল এবং শক্তিশালী নেতৃত্বের প্রয়োজন রয়েছে। তাই, Chiefdom বা State জাতীয় ব্যবস্থাগুলো সময়ের সাথে সাথে উদ্ভূত হয়।

Chiefdom: চিফডোম হলো একটি কেন্দ্রীয় রাজনৈতিক সংগঠন যেখানে সমাজপ্রধান বা Chief সমাজের সমস্ত কার্যক্রম এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের দায়িত্ব পালন করেন। Chief সাধারণত রাজনৈতিক ক্ষমতা, সম্পত্তির বণ্টন, ভূমি সংক্রান্ত বিষয়াদি এবং জনসংখ্যার জীবন-যাত্রার জন্য সিদ্ধান্ত নেন। এই ধরনের সংগঠনে একটি hereditary নেতৃত্ব ব্যবস্থা প্রচলিত, অর্থাৎ ক্ষমতা পূর্বপুরুষ থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে চলে আসে। Chiefdom-এর সাধারণ বৈশিষ্ট্য হলো এটি একটি ছোট রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা হিসেবে গড়ে ওঠে যেখানে জনগণের আনুগত্যে থাকা প্রজাদের জীবন-মৃত্যু চূড়ান্তভাবে Chief-এর সিদ্ধান্তের উপর নির্ভর করে।

রাষ্ট্রব্যবস্থা: কেন্দ্রীভূত শাসনব্যবস্থা একসময় রাষ্ট্রব্যবস্থায় পরিণত হয়। রাষ্ট্র বা State হলো একধরনের রাজনৈতিক সংগঠন যেখানে একটি সরকার জনগণের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করে এবং আইনগত অধিকার প্রয়োগ করে। রাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থা ক্ষমতা প্রয়োগের জন্য সরকারকে স্বীকৃতি দেয় এবং এই ক্ষমতার অধিকার জনগণের জীবন এবং স্বাধীনতা রক্ষায় সহায়ক ভূমিকা পালন করে। রাষ্ট্রে কর্তৃত্ব একক শক্তির হাতে থাকে এবং এটি সাধারণত একটি আধুনিক ও স্থায়ী রাষ্ট্রব্যবস্থা হিসেবে বিকশিত হয়।

রাজনৈতিক সংগঠনের প্রকারভেদ:


কেন্দ্রীভূত ও অ-কেন্দ্রীভূত রাজনৈতিক সংগঠন দুটি প্রধানভাবে পার্থক্য করে:

Un-centralized Political Systemএ ধরনের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় কোনো একক নেতা বা একক গোষ্ঠী জনগণের ওপর শাসন চালায় না। এ ব্যবস্থা সাধারণত ছোট, ঐতিহ্যগত সমাজে দেখা যায়, যেখানে গোষ্ঠীর মধ্যে সম্মিলিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।

Centralized Political System: এই ব্যবস্থায় সমস্ত রাজনৈতিক ক্ষমতা একক শক্তির হাতে কেন্দ্রীভূত থাকে, যা জনগণের শাসন এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। এটি মূলত বড় এবং জটিল সমাজ ব্যবস্থায় লক্ষ্য করা যায়, যেমন Chiefdom বা State।


উপজাতীয় রাজনৈতিক সংগঠনের উপাদানসমূহ-

উপজাতীয় রাজনৈতিক সংগঠনগুলো সাধারণত decentralized অর্থাৎ অ-কেন্দ্রীভূত ব্যবস্থা অনুসরণ করে। এখানে কোনো একক নেতা বা গোষ্ঠীর হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত থাকে না, বরং সিদ্ধান্ত গ্রহণ একযোগভাবে করা হয়। Band বা Tribe নামক সমাজগুলোতে এই ধরনের ব্যবস্থা দেখা যায়। উপজাতীয় সমাজের রাজনৈতিক সংগঠনের কিছু মূল উপাদান নিম্নরূপ:

১. সম্মিলিত নেতৃত্ব: উপজাতীয় সমাজে শক্তি বা কর্তৃত্ব একক ব্যক্তি বা একক গোষ্ঠীর হাতে থাকে না। বরং একাধিক নেতা, সমাজের অভিজ্ঞ বা প্রবীণ সদস্য, সম্মিলিতভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। সাধারণত, নেতা নির্বাচিত হয় দক্ষতা, শ্রদ্ধা বা অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে।

২. বিনিময় ব্যবস্থায় ক্ষমতার ভাগাভাগি: এই সমাজগুলোতে রাজনৈতিক ক্ষমতা একটি বিশেষ শ্রেণির হাতে এককভাবে কেন্দ্রীভূত থাকে না। বরং, গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের সদস্যদের মধ্যে ভূমি, সম্পদ বা কর্তৃত্বের অধিকার ভাগ করা হয়। এমনকি, সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়া সাধারণত সমবায়ী ভিত্তিতে চলে।

৩. সামাজিক ঐক্য ও সম্মান: এই ধরনের সমাজে, সামাজিক সম্পর্ক ও সম্মান প্রতিষ্ঠিত হয় একে অপরের প্রতি সহানুভূতি, সহযোগিতা এবং পারস্পরিক শ্রদ্ধার মাধ্যমে। গোষ্ঠীপ্রধান বা নেতা সাধারণত নিজেদের জনগণের জন্য কাজ করে এবং তাদের সাথে সমঝোতার ভিত্তিতে শাসন পরিচালনা করে।

৪. সহজ শাসনব্যবস্থা: উপজাতীয় রাজনৈতিক সংগঠনগুলো সাধারণত সহজ, অ-জটিল এবং ঋদ্ধ শাসনব্যবস্থা অনুসরণ করে। এ ধরনের সমাজে শাসক বা রাজনৈতিক নেতৃত্বের ভূমিকা সীমিত থাকে, এবং সমাজের চলমান কার্যক্রম প্রায়শই সামাজিক ঐক্য বা ঐতিহ্য অনুসারে পরিচালিত হয়।

৫. গোষ্ঠীগত স্বার্থ: উপজাতীয় সমাজের মধ্যে রাজনৈতিক সংগঠন মূলত গোষ্ঠীর স্বার্থে কেন্দ্রিত হয়। এসব সমাজের জনগণ একে অপরের প্রতি দায়বদ্ধ থাকে এবং তাদের জীবনযাত্রা নির্ভর করে ঐ গোষ্ঠীভিত্তিক সিদ্ধান্তের উপর।

উপসংহার: রাজনৈতিক নৃবিজ্ঞান কেন্দ্রীয় রাজনৈতিক সংগঠন ও উপজাতীয় রাজনৈতিক সংগঠনের মধ্যে পার্থক্য স্পষ্টভাবে বিশ্লেষণ করে। যখন সমাজ ছোট এবং সরল ছিল, তখন রাজনৈতিক সংগঠনও ছিল সহজ এবং শক্তির বন্টন ছিল অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সম্মিলিত। তবে সমাজের জটিলতা বৃদ্ধি পাওয়ার সাথে সাথে, একক শক্তি বা কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয় এবং গড়ে ওঠে কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থা। এছাড়া, উপজাতীয় রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর সহজ এবং অ-কেন্দ্রীভূত ব্যবস্থা সমাজে পারস্পরিক সম্পর্ক এবং সামাজিক ঐক্যের উপর গুরুত্ব দেয়, যা একে অপরের প্রতি সহযোগিতা এবং সম্মানের ভিত্তিতে পরিচালিত হয়।

No comments:

Post a Comment