গোত্র কী? জাতি ও জাতীয়তার মধ্যে পার্থক্য লিখ

গোত্র কী? জাতি ও জাতীয়তার মধ্যে পার্থক্য লিখ

উত্তর: সমাজবদ্ধ মানুষ পরস্পরের সাথে বিভিন্ন সম্পর্কে আবদ্ধ। নানামুখী ও নানা মাত্রিকতার এসব সম্পর্কের ক্ষেত্রে ব্যাপক বৈচিত্র্য পরিলক্ষিত হয়। এসবের মধ্যে রয়েছে রক্তের সম্পর্ক, বৈবাহিক সম্পর্ক, অর্থনৈতিক সম্পর্ক, রাজনৈতিক, সামাজিক বা সাংস্কৃতিক সম্পর্ক। মানবজাতিকে সংঘবদ্ধ বা ঐক্যবদ্ধ করার ক্ষেত্রে এ সকল সম্পর্ক ক্রিয়াশীল ভূমিকা পালন করে থাকে। উল্লিখিত সম্পর্কগুলোর মধ্যে রক্তের সম্পর্কের একটি বিশেষ রূপ হচ্ছে গোত্র বা কৌম।
গোত্র কী? জাতি ও জাতীয়তার মধ্যে পার্থক্য লিখ


গোত্রের সংজ্ঞা: সাধারণ অর্থে গোত্র হচ্ছে এমন একটি গোষ্ঠী, যারা বিভিন্ন আদিপুরুষের বংশধর হিসেবে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে আবদ্ধ হয়ে বসবাস করে। গোত্রের ভিত্তি হচ্ছে অভিন্ন পূর্বপুরুষ এবং এর একক হচ্ছে পরিবার।

গোত্রের সংজ্ঞায় Carol R. Ember Melvin Ember বলেন, "গোত্র হচ্ছে একদল আত্মীয় যারা বিশ্বাস করে তারা একটা সাধারণ পূর্বপুরুষ থেকে এসেছে, যারা পুরুষ হতে পারে আবার মহিলাও হতে পারে। ক্ল্যানের ক্ষেত্রে মাতৃসূত্রীয় বংশধারাকে গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে।"

গোত্রের সংজ্ঞায় ড. রিভার্স বলেছেন, "গোত্র বা কৌম একপাক্ষিক (Unilateral)। বহির্বিবাহকারী এমন সংস্থা যার সদস্যরা কতগুলো ঐক্যের বন্ধনে আবদ্ধ। এ বন্ধনের সাথে এক আদি পূর্বপুরুষ বা এক গোত্র দেবতা বা কোনো নির্দিষ্ট অঞ্চল বা বাসস্থানের প্রত্যক্ষ যোগসূত্র বা সম্বন্ধ বিদ্যমান বলে এর সদস্যরা মনে করে।"

বি. ভূষণ (B. Bhushan) তাঁর 'Dictionary of Sociology' গ্রন্থে বলেছেন, "গোত্র প্রত্যয়টি একসূত্রীয় জ্ঞাতিগোষ্ঠী বোঝাতে ব্যবহৃত হয়। যার ভিত্তি মাতৃসূত্রীয় হতে পারে, আবার পিতৃসূত্রীয় হতে পারে। গোত্রের সদস্যরা বিশ্বাস করে যে, তারা সাধারণত পূর্বপুরুষের বংশধর।"

অধ্যাপক Hoebel ও Frost বলেন, "গোত্র একটি এক পার্শ্বিক বৃহত্তর আত্মীয়ের দল যারা পৌরাণিক এক পূর্বপুরুষ থেকে উদ্ভূত বলে মনে করে।"

ওয়েবস্টারের মতে, "অনেক পরিবার নিয়ে গোত্র গড়ে ওএবং পরিবারের কর্তারা মনে করে যে তারা এক পূর্বপুরুস হতে উদ্বূত।

জাতি ও জাতীয়তার মধ্যে পার্থক্য:

আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীগণ জাতি ও জাতীয়তার মধ্যে পার্থক্য নির্দেশ করে বলেছেন, "জাতীয়তা হলো সেই জনসমষ্টি, যারা এক ভাষা ও সাহিত্য, বংশ ও ধর্ম, ইতিহাস ও ঐতিহ্য, আশা ও আকাঙ্ক্ষা এবং ভৌগোলিক ঐক্যসূত্রে আবদ্ধ ও লালিত।" কিন্তু জাতি হলো সেই জাতীয় সমাজ যা রাজনৈতিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ এবং স্বাধীন অথবা স্বাধীনতা লাভে আগ্রহী। গভীরভাবে ঐক্যবদ্ধ জনসমাজ হলো জাতীয় জনসমাজ এবং রাজনৈতিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ ও রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত জাতীয় জনসমাজ হলো জাতি। নিম্নে জাতি ও জাতীয়তার মধ্যে পার্থক্য আলোচনা করা হলো-

১. জাতীয়তা একটি মানসিক ধারণা, যা জনসাধারণের মাঝে ঐক্যবদ্ধতার জন্ম দেয় এবং যা দ্বারা একটি জনসমাজ নিজেকে অন্য জনসমাজ থেকে পৃথক বলে ভাবতে শেখে। আর জাতি হচ্ছে কতিপয় জনসমষ্টি, যারা জাতীয়তার চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে নির্দিষ্ট এলাকায় বসবাস করে এবং স্বাধীন।

২. জাতীয়তা একটি মানসিক ধারণা, যা জনসাধারণের মধ্যে ঐক্যানুভূতি গড়ে তোলে। এতে কোনো রাজনৈতিক সংগঠন নেই। কিন্তু জাতি গঠন কখনো রাজনৈতিক সংগঠন ছাড়া হয় না।

৩. জাতি হচ্ছে একটি সংগঠিত জনসমষ্টি, যারা স্বাধীন ও - সার্বভৌম। কিছু জাতীয়তার ধারণায় উদ্বুদ্ধ জনসমষ্টি সর্বদা স্বাধীন নয় আর স্বাধীনতা ব্যতীত সার্বভৌমত্ব চিন্তা করা যায় না।

৪. রাষ্ট্রচিন্তাবিদরা মনে করেন, Plato, Aristotle এর সময় থেকে জাতি সংগঠিত হতে শুরু করে। কিন্তু জাতীয়তাবাদের ধারণা উৎপত্তি হয় ষোড়শ শতকে এক আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তার জনক Machiavelli-এর দর্শন থেকে।

৫. জাতীয়তা গঠনের জন্য কতকগুলো সাধারণ সূত্রের মিল থাকতে হয়। যেমন ভাষা, সাহিত্য, ইতিহাস, ঐতিহ্য ইত্যাদি। কিন্তু জাতি গঠনের জন্য প্রয়োজন হয় জাতীয়তাবোধের।

৬. জাতীয়তা হলো জাতি গঠনের প্রাথমিক উপাদান। জাতীয়তার জন্য মানসিক ধারণাই প্রধান ভূমিকা পালন করে। কিন্তু জাতির পরিধি ব্যাপক। জাতি গঠনের জন্য জনসমাজ, মানসিক ঐক্যানুভূতি ও রাজনৈতিক সংগঠন প্রয়োজন।

৭. জাতীয়তা হলো একটি প্রাথমিক পদক্ষেপ। আর জাতি হলো জাতীয়তার চূড়ান্ত পর্যায়।

৮. জাতীয়তা খুব বেশি সুসংহত নাও হতে পারে। কিন্তু জাতি সুসংহত হবে এবং স্বাধীন কিংবা স্বাধীনতা সংগ্রামে লিপ্ত থাকবে।

৯. জাতীয়তা হচ্ছে একটি চেতনা আর জাতি একটি সার্বভৌম সংগঠন। অর্থাৎ, জাতীয়তা একটি ক্ষুদ্র ধারণা। পক্ষান্তরে, আতি একটি ব্যাপক ধারণা।

১০. জাতীয়তা হচ্ছে একটি মানসিক ধারণা বিশেষ। আজ জাতি হচ্ছে মানসিক ধারণার রাজনৈতিক সংগঠন, স্বাধীন হওয়ার প্রচেষ্টা ইত্যাদির যোগফল।

উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, সংখ্যালঘু সম্প্রদায় বৃহত্তর সমাজের একটি অংশ। মূল জনগোষ্ঠী থেকে এয়া আলানা। এদের রয়েছে আলাদা বৈশিষ্ট্য, স্বতন্ত্র দৈহিক গঠন ও সংস্কৃতি। এদের নির্ধারণ করা হয় মূলত সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যের আলোকে। পূর্বপুরুষ ও সাংস্কৃতিকভাবেই এরা পরিচিত বেশি। উপরিউক্ত আলোচনায় জাতি ও জাতীয়তার পার্থক্য স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। তবে এদের মধ্যে ঘনিষ্ঠ মিলও রয়েছে। কেননা উভয়েই একে অপরের ওপর নির্ভরশীল।

No comments:

Post a Comment