জ্ঞানের সাগর ও সমাজ সংস্কারের পথিকৃৎ বাংলা গদ্যের জনক ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের জীবনী
ভূমিকা: ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (১৮২০ – ১৮৯১) ছিলেন উনিশ শতকের অন্যতম বিশিষ্ট বাঙালি শিক্ষাবিদ, সমাজ সংস্কারক, লেখক এবং গদ্যকার। তাঁর অগাধ পাণ্ডিত্য, মানবতাবাদী চিন্তা ও নির্ভীক সমাজ সংস্কারমূলক কার্যক্রম তাঁকে বাঙালি জাতির ইতিহাসে এক অনন্য উচ্চতায় প্রতিষ্ঠিত করেছে। সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যে অসামান্য দক্ষতার জন্য তিনি “বিদ্যাসাগর” (অর্থাৎ জ্ঞানের সাগর) উপাধি লাভ করেন।
জন্ম ও প্রারম্ভিক জীবন: ঈশ্বরচন্দ্রের জন্ম ১৮২০ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর (১২ আশ্বিন ১২২৭ বঙ্গাব্দ) পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুর জেলার বীরসিংহ গ্রামে। তাঁর পিতা ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন দরিদ্র ব্রাহ্মণ, যিনি জীবিকার জন্য কলকাতায় পুরোহিতের কাজ করতেন। মাতা ভগবতী দেবী ছিলেন ধর্মপরায়ণ ও স্নেহময়ী নারী, যিনি ছেলেকে সততা ও পরিশ্রমের শিক্ষা দেন। অত্যন্ত দারিদ্র্যের মধ্যেও ঈশ্বরচন্দ্র অদম্য ইচ্ছাশক্তি দিয়ে শিক্ষা অর্জনের জন্য ছোটবেলায় পায়ে হেঁটে বীরসিংহ থেকে কলকাতায় আসেন।
শিক্ষা জীবন: ১৮২৮ সালে তিনি কলকাতার সংস্কৃত কলেজে ভর্তি হন। সেখানে ব্যাকরণ, সাহিত্য, অলংকার শাস্ত্র, বেদান্ত, স্মৃতি, ও জ্যোতির্বিদ্যা বিষয়ে গভীর অধ্যয়ন করেন। ১৮৩৯ সালে তাঁর অসাধারণ পাণ্ডিত্যের স্বীকৃতিস্বরূপ কলেজ থেকেই “বিদ্যাসাগর” উপাধি লাভ করেন।
তিনি পরবর্তীতে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজেও অধ্যয়ন করেন এবং ১৮৪১ সালে সংস্কৃত সাহিত্যে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন।
বিবাহ: চৌদ্দ বছর বয়সে তিনি ১৮৩৪ সালে দীনময়ী দেবীর সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। তাঁদের একমাত্র পুত্র ছিলেন নারায়ণ চন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়।
কর্মজীবন: বিদ্যাসাগর সংস্কৃত কলেজে শিক্ষকতা দিয়ে কর্মজীবন শুরু করেন। অল্প বয়সেই তিনি অধ্যাপক থেকে অধ্যক্ষের পদে উন্নীত হন। অধ্যক্ষ হিসেবে তিনি কলেজে শিক্ষাগত ও প্রশাসনিক সংস্কার আনেন।তাঁর উদ্যোগে কলেজে সকল শ্রেণির হিন্দু ছাত্রদের ভর্তি হওয়ার সুযোগ তৈরি হয়, যা আগে কেবল ব্রাহ্মণ ও বৈদ্যদের জন্য সীমাবদ্ধ ছিল। এভাবে তিনি শিক্ষাক্ষেত্রে সামাজিক সমতা প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন।
সমাজ সংস্কারে অবদান
বিধবা বিবাহ: ঊনবিংশ শতকে হিন্দু সমাজে বিধবারা অমানবিক জীবনযাপন করতেন। বিদ্যাসাগর তাঁদের পুনর্বিবাহের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করেন। তাঁর নিরলস প্রচেষ্টায় ১৮৫৬ সালে ব্রিটিশ সরকার “হিন্দু বিধবা পুনর্বিবাহ আইন” পাস করে। এটি ভারতীয় সমাজে নারী স্বাধীনতার এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ ছিল।
বাল্যবিবাহের বিরোধিতা: তিনি বাল্যবিবাহের কুফল সম্পর্কে সমাজকে সচেতন করেন। প্রবন্ধ ও বক্তৃতার মাধ্যমে তিনি দেখান যে, অল্পবয়সে বিবাহ নারী ও সমাজ উভয়ের জন্যই ক্ষতিকর।
নারী শিক্ষা বিস্তারে ভূমিকা: নারী শিক্ষার প্রসারে বিদ্যাসাগরের ভূমিকা অনন্য। তাঁর উদ্যোগেই কলকাতায় বহু বালিকা বিদ্যালয় স্থাপিত হয়। তিনি বিশ্বাস করতেন, “নারী শিক্ষিত হলে সমাজও শিক্ষিত হবে।”
✍️ সাহিত্যকর্ম ও বাংলা গদ্যে অবদান:
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে বাংলা গদ্যের জনক বলা হয়। তিনি বাংলা ভাষাকে তৎকালীন কৃত্রিম ও জটিল অবস্থা থেকে মুক্ত করে সরল, প্রাঞ্জল ও যুক্তিপূর্ণ রূপে প্রতিষ্ঠিত করেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁকে "বাংলা গদ্যের প্রথম শিল্পী" হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। বাংলা লেখায় যতিচিহ্ন ও শৃঙ্খলার ব্যবহার প্রবর্তনের কৃতিত্বও তাঁর।
মৌলিক রচনা:
- প্রভাবতী সম্ভাষণ: বাংলা সাহিত্যের প্রথম মৌলিক শোকগাথা, যা তিনি বন্ধুর কন্যার মৃত্যুতে রচনা করেন।
- অতি অল্প হইল ও আবার অতি অল্প হইল: সমাজের নানা অসঙ্গতি ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদমূলক রচনা।
- ব্রজবিলাস: সমাজ ও মানবজীবনের নানা দিক নিয়ে লেখা একটি মৌলিক গ্রন্থ।
- বিধবা বিবাহ ও যশোরের হিন্দু ধর্মরক্ষিণী সভা: রক্ষণশীলতার বিরুদ্ধে যুক্তিনির্ভর প্রতিবাদ।
- রত্ন পরীক্ষা: নৈতিকতা ও মানবমূল্যবোধ বিষয়ক রচনা।
- বর্ণপরিচয় (প্রথম ও দ্বিতীয় ভাগ): শিশুদের জন্য লেখা বাংলা শিক্ষার ভিত্তিপ্রস্তরস্বরূপ পাঠ্যপুস্তক।
- বোধোদয়: নৈতিক শিক্ষা ও প্রাথমিক পাঠের সহায়ক বই।
- আত্মচরিত: বাংলা সাহিত্যের প্রথম আত্মজীবনীমূলক গদ্য রচনা।
অন্যান্য শিক্ষামূলক গ্রন্থ:
- কথামালা: শিশুদের গল্প সংকলন।
- আখ্যানমঞ্জরী: বিভিন্ন শিক্ষণীয় আখ্যানের সমাহার।
- ব্যাকরণ কৌমুদী: বাংলা ব্যাকরণের একটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ।
অনুবাদমূলক রচনা:
বিদ্যাসাগর বহু বিশ্বসাহিত্য বাংলায় অনুবাদ করেন
- শকুন্তলা: কালিদাসের অভিজ্ঞানশকুন্তলম নাটকের অনুবাদ।
- সীতার বনবাস: সংস্কৃত সাহিত্যের অনুবাদ।
- বেতাল পঞ্চবিংশতি: হিন্দি কাহিনি অবলম্বনে অনূদিত গ্রন্থ।
- ভ্রান্তিবিলাস: শেক্সপিয়ারের Comedy of Errors-এর বাংলা অনুবাদ।
এইসব অনুবাদ বাংলা সাহিত্যে নতুন ধারা সৃষ্টি করে এবং পাঠকদের বিশ্বসাহিত্যের সঙ্গে পরিচিত করে তোলে।
বিদ্যাসাগরের জীবনদর্শন: ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ছিলেন এক অদম্য মানবতাবাদী। দরিদ্র ছাত্রদের সহায়তা করা, বিধবাদের পাশে দাঁড়ানো, নারীর প্রতি সম্মান ও শিক্ষার সুযোগ তৈরি করা এসব কাজ তাঁর জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল। তিনি বিশ্বাস করতেন, “মানুষের সেবাই পরম ধর্ম।”
মৃত্যু: ১৮৮৮ সালে তাঁর স্ত্রী দীনময়ী দেবী মৃত্যুবরণ করেন। এরপর তিনি কলকাতায় কিছুদিন নিভৃত জীবনযাপন করেন। ১৮৯১ সালের ২৯ জুলাই (১৩ শ্রাবণ ১২৯৭ বঙ্গাব্দ) এই মহান মানুষ পরলোকগমন করেন।
উত্তরাধিকার ও স্মৃতি: বিদ্যাসাগর শুধু একজন ব্যক্তি নন, তিনি একটি যুগের প্রতীক। বাংলা সমাজে আধুনিক শিক্ষার বিস্তার, নারী মুক্তি আন্দোলন, এবং মানবতাবাদী চিন্তাধারার সূচনা তাঁর হাত ধরেই। তাঁর লেখা বর্ণপরিচয় আজও শিশু শিক্ষার প্রথম পাঠ্যপুস্তক হিসেবে অমর হয়ে আছে
বাংলা গদ্যের জনক হিসেবে তাঁর নাম উচ্চারণ মানেই যুক্তি, মানবতা ও প্রগতির এক আলোকবর্তিকা

No comments:
Post a Comment