এথনিক গ্রুপ কি? এথনিক সম্প্রদায়ের বৈশিষ্ট্যসমূহ লেখ।

এথনিক গ্রুপের ধারণা ও বৈশিষ্ট্যসমূহ লেখ।

ভূমিকা: জাতিতত্ত্বের আলোচনায় এথনিক গোষ্ঠী একটি ব্যাপক ও বিস্তৃত ধারণা। সাধারণত এথনিক গোষ্ঠীর লোকেরা একটি স্বতন্ত্র সংস্কৃতির অধিকারী হওয়ায় তারা সবসময় নিজেদেরকে অন্যদের থেকে আলাদা বলে মনে করে। এথনিক গোষ্ঠীকে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করতে গেলে আমরা দেখি যে এটি প্রথমৃত একটি অসংগঠিত ও বিচ্ছিন্ন গোষ্ঠী হিসেবে পরিচিত ছিল। তারা ছিল রাষ্ট্রের সকল উন্নয়ন কর্মকান্ডের মূল স্রোতধারা থেকে বিচ্ছিন্ন। পরবর্তীতে তারা আস্তে আস্তে একটি বৃহৎ শক্তি হিসেবে সমাজে আবির্ভূত হয় এবং সেদেশের সমাজ এবং রাষ্ট্রীয় কার্যাবলিতে গভীর প্রভাব বিস্তার করে।

এথনিক গ্রুপ কি? এথনিক সম্প্রদায়ের বৈশিষ্ট্যসমূহ লেখ।

এথনিক গ্রুপ:

"এথনিক" শব্দটি এসেছে গ্রিক শব্দ Ethnos থেকে, যার অর্থ "জাতি" বা "গোষ্ঠী"। সমাজবিজ্ঞানের পরিভাষায়, এথনিক গ্রুপ হলো এমন একটি মানবগোষ্ঠী, যারা নিজেদের একটি ভিন্ন জাতিগত, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয়, ভাষাগত বা ঐতিহাসিক পরিচয়ের ভিত্তিতে অন্যদের থেকে আলাদা করে দেখে এবং নিজেদের স্বতন্ত্র পরিচয় রক্ষা করে চলে।

জার্মান সমাজবিজ্ঞানী ফার্ডিনান্ড টনিস (Ferdinand Tönnies) "Gemeinschaft" বা সম্প্রদায়ের ধারণা ব্যবহার করে দেখান, কীভাবে একটি সমাজজীবনে ব্যক্তিগত সম্পর্ক, ঐতিহ্য এবং নৈতিক মূল্যবোধের ভিত্তিতে গোষ্ঠী তৈরি হয়।

আধুনিক সমাজবিজ্ঞানে এথনিক গোষ্ঠীর আলোচনা:

বিশিষ্ট নৃতত্ত্ববিদ ফ্রেডরিক বার্থ (Fredrik Barth) ১৯৬৯ সালে প্রকাশিত ‘Ethnic Groups and Boundaries’ গ্রন্থে বলেন, “এথনিক গোষ্ঠীর বৈশিষ্ট্য হলো, তারা নিজেদের সংস্কৃতি ও পরিচয় ধরে রাখার জন্য নির্দিষ্ট সীমারেখা তৈরি করে, এবং তা ধরে রাখার চেষ্টা করে।” তার মতে, এথনিক গোষ্ঠীর সীমারেখা সাংস্কৃতিকভাবে তৈরি হয়, যা অন্যদের থেকে নিজেদের আলাদা করার উপায় হিসেবে কাজ করে।

অন্যদিকে, ১৯৩৮ সালে রোনাল্ড কোহেন (Ronald Cohen) বলেন, আমরা সাধারণত যেভাবে এথনিক গোষ্ঠীগুলিকে আদিবাসী বা প্রথাগত জনগোষ্ঠী হিসেবে দেখি, তা সঠিক নয়। অনেক সময় বহিরাগতদের তৈরি করা ভুল সংজ্ঞা বা শ্রেণিবিন্যাস গোষ্ঠীগুলোর প্রকৃত পরিচয় বিকৃত করে ফেলে।

এথনিক গোষ্ঠীর বৈশিষ্ট্যসমূহ:

এথনিক গোষ্ঠীর পরিচয় বোঝার জন্য তাদের কিছু মৌলিক বৈশিষ্ট্য জানা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ বৈশিষ্ট্যগুলো সাধারণত প্রাকৃতিক বা শারীরিক নয়, বরং সামাজিকভাবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে অনুসৃত হয়ে আসা উপাদানের সমষ্টি। নিচে এসব বৈশিষ্ট্য বিস্তারিতভাবে উপস্থাপন করা হলো:

১. সংখ্যালঘু সম্প্রদায়:

এথনিক গোষ্ঠীর প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো, এটি একটি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়। বর্ণগোষ্ঠী যত বৃহৎ হোক তা কোনো দেশের হচ্ছে এটি বৃহৎ কোনো সমাজ বা জাতির অন্তর্গত একট আতি বা মূল জনগোষ্ঠী অপেক্ষা বৃহৎ নয়।

২. খাদ্যাভ্যাস:

স্বতন্ত্র খাদ্যাভ্যাস গড়ে তোলা এখনিও গোষ্ঠীর একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য। তারা সর্বদাই মূল জনগোষ্ঠী থেকে কিছুটা হলেও স্বতন্ত্র খাদ্যাভ্যাসে অভ্যস্ত। যেমন- আমাদের দেশের সাঁওতালরা কাঁকড়া, শূকর, করমণ, ইঁদুর ইত্যাদি খেয়ে থাকে কিন্তু আমরা এসবে অভ্যন্ত নই। সুতরাং, খাদ্য গ্রহণের স্বাতন্ত্র্য মূল জনগোষ্ঠী থেকে তাদেরকে পৃথক করে থাকে।

৩. পরিবারের ধরন:

পরিবারের আকার আকৃতি এ পদ প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে এখনিক গোষ্ঠীর মধ্যে ভিন্নতা লক্ষ করা যায়। যেমন- গারো পরিবার মাতৃপ্রধান। পরিবারের ক্ষময়া তাত্ত্বিকভাবে স্ত্রীর হাতেই ন্যস্ত। পরিবারের সম্পত্তির মালিক স্ত্রী। তবে ব্যবস্থাপনার মালিক স্বামী। তাই সিদ্ধান্ত যৌগভাবেই নিয়ে হয়। চাকমা সমাজে বহুবিবাহ প্রথা বিদ্যমান, একজন পুরুষ অনেককে বিয়ে করতে পারে।

৪. পোশাক-পরিচ্ছদ:

এখনিক সম্প্রদায়ের লোকনের মধ্যে পোশাক-পরিচ্ছদের ক্ষেত্রে ভিন্নতা লক্ষ করা যায়। এমনি স্থান- কালভেদে পোশাকের ভিন্নতা দেখা যায়। সাঁওতাল মেয়েরা মোটা শাড়ি মুটুকরো করে পরে, আয় পুরুষ ও ছোট আোলনা স্মৃতি ও ল্যাংটি পরে। সাঁওতাল নারী পুরুষ সবার হাতে সাতের ছাপ থাকে। এটা তানের সমাজের একটা বৈশিষ্টী।

৫. সৌন্দর্যের প্রকাশ:

দেশ ও অঞ্চলভেদে বিভিন্ন এখনিত গোষ্ঠীর সৌন্দর্যের প্রকৃতি বিভিন্ন রকম হতে পারে। যেমন-আফ্রিকার কিছু এখনিক গোষ্ঠী আছে, যাদের, মোয়ায়া গালে আআঁচড় কেটে তাদের সৌন্দর্যের বহিঃপ্রকাশ ঘটায়। আবার কেউ কেউ নিচের ঠোঁট ছিদ্র করে তাদের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে।

৬. ধর্ম:

এথনিক গোষ্ঠীগুলোর একটি নির্দিষ্ট ধর্ম থাকে, যা সাধারণ জনগোষ্ঠী থেকে আলাদা হয়ে থাকে। অনেক সময় ধর্মের ভিন্নতার কারণে এথনিক গোষ্ঠীর জন্ম হতে পারে।

৭. বিনোদনের ধরন:

এথনিক গোষ্ঠীর মধ্যে আবা অনুভূতি, আনন্দ-বেদনা, সুখ-দুঃখ প্রকাশের ক্ষেত্রেও পাগল দেখা যায়। যেমন চাকমাদের নিজস্ব সংগীত ও সাহিল রয়েছে। এর মাধ্যমে তারা মনের খোরাক মেটায়। সাঁওতালগ বাঁশি বাজায় এবং বাঁশির সুরে মেতে ওঠে। তা ছাড়া বিদ্যি পূজা-পার্বণ ও সামাজিক উৎসবে নাচ অনুষ্ঠিত হয়।

একটি সম্প্রদায় এক একটি বংশের ধারা বহন করে চলে। 

৮. গোষ্ঠীগত বা কুলগত দিক:

প্রতোর প্রতিগত সম্প্রদায়েরই নিজস্ব বংশ এবং পূর্বপুরুষের ধারা রয়েছে।এ তাই একই বংশের পরস্পরা একটি জাতিগত সম্প্রদায়ের অন্যতয় বৈশিষ্টা। মূলত এরই মাধ্যমে প্রতিগ্রী বংশের একটি স্বতন্ত্র পরিচয় ফুটে ওঠে। যেমন, শ্রীলঙ্কায় তামিলদের পূর্বপুরুষরা দায়তো তামিলদেরই বংশ বলে ধরে নেওয়া হয়।।

৯. সংস্কৃতি:

প্রত্যেক এথনিক গোষ্ঠীরই একটি পৃথক সংস্কৃতি রয়েছে, যার ওপর ভিত্তি করে তাদের সমাজব্যবস্থা গড়ে ওঠে। এ সম্প্রদায়ের কেউ কেউ সূর্যকে আবার কেউ কেউ চন্দ্রকে পূজা করে। আয় সাঁওতালরা তাদের দেবতা মারামুরোকে সন্তুষ্ট বন্যার জন্য সাদা ছাগল বা সান্য মোরগ তার নামে উৎসর্গ করে, যা রীতিতে পরিণত হয়ে গেছে। যারা এথনিক গোষ্ঠীর নেতৃত্ব দেয় তারা সংস্কৃতিকে বিশেষ গুরুত্ব দেয় এবং এর ওপর ভিত্তি। করে এমনিক গোষ্ঠী গড়ে ওঠে।

১০. ভাষা:

ভাষাগত পার্থক্য এথনিক গোষ্ঠীয় একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। এথনিক গোষ্ঠী গড়ে উঠার পেছনে ভাষার উপস্থিতি অপরিহার্য। এর মাধ্যমেই তাদের মধ্যে ঐকাবোল ও আমরা এফ এই বোধটুকু তৈরি হয়। এখনিক গোষ্ঠীগুলোয় সাধারণত স্বতন্ত্র ভাষা থাকে। যেমন- তালিমদের সিংহলিদের থেকে পৃথক ভাষা রয়েছে। এথনিক শ্রীলঙ্কার আতীয় সংহতি এবং রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক উন্নতির পথে অন্যতম প্রতীক হচ্ছে সিংহলি ও তালিমদের ভাষা সংস্কৃতিগত বিরোধ।

১১. অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড:

এথনিক গোষ্ঠীগুলোর অর্থনৈতিক জীবনপ্রণালি এবং উপাদান ও সংগ্রহ প্রক্রিয়ার মধ্যে বিভিন্ন রূপ লক্ষ করা যায়। তাদের মধ্যেও উৎপাদন, সংগ্রহ এবং সরবরাহ কৌশলও এক রকম হয় না। যেমন চাকমারা কৃষিকাজের পাশাপাশি জুমচাষ করে জীবিকা নির্বাহ করে আর মারমারা কৃষিকাজের পাশাপাশি কাপড় ও বিড়ি সিগারেট তৈরি করে এবং সাঁওতালরা চা বাগানের কাজ, কুলির কাজ এবং মাটি কাটার কাজ করে থাকে।

১২. রাজনীতি:

বিভিন্ন দেশে বিরাজমান এমনকি গোষ্ঠীগুলো তাদের দাবি-দাওয়া আদায়ের ক্ষেত্রে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করে এবং বহির্বিশ্বে তাদের পরিচিতি তুলে ধরার জন্য অনেক সময় রাজনৈতিক সংগঠন গড়ে তোলে। আর ঐ সংগঠন জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করতে এবং সচেতনতা বৃদ্ধি করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। আর এর মাধ্যমেই এথনিক গোষ্ঠীগুলো পর্যায়ক্রমে জোরালো আন্দোলন গড়ে তোলে এবং অনেক সময় স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতেও সক্ষম হয়। উদাহরণ হিসেবে শ্রীলঙ্কার LITTE- (লিবারেশন টাইগার্স অফ তামিল ইলম) এর কথা বলা যায়।।

১৩. আঞ্চলিক প্রকৃতি:

এথনিক গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে শুধু জামাগত পার্থক্য নয়, আকার আকৃতিগত পার্থক্য বিদ্যমান। যেমন-চাকমারা দেখতে এক রকম, আবার সাঁওতালদের গায়ের রং কালো ও নাক চ্যাপটা, পেট মোটা এবং চুল কোকড়ানো থাকে।

উপসংহার: এথনিক গোষ্ঠী মানবসমাজের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। ইতিহাস, সংস্কৃতি, ভাষা, ধর্ম, জীবনধারা ও অর্থনৈতিক কার্যক্রমের ভিন্নতার মাধ্যমে তারা নিজেদের স্বতন্ত্র পরিচয় গড়ে তোলে। যদিও এদের মধ্যে অনেক সময় বিভাজন, বৈষম্য ও সামাজিক বিচ্ছিন্নতা বিদ্যমান থাকে, তবুও একটি সমাজের বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি, মানবিক সৌন্দর্য এবং সহাবস্থানের আদর্শ গঠনে এদের ভূমিকা অনস্বীকার্য।

বর্তমান বিশ্বে জাতি-রাষ্ট্রের ধারণা ক্রমশঃ বদলে যাচ্ছে। এখন একটি রাষ্ট্রে বহু জাতিসত্তা, বহু ভাষা ও সংস্কৃতির মানুষ সহাবস্থান করছে। তাই, রাষ্ট্রের কর্তব্য হলো এথনিক গোষ্ঠীগুলোর ভাষা, সংস্কৃতি ও জীবনযাত্রার প্রতি সম্মান প্রদর্শন এবং তাদের সার্বিক উন্নয়নে সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি করা।

No comments:

Post a Comment