জনসংখ্যা সংক্রান্ত কায়রো সম্মেলনের সাফল্য ও ব্যর্থতা মূল্যায়ন কর।

জনসংখ্যা সংক্রান্ত কায়রো সম্মেলনের সাফল্য ও ব্যর্থতা মূল্যায়ন কর।

জনসংখ্যা সংক্রান্ত কায়রো সম্মেলনের সাফল্য ও ব্যর্থতা আলোচনা কর।

ভূমিকাঃ ১৯৯৪ সালের ১ থেকে ৫ সেপ্টেম্বর UNFPA  এর উদ্যোগে মিশরের রাজধানী কায়রাতে আন্তর্জাতিক জনসংখ্যা ও উন্নয়ন সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। বিভিন্ন দেশের সরকার, এনজিও এবং গণমাধ্যমসহ ২০০০ প্রতিনিধি এ সম্মেলনে যোগদান করে। সর্বজনীন শিক্ষা বিস্তার মাতৃ ও শিশু মৃত্যুহার হ্রাস ও প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা প্রভৃতি বিষয় এ সম্মেলনে অন্যতম লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল।

জনসংখ্যা সংক্রান্ত কায়রো সম্মেলনের সাফল্য ও ব্যর্থতা মূল্যায়ন কর।


জনসংখ্যা সংক্রান্ত কায়রো সম্মেলনের সাফল্য

 এ সম্মেলনের অনেকগুলো সাফল্য লক্ষ্য করা যায় যা নিম্নরূপ তুলে ধরা হলো।

১। শিশু ও নবজাতকের মৃত্যুহার হ্রাসঃ এ সম্মেলনে শিশু নবজাতকের মৃত্যুহার এক-তৃতীয়াংশ কমিয়ে আনার কথা বলেছে। এখানে প্রতি ১০০০ জনে শিশু মৃত্যু ৫০ থেকে ৭০ জনে নামিয়ে আনার কথা বলা হয় এবং ২০০০ সালের মধ্যে এ সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়। ২০১৫ সালের মধ্যে শিশু মৃত্যু প্রতি হাজারে ৩৫ জনে আনার কথা হয়। এক্ষেত্রে এ সম্মেলন অনেকাংশেই সফল হয়েছে। 

২। সর্বজনীন শিক্ষাঃ সম্মেলনের অন্যতম লক্ষ্য ছিল ২০১৫ সালের মধ্যে সকল দেশে সর্বজনীন শিক্ষা নিশ্চিত করা। এছাড়াও কায়রো সম্মেলন নারী শিক্ষার প্রসারে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষায় তাদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি করেছে।  আবার অনেকের জন্য কারিগরি শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছে।

৩। মাতৃ মৃত্যু হার হ্রাসঃ মাতৃ মৃত্যু হার ২০১৫ সালের মধ্য তারা অর্ধেকে নামিয়ে আনার চেষ্টা করেছে। এছাড়াও তারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ভৌগোলিক অঞ্চল,আর্থসামাজিক ও নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর মধ্যকার মাতৃসেবার বৈষম্যগুলো নিরসনের উপর জোর দিয়ে কাজ করে যাচ্ছে।

৪। পরিবার পরিকল্পনা সহ প্রজনন ও যৌন স্বাস্থ্য সেবা সামগ্রির সহজলভ্যতা তৈরি করাঃ মানুষের নিকট সহজে পরিবার পরিকল্পনা সহ যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা সহজে প্রাপ্যতার সুযোগ সৃষ্টি এ সম্মেলনের অন্যতম সাফল্য। পরিবার পরিকল্পনা, পরামর্শ, গর্ভবতী মায়ের যত্ন, নিরাপদ প্রসব, প্রসব পরবর্তী সেবা, বন্ধ্যাত্ব চিকিৎসা, গর্ভপাতের চিকিৎসা প্রজনন স্বাস্থ্য চিকিৎসা, যৌন রোগের চিকিৎসা প্রভৃতি গুরুত্বের সাথে এ সম্মেলন কার্যকর করেছে।

৫। নারীর অবস্থা পরিবর্তনঃ জনসংখ্যা সমস্যা সমাধানের অন্যতম উপায় ছিল নারীকে শিক্ষার মাধ্যমে সচেতন ও কর্মমুখী করে তোলা। নারীদের যথাযথ প্রশিক্ষণ, ঋণ, সম্পত্তি- সম্পদ ও ভালো কর্মসংস্থান সহ নারীর ক্ষমতায়ন বৃদ্ধিতে এ সম্মেলন জোরালো ভুমিকা রেখেছে। ফলে, নারী কর্ম ক্ষেত্রে প্রবেশ করাই জনসংখ্যা তুলনামূলক কম বাড়ছে।


৬। জনসংখ্যা নীতি ও কর্মসূচিঃ কায়রো সম্মেলনে জনসংখ্যা সম্পর্কিত নীতি ও কর্মসূচি গৃহীত হয় । এতে পরিবার পরিকল্পনা, পারিবারিক উন্নতি, জনসংখ্যা বন্টন ও অভিবাসন এবং জনসংখ্যা, পরিবেশ ও উন্নয়ন ঘটানোর চেষ্টা করা হয়। এ প্রচেষ্টা আজও অব্যাহত রয়েছে তবে অনেক অংশেই এই কায়রো সম্মেলন সাফল্য লাভ করেছে।


জনসংখ্যা সংক্রান্ত কায়রো সম্মেলনের ব্যর্থতা

 কায়রো সম্মেলনের অনেকগুলি  সফলতা থাকলেও বেশ কিছু ব্যর্থতা পরিলক্ষিত হয়েছে।

১। জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও জননমিতিক কাঠামোঃ বিশ্ব জনসংখ্যা বিস্ফোরণ এখনো স্থিতিশীল অবস্থায় আসেনি। বর্তমান বিশ্বে জনসংখ্যা প্রায় ৮০০ কোটি। এখনো জননমিতির সুস্পষ্ট কাঠামো তৈরি করা হয়নি।তাই এ কায়রো সম্মেলন তার কার্যকারিতা সম্পূর্ণরূপে বাস্তবায়ন ঘটাতে পারেনি। 

২। জনসংখ্যা বন্টন ও অভিবাসনঃ কায়রো সম্মেলনে বলা হয়েছিল যে, জনসংখ্যার সুষম বন্টন করা হবে এবং সঠিক অভিবাসনের মাধ্যমে জনসংখ্যার ভারসাম্য নিশ্চিত করা হবে। ২০১৫ সালে ২০ বছর মেয়াদী সম্মেলন শেষ হলেও তা এখনো কার্যকর রয়েছে। এর পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন এখনো ঘটেনি। 

৩। শিক্ষার প্রসারঃ এক্ষেত্রে জনসংখ্যাধিক্য উন্নয়নশীল দেশে নারীর পর্যাপ্ত শিক্ষার প্রসার ছিল একটি বিরাট চ্যালেঞ্জ।  বিশ্ব জনসংখ্যা বৃদ্ধির জন্য উন্নয়নশীল দেশগুলোতে উন্নত  দেশের তুলনায় শিক্ষার হার অনেক কম আবার শিক্ষার মান অবশ্যম্ভাবীভাবে হ্রাস পেয়েছে। শিক্ষার মানের প্রশ্ন এ কায়রো সম্মেলন ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে।

৪। জনসংখ্যা, পরিবেশ ও উন্নয়ন ঘাটতিঃ কায়রো সম্মেলন জনসংখ্যার যে টেকসই উন্নয়নের কথা তাদের নীতিতে অন্তর্ভুক্ত করেছিল তা আজও সফল হয়নি।জনসংখ্যার ভবিষ্যৎ নির্ধারণের টেকসই উন্নয়ন অতীব জরুরি। অথচ পরিবেশ আজ হুমকির সম্মুখীন।

৫। জেন্ডার বৈষম্যঃ কায়রো সম্মেলনে জেন্ডার সম্পর্ক ও পুরুষের দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতনতার কথা বলেছিল কিন্তু জনসংখ্যার জন্য আধুনিক সমাজ বিনির্মাণে উন্নয়নশীল দেশে আজও জেন্ডার বৈষম্য দূর করা যায়নি।

৬। দারিদ্র্য সমস্যাঃ কায়রো সম্মেলন ১৯৯৪ সালে দারিদ্র্য দূরীকরণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশগুলোতে আজও দারিদ্র দূরীকরণ সম্ভব হয়নি। বাংলাদেশের চরম মুদ্রাস্ফীতি ও আফ্রিকার স্বাস্থ্য ও খাদ্য ঘাটতির চিত্র এর অন্যতম উদাহরণ। এছাড়া উন্নয়নশীল দেশের মূল্যবোধের ব্যাপক ঘাটতি তৈরি হয়েছে। 

উপসংহারঃ পরিশেষে বলা যায় যে কায়রো সম্মেলন জনসংখ্যা ও উন্নয়ন বিষয়ক আলোচনার একটি মাইলফলক। ২০১৫ সালে ২০ বছর মেয়াদী এ সম্মেলন শেষ হলেও তা এখনো কার্যকারী রয়েছে। জনসংখ্যা সমস্যার মোকাবেলায় এ সম্মেলনের কর্মসূচি গুলো আগামী দিনে আমাদের সহায়ক হবে তাই এর গুরুত্ব নিঃসন্দেহে অধিক কার্যোপযোগী।

Post a Comment (0)
Previous Post Next Post