সোভিয়েত ইউনিয়ন কি? সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ও তৃতীয় বিশ্বের দেশসমূহের উপর প্রভাব।

সোভিয়েত ইউনিয়ন কি? সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ও তৃতীয় বিশ্বের দেশসমূহের উপর প্রভাব।

সোভিয়েত ইউনিয়নের পরিচয় দাও


ভূমিকাঃ বিশ্ব ইতিহাসের সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র সমূহের ইউনিয়ন বা সংক্ষেপে সোভিয়েত ইউনিয়ন একটি স্মরণীয় নাম। ১৯১৭ সালের ২৫ অক্টোবর মহান সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের মাধ্যমে সেখানে এমন একটা সমাজ ব্যবস্থার ভিত্তি স্থাপিত হয়েছিল যা মানব সভ্যতার ইতিহাসে এক অভূতপূর্ব ও অবিস্মরণীয় কীর্তি রূপে চিরকাল অম্লান থাকবে। বিভিন্ন অবস্থা প্রেক্ষিতে ১৯৯১ সালে এর সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে 15 টি নতুন রাষ্ট্রের জন্ম হয়। 

সোভিয়েত ইউনিয়ন কি? সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ও তৃতীয় বিশ্বের দেশসমূহের উপর প্রভাব


সোভিয়েত ইউনিয়নঃ ১৯৭১ সালের বিপ্লবের পর সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রসমূহের ইউনিয়নের জন্ম হয়। বিপ্লবের পূর্বে এদেশ সোভিয়েত রাশিয়া নামে পরিচিত ছিল। অক্টোবর বিপ্লবের মাধ্যমে সৃষ্ট ৮ মিলিয়ন বা সাড়ে ৮৫ লক্ষ বর্গমাইল। পৃথিবীর এক ভু ভাগ এর অন্তর্গত। ইউরোপের অধিকাংশ এবং এশিয়ার এক তৃতীয় অংশ এ দেশের সাথে যুক্ত। সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রাকৃতিক বৈচিত্র ও বিশলতার সাথে সামঞ্জস্য রেখে গড়ে উঠেছে সমভূমি, মরুভূমি, গভীর অরণ্যানি। সোভিয়েত ইউনিয়নের বৈচিত্র ভান্ডার তার জনসংখ্যা, ভাষা এবং ধর্মের মধ্যেও প্রতিফলিত হয়েছে। এ দেশ একটি বহু জাতীয় জনসমাজ বিশিষ্ট।এখানে শতাধিক জাতির বাস। রুশ ভাষা জাতীয় ভাষা হলেও অন্যান্য আঞ্চলিক ভাষার উপর গুরুত্ব আরোপ করে তাদের বিকাশের ব্যবস্থা করা হয়েছে। 

সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ও তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর উপর প্রভাব

১। সোভিয়েত প্রভাবমুক্তঃ তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলো বাড়াবাড়ি পরনির্ভরশীল ছিল আর তাদের এ নির্ভরশীলতা পুঁজিবাদের চেয়ে সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের দিকেই বেশি ছিল। সে সুবাদে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন এসব দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপের সুযোগ পেত। কিন্তু নব্বই দশকের সমাজতন্ত্রের পতনের মধ্য দিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে গেলে বর্তমান রাশিয়া দুর্বল হয়ে পড়ে এবং উন্নয়নশীল দেশ সমূহে তাদের বিস্তারের সামর্থ্য হারিয়ে ফেলে। এর ফলশ্রুতিতে মার্কসীয় দর্শনের প্রভাব ও হ্রাস পেয়েছে। 

২। গণতন্ত্রের প্রতি আগ্রহ বৃদ্ধিঃ সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙ্গনের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন যে একমেরু কেন্দ্রিক পুঁজিবাদী বিশ্ব ব্যবস্থার সৃষ্টি হয়েছে তাতে গণতন্ত্রের জোয়ারে প্রভাবিত হচ্ছে। এর ফলে বিশ্বের সকল উন্নয়নশীল দেশ গণতন্ত্রের চেতনাই উদ্বুদ্ধ হয়ে ওঠে এবং মার্কসীয় দর্শনের অকার্যকারিতা প্রমাণিত হতে থাকে।

৩। মানুষের মনে নবচেতনার উম্মেষঃ মূলত সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোতে মানুষের মৌলিক অধিকার ব্যক্তি ও মতাদর্শগত স্বাধীনতাকে খর্ব করে সমাজতন্ত্র প্রবর্তন করা হয়েছিল। সমাজতান্ত্রিক শিবিরের নেতা সোভিয়েত ইউনিয়ন আরো এক ধাপ এগিয়ে হাঙ্গেরি চেকোশ্লোভাকিয়া নিষ্ঠুর নিধনযঙ্গের মাধ্যমে সমাজতন্ত্রে কায়েম করেছিল। তাই সোভিয়েত ইউনিয়নে সমাজতন্ত্রের পতনের পর উন্নয়নশীল দেশগুলো মার্কসীয় দর্শনের এসব রীতিনীতিকে মানুষের মৌলিক অধিকার ও স্বাধীনতার পরিপন্থী হিসেবে অভিহিত করেছে।

৪। মানুষের মৌলিক অধিকার ও স্বাধীনতা বিরোধীঃ মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি স্বাধীনতার সাথে সাথে প্রত্যেকটি মানুষ চাই তার মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা। কিন্তু সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোতে মানুষের মৌলিক অধিকার, বাক, ব্যক্তি ও মতাদর্শগত স্বাধীনতাকে খর্ব করে সমাজতন্ত্র কায়েম করেছিল। তাই সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর উন্নয়নশীল দেশগুলো মার্কসীয় দর্শনের এসব রীতিনীতিকে মানুষের মৌলিক অধিকার ও স্বাধীনতা পরিপন্থী হিসেবে গণ্য করেছে। 

৫। অর্থনৈতিক দূর্বলতাঃ সমাজতান্ত্রিক শিবিরের নেতা রাশিয়া বিশ্বের সর্বোচ্চ সমাজতন্ত্র কায়েম করার লক্ষ্যে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে প্রচুর অর্থ সাহায্য করত। কিন্তু ৯০ এর দশকে সমাজতন্ত্রের পতনের পর রাশিয়া দুর্বল হয়ে পড়ে এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোর অর্থ সাহায্য বন্ধ হয়ে যায়। ফলে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে সাম্যবাদী আদর্শ প্রচারে ভাটা পড়ে এবং মার্কসীয় দর্শনের অবাস্তবতা প্রমাণিত হতে থাকে। 

৬। অযোগ্য নেতৃত্বের বিকাশঃ সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙ্গনের পর উন্নয়নশীল দেশের রাজনীতিতে অযোগ্য নেতৃত্বের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। মাকসীয় দর্শন গণমানুষের সামনে সহজভাবে উপস্থাপন করার জন্য রাজনীতিবিদদের উক্ত দর্শনের উপর ব্যাপক জ্ঞান অর্জন করা প্রয়োজন। কিন্তু আন্তর্জাতিকভাবে সমাজতান্ত্রিক শিবিরের ভাঙ্গনের ফলে বাম রাজনীতিবিদদের দক্ষতা ও যোগ্যতা ব্যাপকভাবে কমে গেছে। ফলে জনগণ এখন আর তাদের উপর আস্থা রাখতে সক্ষম হচ্ছে না। 

৭। ধর্মবিরোধীঃ মার্কসীয় দর্শনে ধর্মকে আফিমের সাথে তুলনা করা হয়েছে এবং একে পরিত্যাজ্য হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে অথচ উন্নয়নশীল দেশগুলোর মানুষ স্বভাব তো ধর্মপ্রাণ। রাশিয়া ও পূর্ব ইউরোপে সাম্যবাদের পতনের পর সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শ প্রচার ও রপ্তানিতে ভাটা পড়ার সাথে সাথে উন্নয়নশীল দেশগুলোর মানুষ মার্কসীয় দর্শনকে ধর্মবিরোধী বলে অবহিত করেছে।

উপসংহারঃ পরিশেষে বলা যায় যে বিংশ শতাব্দীর রাজনৈতিক ইতিহাসের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো ১৯৯১ সালে সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের পতন। বস্তুত এ সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পেছনে উপরিউক্ত কারণ সমূহ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।আর এর ফলে উন্নয়নশীল দেশসমূহে রাষ্ট্রের মূলনীতি থেকে শুরু করে অর্থনৈতিক ও সমাজধর্মীয় ব্যবস্থায়ও পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়।

Post a Comment (0)
Previous Post Next Post