ম্যালথাসের জনসংখ্যা তত্ত্ব পর্যালোচনা কর।
ভূমিকাঃ ইংরেজি অর্থনীতিবিদ T.R. Malthus, ১৭৮৯ সালে প্রকাশিত তার বিখ্যাত গ্রন্থ An Eassy on the principles of population এ জনসংখ্যা ও খাদ্য উৎপাদনের মধ্যে সম্পর্ক বিষয়ক যে বক্তব্য উপস্থাপন করেন তাই ম্যালথাসের জনসংখ্যা তত্ত্ব নামে পরিচিত। ম্যলথাস এ তত্ত্বকে Natural and social theories of population হিসেবে অভিহিত করা দৃষ্টকোণ থেকে পূর্ণাঙ্গভাবে ব্যাখ্যা করেন।
ম্যালথাসের জনসংখ্যা তত্ত্ব
ম্যালথাসের জনসংখ্যা তত্ত্বটিকে নিম্নোক্তভাবে ব্যাখ্যা করা হলো।
১। বংশবৃদ্ধিঃ ম্যালথাস তার তত্ত্বে মানুষের প্রজনন ক্ষমতা দিকটি উল্লেখ করেন মানুষের ক্ষমতা প্রকৃতি জাত। তাই প্রকৃতিগতভাবেই মানুষ প্রজনন ক্ষমতার দ্বারা বংশবৃদ্ধি করে থাকে।
২। জ্যামিতিক পদ্ধতিঃ ম্যালথাস বলেন, মানুষের অতিরিক্ত প্রজনন ক্ষমতার জন্য জনসংখ্যা জ্যামিতিক পদ্ধতিতে বৃদ্ধি পায়। জ্যামিতিক পদ্ধতি বলতে তিনি লোক সংখ্যা বৃদ্ধির ১,২,৪,৮,১৬,৩২ ধারাকে বুঝিয়েছেন। তিনি আরো বলেন জনসংখ্যা বৃদ্ধির এই হার প্রতি ২৫ বছরে কোন দেশের জনসংখ্যা দ্বিগুণ করবে।
৩। গাণিতিক হারঃ ম্যালথাস গাণিতিক পদ্ধতি বলতে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির হারকে নির্দেশ করেছেন। অর্থাৎ ১, ২, ৩, ৪, ৫, ৬, ৭ এ ধারাকে গাণিতিক পদ্ধতি বলে।
৪। জনাধিক্য সমস্যাঃ জনসংখ্যার দূরত্ব বৃদ্ধি এবং জমিতে ক্রমহ্রাসমান উৎপাদন বিধি কার্যকর হওয়ার জন্য মোট জনসংখ্যা এবং উৎপাদনের মধ্য অভারসাম্য দেখা দিবে। ফলে এক সময় জনসংখ্যা খাদ্য উৎপাদনের পরিমাণ কে ছাড়িয়ে যাবে এবং এদেশে জনসংখ্যাধিক্য সমস্যা দেখা দিবে। তাই এ দুটি সমস্যা সমাধানের জন্য তিনি দুটি পদ্ধতির জন্য সুপারিশ করেন। যেমন- ক) প্রাকৃতিক নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতিঃ ম্যালথাস বলেন জনসংখ্যাধিক্য সমস্যা দেখা দিলে প্রকৃতি নিজেই মহামারী, অনাহার, অপুষ্টি প্রভৃতি ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে জনসংখ্যা হ্রাস করার ব্যবস্থা করে। এসবকে ম্যালথাস প্রাকৃতিক নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি বলে আখ্যায়িত করেছেন। এ পদ্ধতি কার্যকর হলে জনসংখ্যা এবং খাদ্য উৎপাদনের মধ্যে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা পাবে।
খ) প্রতিরোধমূলক নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতিঃ মানুষ স্বয়ং প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে জনসংখ্যাধিক্য সমস্যাকে প্রতিরোধ করতে পারে। ম্যালথাস প্রতিরোধমূলক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা হিসেবে দেরিতে বিয়ে,নৈতিক সংযম অবলম্বন, পরিবার পরিকল্পনা গ্রহণ, চিরকুমার থাকা প্রভৃতিকে নির্দেশ করেছেন।
ম্যালথাসীয় চক্রঃ ম্যালথাসের জনসংখ্যা তত্ত্বটি চক্রাকার রেখাচিত্র ন্যায়। তার তত্ত্বের চক্রাকার ব্যাখাকে ম্যালথাসিও চক্র বলা হয়।
√ ম্যালথাসীয় চক্র= খাদ্য ও জনসংখ্যা ভারসাম্য অবস্থা > প্রাকৃতিক নিরোধ > জনসংখ্যাধিক্য
তিনি এখানে বুঝাতে চেয়েছেন যে খাদ্য ও জনসংখ্যার মধ্য প্রথমে ভারসাম্য অবস্থা থাকলেও কিন্তুু জনসংখ্যা বরাবরই খাদ্য যোগানকে অতিক্রম করে চলে।ফলে শ্রীঘ্রই জনসংখ্যাধিক্য সমস্যার উদ্ভব ঘটে। তখন জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের প্রাকৃতিক উপায় গুলো কাজ করতে থাকে এবং অতিরিক্ত জনসংখ্যা নিশ্চিহ্ন হয়ে খাদ্য ও জনসংখ্যার মধ্য সম্ভব অবস্থা প্রতিষ্ঠা পায়। কিন্তু এ ভারসাম্য স্থায়ী নয় বলে জনসংখ্যাধিক্য সমস্যা দেখা দেয়। তাই জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের প্রাকৃতিক উপায়গুলো জনসংখ্যা ও খাদ্য উৎপাদনের মধ্যে স্থায়ী ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম নয়। তাছাড়া ম্যালথাস প্রাকৃতিক উপায় গুলোকে জনসংখ্যাধিক্য সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে অ-মানবচিত ও হৃদয়বিদারক উপাদান হিসেবে গণ্য করেছেন। এসব প্রাকৃতিক উপায় গুলোর প্রতি বিরূপ ধারণা পোষণ করে ম্যালথাস জনসংখ্যাধিক্য সমস্যা সমাধানে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহনের কথা উল্লেখ করেন।
ম্যালথাসের জনসংখ্যা তত্ত্ব সমালোচনা
ম্যালথাসের জনসংখ্যা তত্ত্বটি জনপ্রিয়তা অর্জন করলেও পরবর্তীকালে নানাবিধ সমালোচনা সম্মুখীন হয়। নিম্নেতাপ উল্লেখ করা হলো।
১। ঐতিহাসিক অসত্যতাঃ ঐতিহাসিক দিক থেকে ম্যালথাসের জনসংখ্যা তত্ত্বটি অসত্য প্রমানিত হয়েছে। তার জনসংখ্যা বৃদ্ধির জ্যামিতিক প্রগতি পাশ্চাত্য দেশে কার্যকর হয়নি। কারণ, এসব দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির পরিবর্তে জনসংখ্যার হ্রাস লক্ষ করা যায়।
২। শিল্পবিপ্লবঃ ইংল্যান্ডের শিল্পবিপ্লবের পর প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ঘটায় বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে কৃষি ও শিল্প ক্ষেত্রে উৎপাদন পর্যাপ্ত পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে। তাই উন্নত দেশগুলোতে জনসংখ্যা চেয়ে খাদ্যের পরিমাণ পর্যাপ্ত পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে। তাই উন্নত দেশগুলোতে জনসংখ্যা চেয়ে খাদ্যের পরিমাণ সাধারণত বেশি হয়ে থাকে। এ কারণে ম্যালথাসের জনসংখ্যা তত্ত্বটির গাণিতিক ও জ্যামিতিক ধারনা কার্যকর হয়নি।
৩। আধুনিক চাষাবাদ পদ্ধতিঃ ম্যালথাসের জনসংখ্যা তত্ত্বটি জমিতে ক্রম হ্রাসমান উৎপাদন বিধির কার্যকারিতার উপর প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু আধুনিক পদ্ধতিতে চাষ আবাদের দরুন জমিতে ক্রমহ্রাসমান উৎপাদন বৃদ্ধি কার্যকর হয় না।
৪। শিক্ষা ও সংস্কৃতিঃ শিক্ষা ও সংস্কৃতির প্রভাবের দরুন মানুষের মূল্যবোধের পরিবর্তন ঘটে এবং তারা কম সন্তান লাভ করতে চায় কেননা কম সন্তান থেকে পারিবারিক সুখ শান্তি বৃদ্ধি পেতে পারে।
৫। মানবীয় সম্পদঃ ম্যালথাস জনসংখ্যা বৃদ্ধিকে শুধু খারাপ হিসেবে বিবেচনা করেছেন কিন্তু এ জনসংখ্যা শিক্ষা ও কর্মদক্ষতার দ্বারা মাননীয় সম্পদে পরিণত হয়ে অর্থনৈতিক উন্নয়নের অবদান রাখতে সক্ষম হয়।
৬। বিলম্বে বিবাহঃ ম্যালথাস জনসংখ্যা সমস্যা সমাধানের জন্য বিলম্বে বিবাহের কথা বলেছেন কিন্তু তার ফলে সমাজে অনেক আত্মসামাজিক সমস্যার উদ্ভব ঘটে।
৭। জনসংখ্যা ও খাদ্যৎপাদনঃ ম্যালথাস তার তত্ত্বে জনসংখ্যা কে শুধু খাদ্য উৎপাদনের সাথে তুলনা করেছেন কিন্তু জনসংখ্যাকে দেশের সামগ্রিক সম্পদের সাথে তুলনা করা উচিত।
৮। প্রাকৃতিক সম্পদ উপেক্ষাঃ কোন দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ প্রচুর পরিমাণে থাকতে পারে। তাই ঐদেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হেতু অর্থনীতির অবনতির পরিবর্তে আরও উন্নতি হতে পারে তা ম্যালথাস বলেননি।
উপসংহারঃ উপরিউক্ত বিভিন্ন সমালোচনা থাকা সত্ত্বেও ম্যালথাসের জনসংখ্যা তত্ত্বকে অস্বীকার করা যায় না। উন্নত দেশগুলোতে তার তথ্য ও কার্যকর হলেও অনুন্নত দেশগুলোতে তথ্যটি কার্যকর। তাই স্যামুএলসন বলেন ''তবুও যখন ভারত চীন ও পৃথিবীর অন্যান্য খাদ্য ঘাটতির এলাকায় খাদ্য ও জনসংখ্যার মধ্য সামঞ্জস্যের কথাটি ভাবা যায় তখন এই তত্ত্বের মধ্যে সত্যর বীজ যে নিহিত আছে তা প্রমাণিত হয়।