জনসংখ্যা অতিক্রমণ তত্ত্ব কী?
ভূমিকাঃ সামাজিক পরিবর্তনের আলোকে জনসংখ্যার পরিবর্তনকে অবলোকনের প্রয়াস থেকে জন্ম হয়েছে অবস্থানান্তর মতবাদের। এ তত্ত পাশ্চাত্য সমাজের অতীত ও অপাশ্চাত্য সমাজের ভবিষ্যৎ জনসংখ্যার পরিবর্তন বিশ্লেষণে সবচেয়ে মতবাদ হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। ১৯২৯ সালে ডব্লিউ.এস. অপসন কর্তৃক বিভিন্ন সময়ে পরিবর্তন বা পরিমার্জিত হয়ে প্রথমে তত্ত্ব সূত্রবদ্ধ হয়।
জনসংখ্যা অতিক্রমণ তত্ত্ব
কোন একটি নির্দিষ্ট এলাকার জনসংখ্যা প্রবৃদ্ধির গতি একটি স্থিতিশীল অবস্থা থেকে সময়ের ব্যবধানে বিভিন্ন পর্যায়ে অতিক্রম করে আরেকটি স্থিতিশীল অবস্থাই প্রতিক্রিক্রমণ করে। এ পরিবর্তনকেই জনবিজ্ঞানীরা জনসংখ্যা অতিক্রমণ তত্ত্ব বলে উল্লেখ করেন।
প্রামাণ্য সংজ্ঞাঃ বিভিন্ন মনোবিজ্ঞানী জনমিতিক বিবর্তন সম্পর্কে বিভিন্ন সংজ্ঞা প্রদান করেছেন। নিম্নে তাদের কয়েকটি সংখ্যা তুলে ধরা হলো।
টনি ক্লিলিক (tony killick) বলেছেন জনমিতিক বিবর্তনের অনুসারে আধুনিকায়নের সময়ে মৃত্যুহার হ্রাস এবং পরবর্তীতে জন্মহার হ্রাস এবং এ মধ্যস্থ সময়ে জনসংখ্যার ব্যাপক বৃদ্ধি ঘটে।
hans raj তার fundamentals of demographic (2003:173) গ্রন্থে বলেছেন জননীতিক উত্তরণতত্ত্ব একই সাথে বৈজ্ঞানিক এবং মূলত একটি তত্ত্ব । প্রায় সকল সমাজ বিজ্ঞানেরা একমত হয়েছে যে জনসংখ্যা প্রক্রিয়া প্রত্যেকটি ধাপেই অনেকগুলো স্তর পার করে। সকল ধাপেরই নিজস্ব বিশেষত্ব রয়েছে।
এ জে কোল (A.J. Coale) এবং ই.এম. হুভার (E.M.Hoover) বলেন জনসংখ্যার অবস্থান্তর মতবাদ অনুযায়ী ঘটনাক্রমকে নিম্নোক্ত ভাবে বর্ণনা করা যায়। নিম্ন আয়ের কৃষি অর্থনীতির বৈশিষ্ট্য হলো উচ্চ জম্মহার ও মৃত্যুহার। জন্মহার তুলনামূলকভাবে স্থির এবং মৃত্যুহার বিভিন্ন অবস্থা সাপেক্ষে অস্থির। এর অর্থনীতি যখন পরিবর্তিত হয় এবং বাজারকেন্দ্রিক হয়ে ওঠে তখন গড় মৃত্যুহার ও কমে যায়। সাংগঠনিক উৎকার্য ও চিকিৎসাবিজ্ঞানের বিস্তারের সাথে এ হার আরো অবনমিত হয় পরে জর্মহারও হ্রাস পেতে শুরু করে।
পরিশেষে বলা যায় যে জনসংখ্যা পরিবর্তন সংক্রান্ত আধুনিক চিন্তাধারা Demographic Transition Theory আকারে প্রকাশ হলেও তা শুরু হয়েছিল অনেক আগে। জনমিতিক বিবর্তন বা উত্তরণ তত্ত্ব অনুসারে জনসংখ্যা ঐতিহাসিকভাবে কম-বেশি বিভিন্ন সুনির্দিষ্ট স্তরের মাধ্যমে অতিক্রান্ত হয়েছে।
জনমিতিক পরিবর্তনসূচক তত্ত্বর ত্রুটিগুলো লিখ।
সাধারণত জনসংখ্যা সম্পর্কিত তথ্যসমূহের মধ্যে জনমিতিক পরিবর্তন সূচক তত্ত্বটি একটি গুরুত্বপূর্ণ মতবাদ। আত্মসমাজিক বিকাশের সাথে জনসংখ্যার সমন্বয় সাধনেও এ তত্ত্বটি তাৎপর্যপূর্ণ। তবে এর ইতিবাচক দিকগুলোর বাইরে জনবিজ্ঞানীরা তত্ত্বটির বেশ কিছু ত্রুটি তুলে ধরেছেন।
জনমিতিক পরিবর্তন সূচক তত্ত্বের সমালোচনা বা ত্রুটিঃ জনোবিজ্ঞানীরা বিভিন্ন দিক থেকে জনমিতিক পরিবর্তনসূচক তত্ত্বের সমালোচনা করেছেন যা নিম্ন উল্লেখ করা।
১। জনমিতিক পরিবর্তনসূচক তত্ত্বের একটি অন্যতম দুর্বলতা হলো জনসংখ্যা বিষয়ে সরকারের ভূমিকা ও হস্তক্ষেপের কথা বলা হয়নি। অথচ পৃথিবীর প্রতিটি দেশেই জনসংখ্যার মোকাবিলায় সরকারের ভূমিকা রয়েছে।
২। জনসংখ্যা পরিবর্তন সূচক তত্ত্বে ব্যবহৃত পরিসংখ্যান কোন ঐতিহাসিক দলিল ভিত্তিক ও বিশ্বস্ত নয়।
৩। এ তত্ত্বে অর্থনৈতিক বিকাশকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে অথচ এর অন্ধকার দিকটিকে গোপন রাখা হয়েছে।
৪। জনসংখ্যা পরিবর্তনের জন্য নির্ধারিত উপাদান এ তত্ত্বের ক্ষেত্রে যথেষ্ট নয় অর্থাৎ তত্ত্বে উপাদানের অপূর্ণতা রয়েছে।
৫। এ তত্ত্বে যে রেখাচিত্রের অবতারণা করা হয়েছে তা অনুমান নির্ভর অর্থাৎ অবাস্তব অনুমানের উপর ভিত্তি করে বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে।
৬। এ তথ্যের আরেকটি ত্রুটি হলো জন্মহার ও মৃত্যুহার হঠাৎ হ্রাস পাওয়া। এটি মোটেও ঠিক নয়।কারন জম্মহার ও মৃত্যুহার বেশির ভাগই ধীরে ধীরে হ্রাস পায়।
৭। অনেক জনবিজ্ঞানী ও বিশেষজ্ঞরা একে জনমিতিক তত্ত্ব হিসেবে স্বীকার করেননি। তাদের মতে এটি কোন তত্ত্ব নই বরং দীর্ঘদিনের পর্যবেক্ষণ ও অভিজ্ঞতার ফলশ্রুতি।
৮। জম্ম ও মৃত্যুহারের ভরসাম্যতা রক্ষায় যেসব উপাদান তত্ত্বে উপস্থাপন করা হয়েছে তার বাইরেও তার সক্রিয় উপাদান রয়েছে কিন্তু এগুলি তত্ত্বে দেখানো হয়নি।
৯। জম্মহার ও মৃত্যুহারের স্থিতাবস্থার জন্য বাইরের শক্তির হস্তক্ষেপের প্রয়োজন। অথচ এ তত্ত্বে এ বিষয়ে কিছু বলা হয়নি।
১০। উন্নত দেশগুলোতে এ পদ্ধতির ব্যবহার সহজ হলেও উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশগুলোতে এ তত্ত্বের প্রয়োগযোগ্যতা কঠিন ব্যাপার।
পরিশেষে বলা যায় যে যে কোন তত্ত্বই সমালোচনার উর্ধ্ব নয়। অন্যান্য তত্ত্বের ন্যায় জনমিতিক পরিবর্তন সূচক তত্ত্বেরও কিছু সমালোচনা বা সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তবে এসব সীমাবদ্ধতার বাইরেও এর গ্রহণযোগ্যতার গুরুত্ব রয়েছে।