কল্যাণ রাষ্ট্র বা জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র কী? কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্যসমূহ
ভূমিকাঃ- কল্যাণ রাষ্ট্র সমাজবিজ্ঞানের একটি মৌলিক ধারণা। সুস্থ রাজনীতি প্রতিষ্ঠা ও জনকল্যাণের জন্য কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের পরিধি দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। কল্যাণরাষ্ট্র জনকল্যাণমূলক কাজ করে থাকে। কল্যাণরাষ্ট্র ব্যক্তি স্বাধীনতা রক্ষা করেন না ও ব্যক্তির অধিকার সংরক্ষণ করে না। আধুনিক যুগে কল্যাণ রাষ্ট্রের গুরুত্ব অপরিসীম।
কল্যাণ রাষ্ট্র/কল্যাণমূলক রাষ্ট্রঃ কল্যাণ রাষ্ট্র (welfare state) সরকারের একটি ধারণা, যেখানে রাষ্ট্র তার নাগরিকদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক কল্যাণ রক্ষা ও প্রচারে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে কল্যাণ রাষ্ট্র বলতে এমন রাষ্ট্রকে বোঝায় যে রাষ্ট্র সামাজিক কল্যাণ সাধন করে। এক কথায় জনকল্যাণে নিয়োজিত রাষ্ট্রই হলো কল্যাণমূলক রাষ্ট্র। জনসাধারণের কল্যাণের জন্য যে রাষ্ট্র কাজ করে তাকেই কল্যাণরাষ্ট্র বলে। জনকল্যাণ রাষ্ট্র এমন একটি রাষ্ট্র যা ব্যক্তি স্বাধীনতা অক্ষুন্ন রেখে জনসেবামূলক কাজ করে।
প্রামাণ্য সংজ্ঞাঃ বিভিন্ন সমাজবিজ্ঞানী ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা কল্যাণরাষ্ট্রকে বিভিন্নভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন। নিম্নে তাদের প্রদত্ত কয়েকটি সংজ্ঞা তুলে ধরা হলো-
অধ্যাপক হার্বার্ট লেম্যান (Herbert Lchman) বলেন-“যে রাষ্ট্রে নাগরিকের ব্যক্তিক্ষতা পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটে এবং তাদের প্রতিভার সঠিকভাবে মূল্যায়ন করা হয় সে রাষ্ট্রকে কল্যাণমূলক রাষ্ট্র বলে।”
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী প্লেটো (Plato) বলেন- “জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র হলো এমন একটি রাষ্ট্র যার উদ্দেশ্য হলো সকল মানুষের মাঝে ন্যায় প্রতিষ্ঠা করা।”
টি ডব্লিউ কেন্ট (T.W Kent) এর মতে-“কল্যাণ রাষ্ট্র এমন একটি রাষ্ট্র যা নাগরিকদের জন্য ব্যাপক সমাজ সেবার ব্যবস্থা করে থাকে।”
আর. এম টিটমাসের মতে-“কল্যাণমূলক রাষ্ট্র হচ্ছে এমন রাষ্ট্র যা জনগণের সার্বিক কল্যাণের দায়িত্বভার গ্রহণ করে থাকে।”
অর্থনীতিবীদ এ. সি. পিগু (A.C. Pigo) বলেন-“যে রাষ্ট্র নাগরিকদের আর্থিক সন্তুষ্টি বিধানের জন্য চেষ্টা করে তাকে কল্যাণমূলক রাষ্ট্র বলে।”
Austin Ranney বলেন-“পূর্ণ সনাতন ও পূর্ণ ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবাদের মধ্যবর্তী স্থানই হলো জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র।”
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী জি. ডি. এইচ কোন এর মতে-“কল্যাণরাষ্ট্র হচ্ছে এমন একটি সমাজ ব্যবস্থা যা প্রত্যেক নাগরিকের নুন্যতম জীবনযাত্রার মান এবং অধিকারের সুযোগ সৃষ্টি করে।”
কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্যসমূহঃ
১। জনকল্যাণে প্রতিশ্রুতিবদ্ধতা: কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো এটি জনকল্যাণ নিশ্চিত করতে অঙ্গীকারবদ্ধ। রাষ্ট্র জনগণের সুখ-দুঃখে পাশে থাকে এবং তাদের মৌলিক চাহিদা পূরণে সচেষ্ট হয়।
২। সমাজসেবামূলক রাষ্ট্র: এই ধরনের রাষ্ট্র নাগরিকদের জন্য শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সামাজিক নিরাপত্তা, বাসস্থান, খাদ্য, পানীয় জল, কর্মসংস্থান প্রভৃতি সামাজিক সেবা নিশ্চিত করে।
৩। সামাজিক ও অর্থনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠা: কল্যাণমূলক রাষ্ট্র ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে বৈষম্য কমিয়ে আনার জন্য কাজ করে। অর্থ ও সম্পদের ন্যায্য বণ্টন নিশ্চিত করা হয়।
৪। বিচার ও ন্যায় প্রতিষ্ঠা: কল্যাণরাষ্ট্র সকলের জন্য সমান আইন এবং বিচার নিশ্চিত করে। এর মাধ্যমে সামাজিক শান্তি ও নিরাপত্তা বজায় রাখা হয়।
৫। সর্বজনীন শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা: কল্যাণমূলক রাষ্ট্রে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে শিক্ষা ও চিকিৎসা খাতে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়, যাতে সকল নাগরিক এই সেবা উপভোগ করতে পারে।
৬। বেকারত্ব ও দারিদ্র্য দূরীকরণ: এই ধরনের রাষ্ট্র বেকারদের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং দরিদ্র জনগণের জীবনমান উন্নয়নে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করে।
৭। নাগরিক অধিকার সংরক্ষণ: ব্যক্তির মত প্রকাশের স্বাধীনতা, ধর্মীয় স্বাধীনতা, নিরাপত্তা, ও সাংবিধানিক অধিকার সুরক্ষিত রাখে কল্যাণমূলক রাষ্ট্র।
৮। রাষ্ট্র কর্তৃক পরিকল্পিত উন্নয়ন: কল্যাণমূলক রাষ্ট্র দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন পরিকল্পনার মাধ্যমে অর্থনৈতিক ও সামাজিক অগ্রগতি নিশ্চিত করে।
৯। নারী ও শিশুকল্যাণে গুরুত্বারোপ: নারী ও শিশুদের অধিকার রক্ষা ও কল্যাণে বিশেষভাবে কাজ করে কল্যাণরাষ্ট্র। এটি শিশু শ্রম, নারী নির্যাতন প্রতিরোধে উদ্যোগ গ্রহণ করে।
১০। নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধের চর্চা: কল্যাণমূলক রাষ্ট্র শুধু অর্থনৈতিক উন্নয়ন নয়, বরং মানবিক মূল্যবোধ, সহমর্মিতা, ন্যায্যতা ও নৈতিকতা চর্চায়ও গুরুত্ব দিয়ে থাকে।
উপসংহারঃ পরিশেষে বলা যায় যে, কল্যাণমূলক রাষ্ট্র হলো এমন একটি রাষ্ট্র যা বহিৃস্বাধীনতা অক্ষুন্ন রেখে জনসেবামূলক কাজের দ্বারা জনকল্যাণ নিশ্চিত করে। কল্যাণরাষ্ট্র মানব কল্যাণে নিয়োজিত থাকে। নাগরিক জীবনের নিরাপত্তা দ্বারা কল্যাণমূলক রাষ্ট্র তার দায়িত্ব শাসন করে। এককথায় কল্যাণ রাষ্ট্রের কাজই হলো জনকল্যাণমূলক কাজ করা। কল্যাণমূলক রাষ্ট্র সর্বদা রাষ্ট্রের জনগণের নিয়ে চিন্তা করে।

No comments:
Post a Comment