📚তত্ত্ব কী?
অথবা, তত্ত্ব বলতে কী বুঝ? তত্ত্বের সংজ্ঞা দাও
(সমাজবিজ্ঞান মাস্টার্স-ফাইনাল)
ভূমিকাঃ- মানব সমাজের ইতিহাস বহু প্রাচীন এবং ধারাবহিক। বিভিন্ন চিন্তাবিদ ও দার্শনিক এ সমাজবদ্ধ ও ধারাবহিক জীবনের ইতিহাস ব্যাখ্যা করেছেন। বিভিন্ন মানব সমাজ সম্পর্কিত তাদের এ চিন্তা এবং জ্ঞান যখন অন্তদৃষ্টি অভিজ্ঞতার আলোকে প্রকাশিত হয় তখন তা আধুনিক সমাজে এসে Theory হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। মূলত মানব সমাজের এ তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ সমাজতাত্ত্বিক তত্ত্বের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশকে ব্যাখ্যা করে। ফলশ্রুতিতে মানুষের যাবতীয় সামাজিক সম্পর্ক ব্যাখ্যা করার জন্য সমাজবিজ্ঞানের উদ্ভব হয়।
তত্ত্ব (Theory): সমাজতত্ত্বের সংজ্ঞা নিয়ে সমাজবিজ্ঞানীদের মধ্যে মতবিরোধ তৈরী হয়েছে। কারো মতে তত্ত্ব (Theory) হচ্ছে সমাজ সম্পর্কিত বিভিন্ন সূত্র বা প্রত্যয়। বস্তুত তত্ত্ব সামাজিক ঘটনাকে Generalize করে এবং Prediction করে । তত্ত্ব সামাজিক ঘটনার কায্যকরণ সম্পর্ককে ব্যাখ্যা করে। তবে তত্ত্ব পরিবর্তনশীল নতুন নতুন পরীক্ষা নিরিক্ষার মাধ্যমে তত্ত্বকে সংশোধিত ও পরীক্ষা করে। সমাজবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে তত্ত্ব হচ্ছে এর আত্মা তথ্য কেন্দ্র বিশেষ করে Classical Theory যেটা সমাজবিজ্ঞানে অসামান্য অবদান রেখেছে। বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান পদ্ধতির একটি মৌলিক ধারণা ও চালিকা শক্তিকেই তত্ত্ব বলে।
প্রামাণ্য সংজ্ঞাঃ বিভিন্ন সমাজবিজ্ঞানী বিভিন্নভাবে তত্ত্বের সংজ্ঞা প্রদান করেছেন তা নিম্নরুপঃ-
উইলিয়াম জে গুড. পল. কে. হেট এর মতে- “নির্দিষ্ট বিষয়ের উপর জড়কৃত ঘটনার সমষ্টি হলো বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব।”
ল্যুন্ডবার্গ বলেন- “তত্ত্ব হলো সাধারণ পর্যবেক্ষণযোগ্য কোন একটি প্রক্রিয়া”
সমাজ গবেষক সেলটিনি বলেছেন-“A Theory is a set of interrelation constructs definitions propositions that represent a systematic views of phenomena by specifying relations among variables with the pressure of explaining and predicting in the phenomena.” অর্থাৎ (একটি তত্ত্ব হল আন্তঃসম্পর্কের একটি সেট যা সংজ্ঞা প্রস্তাবনা তৈরি করে যা ঘটনাটির ব্যাখ্যা এবং ভবিষ্যদ্বাণী করার চাপের সাথে ভেরিয়েবলের মধ্যে সম্পর্ক নির্দিষ্ট করে ঘটনার একটি পদ্ধতিগত দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থাপন করে)
জি.আর. এন্ডামস এর মতে-“তত্ত্ব হলো কতকগুলো ঘটনার ব্যখ্যা যা দ্বারা যুক্তসঙ্গত কিছু ঘটে । এটা হলো যা দেখা যায় তার বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ মাত্র।”
টারনার (Turner): বলেছেন-“Theory is a mental activity, It is a process of developing ideas that can allow us to explain why events should occured.” অর্থাৎ (তত্ত্ব হল একটি মানসিক ক্রিয়াকলাপ, এটি ধারণাগুলি বিকাশের একটি প্রক্রিয়া যা আমাদের ব্যাখ্যা করতে দেয় কেন ঘটনা ঘটতে হবে)
জুলিয়ান সাইমন এর মতে-“ তত্ত্ব হচ্ছে চিন্তার সার্বিক ব্যবস্থা যা অনেক বিষয়কে উল্লেখ করে এবং যার অংশগুলো একে অপরের সাথে অবমোহ যৌক্তিক আকারে সম্পর্ক যুক্ত হতে পারে।”
জি. ডি. স্বাভানেভেন্ট এর মতে “Theory is an explanation for events a rational for way something occurred: it is scientific explanation of a condition that has been observed” অর্থাৎ (তত্ত্ব হল ঘটনাগুলির জন্য একটি ব্যাখ্যা যা কিছু ঘটে যাওয়ার জন্য যুক্তিযুক্ত: এটি এমন একটি অবস্থার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা যা পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে)
Chava Nachmias and David Nachmias এর মতে, "Theory is a logical-deductive system consisting of a set of interrelated concepts from which testable propositions can be deductively derived."
Chamber 20th Century Dictionary তে উল্লেখ করা হয়েছে যে, তত্ত্ব হচ্ছে "An exposition of the abstract principles of a science on art." (অর্থাৎ, 'তত্ত্ব হচ্ছে, বিজ্ঞান বা কলার মূলনীতির মৌলিক সত্যের বস্তুনিষ্ঠ ব্যাখ্যা।"
Goode and Hatt (1952: ৪) বলেন, "To the Scientist theory refers to the relationship between facts or to the onkering of then in some meaningful way" ("বিজ্ঞানীদের নিকট ঘটনাবলির মধ্যে সম্পর্কের ইঙ্গিত বর্ণনা করে অথবা ঘটনাবলি অর্থপূর্ণ উপায়ে সুবিন্যস্ত করার নির্দেশক হিসাবে বিবেচিত হয়।"
তত্ত্বের বিভিন্ন সংজ্ঞা পর্যালোচনার পর Encyclopedia of Social Research (Devi, 1997: 20) উল্লেখ করেছে যে, 'এ theory is a schematically specific caususal relationships among variable (তত্ত্ব হলো নিয়মতান্ত্রিকভাবে সম্পর্কযুক্ত প্রস্তাবনা সমূহের সমষ্টি যা বিভিন্ন চলকের মধ্যকার কার্যকারণ সম্পর্ক নির্দিষ্ট করে।
Andreu Sayer তত্ত্বের সংজ্ঞায় তিনটি ভিন্ন ভিন্ন ব্যবহার ও অর্থের কথা বলেছেন।
১। তত্ত্ব বলতে বোঝায় ঘটনার বিশ্লেষণ ও ভবিষ্যদ্বাণী করার লক্ষ্য বিন্যাস কাঠামো।
২। তত্ত্ব অর্থ ধারণায়ন অর্থাৎ তত্ত্বের ব্যবহার অর্থই হচ্ছে কোনকিছু সম্পর্কে বিশেষ ধারণা বা কল্পনা ।
৩। এটি কখনও কখনও প্রকল্প এবং বিশ্লেষণের পরিবর্তে ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
উপরের সংজ্ঞাসমুহের আলোকে বলা যায় যে, বিভিন্ন ঘটনাবলির মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক বিচারকরে ঐ ঘটনাবলির সম্পর্কে সর্বসম্মত সিদ্ধান্তই তত্ত্ব হিসেবে পরিগণিত। একটি নির্দিষ্ট বিষয়ের ধারাবাহিক ও যৌক্তিক পর্যালোচনা যা দীর্ঘ সময়ব্যাপী পর্যবেক্ষণকৃত ফলাফলের সাধারণীকরণ। তত্ত্ব হলো এমন একটি যা সত্য বলে ধরে নেওয়া হয় এবং যার সাহায্যে ভবিষ্যদ্বাণী করা যায়। সামাজিক গবেষণায় তথ্যের নির্ভরযোগ্য ভিত্তি হলো তত্ত্ব। তাই সামাজিক গবেষণায় একজন গবেষকের নিকট তত্ত্ব অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।
তত্ত্বের বৈশিষ্ট্যগুলো উল্লেখ কর।
ভূমিকা: আধুনিক বিজ্ঞান মূলত তত্ত্ব ও ঘটনার মধ্যে বিজড়িত সম্পর্কেরই ফলস্বরূপ। তত্ত্ব হচ্ছে প্রতিষ্ঠিত সত্য। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির সাফল্য মূলত তত্ত্বের উপর নির্ভরশীল। কেননা, বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের ফলাফলই তত্ত্বে রূপ লাভ করে। জ্ঞানের ক্ষেত্রে কোন অপ্রতুলতা আছে কি না তা তত্ত্বের মাধ্যমে নির্ণয় করা যায়। সমস্যা সমাধান ও বিজ্ঞান উন্নয়নে কার্যকরী ভূমিকা পালনের ক্ষেত্রে উত্তম বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের নিজস্ব কিছু বৈশিষ্ট্য থাকা আবশ্যক।
তত্ত্বের বৈশিষ্ট্য (Characteristics of theory): নিম্নে তত্ত্বের বৈশিষ্ট্যগুলো আলোচনা করা হলো।
(ক) তত্ত্ব একটি নির্ধারিত বিষয়ের ধারাবাহিক পর্যবেক্ষণের যৌক্তিক ব্যাখ্যা।
(খ) তত্ত্ব গবেষণা ও গবেষকের জন্য দিক নির্দেশক স্বরূপ
(গ) তত্ত্ব ঘটনা সংক্ষিপ্তকরণে ও সাধারণীকরণে ভূমিকা পালন;
(ঘ) জ্ঞানের জগতে কোন অপ্রতুলতা আছে কি না তা তত্ত্বের মাধ্যমে জানা যায়:
(৪) তত্ত্ব ও ঘটনার আন্তঃক্রিয়ার ফলে বিজ্ঞানের উদ্ভব হয় ও বিকাশ লাভ করে।
(চ) তত্ত্বের মাধ্যমে ভবিষ্যদ্বাণী করা যায়।
(ছ) তত্ত্ব মানব চিন্তার কেন, কিভাবে, কোথায়, কি, কখন ইত্যাদি প্রশ্নের যৌক্তিক উত্তর দেয়ার চেষ্টা করে।
(জ) তত্ত্ব কোন পরম সত্যের বিবৃতি নয়, এটা পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে যাচাইযোগ্য বিবৃতি।
(ক) তত্ত্ব সামাজিক বাস্তবতার একটি বিশেষ অংশ বা দিক সম্পর্কে ধারণা দেয় এবং
(ঞ) জ্ঞানের বিকাশের সাথে সাথে তত্ত্বের পরিবর্তন পরিবর্ধণ হতে পারে।
উপসংহার: উপরিউক্ত আলোচনা শেষে বলা যায়, সামাজিক গবেষণায় বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির উপাদান হিসেবে তত্ত্বের গুরুত্ব অপরিসীম। একজন গবেষককে তার নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌছানোর ক্ষেত্রে তত্ত্ব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা