সমাজবিজ্ঞানের উৎপত্তি ও বিকাশে হার্বার্ট স্পেন্সার (Herbert Spencer) এর অবদান আলোচনা কর।

সমাজবিজ্ঞানের উৎপত্তি ও বিকাশে হার্বার্ট স্পেন্সার (Herbert Spencer) এর অবদান আলোচনা কর।

সমাজবিজ্ঞানের বিকাশ হার্বার্ট স্পেন্সার (Herbert Spencer) এর অবদান

ভূমিকা: সমাজবিজ্ঞান (Sociology) একটি স্বতন্ত্র বৈজ্ঞানিক শাস্ত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে দীর্ঘ সময় লেগেছিল। এই যাত্রায় যেসব মনীষী অবদান রেখেছেন, তাদের মধ্যে হার্বার্ট স্পেন্সারের নাম চিরকাল স্মরণীয় হয়ে থাকবে। ফরাসী সমাজবিজ্ঞানী হার্বার্ট স্পেন্সার সমাজবিজ্ঞানের অনেক গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্ব উদ্ভাবন করেছেন, যা আধুনিক সমাজবিজ্ঞানের ভিত্তি গঠনে সহায়ক হয়েছে। আজকের এই ব্লগ পোস্টে আমরা তার অবদান নিয়ে আলোচনা করব।

সমাজবিজ্ঞানের উৎপত্তি ও বিকাশে হার্বার্ট স্পেন্সার এর অবদান


হার্বার্ট স্পেন্সার: সমাজবিজ্ঞানে এক অনন্য নাম

হার্বার্ট স্পেন্সার ছিলেন একজন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী, যিনি সমাজবিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্ব উদ্ভাবন করেছেন। তার বিশিষ্ট তত্ত্বগুলোর মধ্যে রয়েছে সামাজিক বিবর্তন তত্ত্ব, অধিকার তত্ত্ব, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র‌্যবাদ এবং ক্রিয়াবাদী তত্ত্ব। এই তত্ত্বগুলো আধুনিক সমাজবিজ্ঞানে আজও প্রভাবশালী।

১. সামাজিক বিবর্তন তত্ত্ব:

স্পেন্সার সামাজিক বিবর্তন তত্ত্ব প্রদান করেন, যার মাধ্যমে তিনি সমাজের একরূপ থেকে অন্যরূপে পরিবর্তন হওয়ার প্রক্রিয়াকে ব্যাখ্যা করেন। তার মতে, সমাজ একটি জীবন্ত সত্তা, যা সময়ের সাথে সাথে উন্নতি ও পরিবর্তন ঘটায়। তার "Progress: Its Law and Cause" গ্রন্থে সামাজিক বিবর্তন তত্ত্ব ধারণাটি বিশদভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। স্পেন্সারের এই তত্ত্বের মাধ্যমে সমাজের পরিবর্তনকে প্রাকৃতিক এবং বৈজ্ঞানিকভাবে বিশ্লেষণ করা সম্ভব হয়েছে।

২. ব্যক্তিস্বাতন্ত্র‌্যবাদ:

স্পেন্সার ব্যক্তিস্বাতন্ত্র‌্যবাদী হিসেবে পরিচিত। তার মতে, প্রত্যেক ব্যক্তি তার নিজস্ব স্বাধীনতা ভোগ করতে চায়। "The Man Versus the State" গ্রন্থে তিনি ব্যক্তির স্বাধীনতা এবং সরকারের হস্তক্ষেপের বিরোধিতা করেন। তার মতে, স্বাধীনতা এবং ব্যক্তিস্বাতন্ত্র‌্যবাদ সমাজের অগ্রগতির অন্যতম শর্ত।

৩. অধিকার তত্ত্ব:

হার্বার্ট স্পেন্সার তার অধিকার তত্ত্বে নারী, পুরুষ এবং শিশুর অধিকার নিয়ে আলোচনার সুযোগ তৈরি করেন। তার মতে, সমাজে পুরুষ ও নারীর সমান অধিকার হওয়া উচিত, এবং শিশুরাও সমাজে স্বাধীনভাবে চলাফেরা এবং ভাববিনিময় করতে সক্ষম। এভাবে তিনি মানবাধিকার এবং সমতার ধারণাকে সমাজবিজ্ঞানে প্রতিষ্ঠিত করেন।

৪. সমাজবিজ্ঞানের স্বতন্ত্র শাস্ত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা:

স্পেন্সার সমাজবিজ্ঞানের একটি স্বতন্ত্র শাস্ত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন। তার মতে, সমাজবিজ্ঞান অন্য বিজ্ঞান থেকে আলাদা এবং এটি সমাজের কাঠামো, কার্যকলাপ এবং মানুষের জীবনধারা নিয়ে আলোচনা করে। সমাজবিজ্ঞানের এই ভিত্তি তার অবদান হিসেবে চিরকাল স্মরণীয় হয়ে থাকবে।

৫. সমাজতন্ত্রের নীতি:

স্পেন্সার সমাজবিজ্ঞানে দুটি মৌলিক নীতি প্রবর্তন করেন—জৈবিক নীতি এবং সামাজিক পরিবর্তনের ধারা। তার মতে, সমাজের পরিবর্তন প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া হিসেবে ঘটে এবং এটি কোনো বাহ্যিক প্রভাব ছাড়া নিজস্ব গতিতে চলে।

৬. স্তর চিহ্নিতকরণ:

স্পেন্সার তার সমাজবিজ্ঞানের বিবর্তনে দুটি স্তরের কথা উল্লেখ করেছেন: সমরবাদ (Warrior Phase) এবং শিল্পবাদ (Industrial Phase)। প্রথম পর্যায়ে সমরবাদীরা সমাজের শাসন প্রতিষ্ঠা করেছিল, এবং দ্বিতীয় পর্যায়ে শিল্পবিপ্লবের মাধ্যমে সমাজে শিল্পের বিপ্লব ঘটেছিল। এই স্তরগুলির পরিবর্তন সমাজবিজ্ঞানের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

৭. ক্রিয়াবাদী তত্ত্ব:

স্পেন্সার ক্রিয়াবাদী তত্ত্ব উদ্ভাবন করেন, যেখানে তিনি সমাজকে একটি জৈব সত্তা হিসেবে দেখেছিলেন। তার মতে, সমাজের বিভিন্ন কাঠামো এবং অঙ্গ-প্রতিষ্ঠানগুলি একে অপরের সাথে ক্রিয়াশীলভাবে কাজ করে এবং সমাজের অগ্রগতি নির্ধারণ করে।

৮. অঙ্গ-প্রতিষ্ঠানের বিকাশ:

স্পেন্সার সামাজিক অঙ্গ-প্রতিষ্ঠানগুলোকে তিন ভাগে ভাগ করেছেন:

  • সংরক্ষণমূলক ব্যবস্থা: এটি সমাজের মানুষের জীবনধারণের সাথে সম্পর্কিত।

  • বন্টনমূলক ব্যবস্থা: এখানে সমাজের শ্রম বিভাজন আলোচনা করা হয়।

  • নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা: এটি রাষ্ট্র সম্পর্কিত প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়ে আলোচনা করে।

উপসংহার:

হার্বার্ট স্পেন্সারের সমাজবিজ্ঞানে অবদান আজও প্রাসঙ্গিক। তার তত্ত্বগুলি সমাজের বিবর্তন, স্বাধীনতা, অধিকার এবং সামাজিক কাঠামো নিয়ে গভীর দৃষ্টিকোণ প্রদান করে। সমাজবিজ্ঞানের ইতিহাসে তার অবদান চিরকাল স্মরণীয় হয়ে থাকবে, এবং তিনি সমাজবিজ্ঞানের বিকাশে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত।

Post a Comment (0)
Previous Post Next Post