বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবনী: এক অনন্য প্রতিভার পথচলা
ভূমিকাঃ- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বাংলা সাহিত্যের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। তিনি ছিলেন একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক, চিত্রশিল্পী ও সুরকার। বাংলা সাহিত্যের এই পুরোধা ব্যক্তিত্বকে 'কবিগুরু', 'বিশ্বকবি' এবং ‘গীতাঞ্জলির স্রষ্টা’ নামে সম্বোধন করা হয়। তার সাহিত্যকর্ম ও জীবনদর্শন আজও কোটি মানুষের অনুপ্রেরণা।
জন্ম ও শৈশবকাল
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জন্মগ্রহণ করেন *৭ মে ১৮৬১ সালে (২৫ বৈশাখ ১২৬৮ বঙ্গাব্দ), কলকাতার জোড়াসাঁকোর বিখ্যাত ঠাকুরবাড়িতে। তার পিতা "দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর" ছিলেন ব্রাহ্ম সমাজের একজন গুরুত্বপূর্ণ ধর্মগুরু এবং মাতা "সারদাসুন্দরী দেবী"। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন তাদের চতুর্দশ সন্তান। ধনাঢ্য পরিবারে জন্ম হলেও, ছোটবেলায় তাকে পিতার সান্নিধ্য খুব একটা পাওয়া যায়নি। মায়ের মৃত্যু ও বাবার অধিকাংশ সময় ভ্রমণে ব্যস্ত থাকায়, তার শৈশব কেটেছে ভৃত্যদের তত্ত্বাবধানে।
শিক্ষা জীবন
শিক্ষার শুরু হয় বড় ভাই "হেমেন্দ্রনাথ ঠাকুরের" হাতে। বিদ্যালয়ের আনুষ্ঠানিক শিক্ষায় অনাগ্রহী রবীন্দ্রনাথ পড়েছেন কলকাতার ওরিয়েন্টাল সেমিনারি, নর্ম্যাল স্কুল, বেঙ্গল অ্যাকাডেমি ও সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুলে। এরপর ১৮৭৮ সালে ইংল্যান্ডে পাঠানো হয় আইন পড়ার জন্য। তিনি ব্রাইটনের একটি স্কুলে ও পরে লন্ডনের ইউনিভার্সিটি কলেজে ভর্তি হন। তবে, সাহিত্যপ্রেম তাকে আইন পড়া থেকে দূরে নিয়ে যায় এবং তিনি পড়াশোনা অসমাপ্ত রেখেই দেশে ফিরে আসেন।
পারিবারিক জীবন
১৮৮৩ সালে রবীন্দ্রনাথ বিবাহ করেন "ভবতারিণী দেবীকে", যাকে পরে "মৃণালিনী দেবী" নামে পরিচিত করা হয়। তাঁদের পাঁচটি সন্তান জন্মগ্রহণ করে, তবে দুজন ছোট বয়সে মৃত্যুবরণ করে। মৃণালিনী দেবীর অকালমৃত্যু রবীন্দ্রনাথের জীবনে গভীর শোক বয়ে আনে।
শিলাইদহ ও জমিদারির অভিজ্ঞতা
১৮৯০ সালে তিনি কুষ্টিয়ার "শিলাইদহ" পরগনায় পারিবারিক জমিদারির তদারকির দায়িত্ব নেন। এখানেই তার সাহিত্যজীবনের গুরুত্বপূর্ণ কিছু সময় কেটেছে। পদ্মার তীরে বসে লেখা বহু কবিতা, চিঠি ও গানের মধ্য দিয়ে তিনি বাংলার প্রকৃতি ও সাধারণ মানুষের জীবনের সঙ্গে গভীরভাবে একাত্ম হন।
সাহিত্যজীবন ও কীর্তি
রবীন্দ্রনাথ মাত্র আট বছর বয়সে কবিতা লিখতে শুরু করেন। তার প্রথম প্রকাশিত কবিতা ছিল “অভিলাষ", যা ১৮৭৪ সালে তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। প্রথম গল্প “ভিখারিণী” প্রকাশিত হয় ১৮৭৭ সালে। তিনি ‘ভানুসিংহ ঠাকুর’ ছদ্মনামে মধ্যযুগীয় বাংলা ভাষায় কিছু কবিতা লিখে সাহিত্যে এক নতুন ধারা সৃষ্টি করেন।
তার রচনার সংখ্যা সত্যিই বিস্ময়কর –
🔸 ৫২টি কাব্যগ্রন্থ
🔸 ১৪টি উপন্যাস
🔸 ৩৮টি নাটক
🔸 ৩৬টি প্রবন্ধগ্রন্থ
🔸 ৯৫টি ছোটগল্প
🔸 ১৯১৫টি গান
এছাড়াও, তিনি প্রায় **দুই হাজারের** বেশি চিত্র অঙ্কন করেন। তার রচিত গান “আমার সোনার বাংলা” ও “জনগণমন” যথাক্রমে বাংলাদেশের ও ভারতের জাতীয় সংগীত।
নোবেল পুরস্কার ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি
১৯১৩ সালে, “Gitanjali (গীতাঞ্জলি)” কাব্যগ্রন্থের ইংরেজি অনুবাদের জন্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর **সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার** লাভ করেন। তিনি প্রথম এশীয় ও অ-ইউরোপীয় ব্যক্তি যিনি এই সম্মান অর্জন করেন। এটি শুধু তার নয়, সমগ্র ভারতবর্ষের জন্য গৌরবের মুহূর্ত ছিল।
মৃত্যুবরণ:
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন *৭ আগস্ট ১৯৪১* সালে (২২ শ্রাবণ ১৩৪৮ বঙ্গাব্দ), তার প্রিয় জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতেই। তাঁকে কলকাতার নিমতলা মহাশ্মশানে সমাধিস্থ করা হয়।
✍️ উপসংহার
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শুধু একজন সাহিত্যিক ছিলেন না, তিনি ছিলেন এক যুগান্তকারী দার্শনিক ও মানবতাবাদী চিন্তাবিদ। তার লেখা আজও বাঙালির চিন্তা-চেতনা, সংস্কৃতি ও জাতীয়তাবোধে গভীরভাবে প্রভাব বিস্তার করে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবন ও সাহিত্য আমাদের জন্য চিরন্তন অনুপ্রেরণার উৎস।