জর্জ হার্বার্ট মিড কে ছিলেন? জর্জ হার্বার্ট মিডের প্রতীকী মিথস্ক্রিয়া তত্ত্বটি পর্যালোচনা কর।

প্রশ্নঃ জর্জ হার্বার্ট মিড কে ছিলেন? জর্জ হার্বার্ট মিডের প্রতীকী মিথস্ক্রিয়া তত্ত্বটি পর্যালোচনা কর।


অথবা, জর্জ হার্বার্ট মিডের কাঠামোবাদী প্রতীকী মিথস্ক্রিয়াবাদ এবং পরিচিতি তত্ত্ব অলোচনা কর।
ভূমিকাঃ অধুনিক সমাজতাত্ত্বিকদের মধ্যে সমাজবিজ্ঞানে যারা গুরুত্ব অবদান রেখেছেন হার্বার্ট মিড তাদের মধ্যে অন্যতম।সমাজবিজ্ঞানে জর্জ হারবার্ট মিডের  প্রতীকী মিথস্ক্রিয়াবাদ তত্ত্বটি গুরুত্ব বহন করে। যদিও  প্রতীকী মিথস্ক্রিয়াবাদ একটি সামাজিক মনোবিজ্ঞানীর দৃষ্টভঙ্গি। মিথস্ক্রিয়া মূলতসামাজিক এবং সামাজিক সম্পর্কের অধ্যয়নের উপর জোর দেই। নিম্নে এ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো।
জর্জ হার্বার্ট মিডের জীবনীঃ জর্জ হার্বার্ট মিড শিকাগো স্কুলের একজন বাস্তববাদী দার্শনিক। হারবার্ট মিড ১৮৬৩ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস অঙ্গরাজ্যের দক্ষিণ হ্যাডলি নামক স্থানে জম্মগ্রহন করেন। হার্বার্ট মিডের পিতার নাম Herm Mead এবং মাতার নাম  Elizabeth Storrs Billing. হার্বার্ট মিড ছিলেন তার মাতা-পিতার ২য় সন্তান। ১৮৮০ সালে হারবার্ট মিডের পরিবার দক্ষিণ হ্যাডলি থেকে  ওহিও অঙ্গরাজ্যের Oberlin  এ চলে আসেন। হার্বার্ট মিডের বাবা ছিলেন Oberlin  College এর অধ্যাপক। হার্বার্ট মিড ১৮৭৯ সালে ১৬ বছর বয়সে Oberlin College  এ ভর্তি হন এবং ১৮৮৩ সালে তিনি অত্র কলেজ হতে স্নাতক (বি.এ) ডিগ্রি অর্জন করেন। ঐ কলেজে থাকা অবস্থাতেই তার এবং তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু Henry Northerup Castle অতিমাত্রায় সাহিত্য, কবিতা এবং ইতিহাসের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠেন। সাহিত্যের ক্ষেত্রে তিনি বড় সাহিত্যিকদের মাধ্যমে অনুপ্রাণিত হন।  মিড ১৮৮২-১৮৮৩ সালে Oberlin Radio তে Charls Lab এর উপর একটি প্রবন্ধ লিখেন। ১৮৮৩ সালে Oberlin  এ স্নাতক করার পর সেখানেই কিছুদিন শিক্ষকতা করেন। পরবর্তীতে তিনি ১৮৮৩ সালের শেষ হতে ১৮৮৭ পর্যন্ত একটি  Railroad কোম্পানির Seerveyor হিসেবে চাকরী করেন। ১৮৮৭ সালে তিনি হার্বার্ট  বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন শুরু করে এবং হার্বার্ট বিশ্ববিদ্যালয় হতে ১৮৮৭-৮৮ শিক্ষাবর্ষে দর্শনে স্নাতকোত্তর (এম.এ) ডিগ্রি অর্জন করেন। এই সময়টাতে তিনি রোমান্টিকতা ও আদর্শবাদ দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হন। এরপর ১৮৮৮ সালে তিনি ইউরোপে যান এবং সেখানে তিনি দর্শন ও মনস্তাত্ত্বিক দর্শনের উপর গবেষণা করেন।হার্বার্ট মিড যখন তার বন্ধুর পরিবারে কেসেলের সাথে জীবনযাপন করেন তখন তার হেলেন কেসেলর  সাথে প্রেম হয় এবং ১৮৯১ সালের ১ অক্টোম্বর বিয়ে করেন। ১৮৯১ সালে মিড গবেষণা কাজে কিছু সমস্যার সৃষ্টি হয়। কারণ তখন মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয় তাকে দর্শন ও মনোবিজ্ঞানের প্রভাষক হওয়ার আমন্ত্রণ জানায়। সেখানে কিছুদিন দর্শন ও মনোবিজ্ঞান বিষয়ের প্রভাষক হিসেবে শিক্ষকতা করেন। এখানেই তিনি বিশিষ্ট সমাজবিজ্ঞানী Charles Horton Cooley এর সন্নিধ্যে আসেন এবং তার দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হন। এরপর ১৮৯২ সালে তিনি প্রাশসনিক কর্মকর্তা পদে নিযুক্ত হন।পরবর্তীতে তিনি ১৮৯৪ সালে পূর্ণ অধ্যপক নিযুক্ত হন এবং বাকি জীবন সেখানেই কাটান। তার এ দীর্ঘ জীবন শেষে ১৯৩১ সালের ২৬ শে এপ্রিল এই মহান দার্শনিক শিকাগো শহরে মৃত্যু বরণ করেন।
হার্বার্ট মিডের রচনাবলি (Writing Of George Herbert Mead): হারবার্ট মিড  মূলত দার্শনিক হলেও বিভিন্ন সমাজতাত্ত্বিক দিক দিয়েও গবেষণা করেনএবং গ্রন্থ রচনা করেন। যেসব গ্রন্থের মধ্যে হার্বার্ট মিড তার চিন্তাধারা সম্পর্কে আলোচনা করেছেন নিম্ন এসগুলোর নাম উল্লেখ করা হলো-
i- The Philosophy Of Present (1932)
ii- Mind self and Society (1934)
iii- Movement of the thought in nineteenth Century (1936)
iv- The Philosophy of the Act (1938)
v- The Objective Reality of Perspective (1927)
vi- The Psychology of Social consciousness implied in Instruction Science (1910)
vii- Essays on his Social Philosophy.
viii- The Indevidual and the Social self by D. Miller (1982)
ix- Selected writing Ed by. A Rock (1964)
পরিশেষে বলা যায় অসংখ্য রচনাবলির মাধ্যমে হার্বার্ট মিড সমাজবিজ্ঞানকে সমৃদ্ধ করেন।
হারবার্ট মিডের প্রতীকী মিথস্ক্রিয়াবাদঃ সামাজিক মিথস্ক্রিয়া সম্পন্ন হয়ে থাকে মূলত মানুষ বস্তুগত ও মানবজগতের প্রতি কিভাবে আচরণ করে এবং কিভাবে তাদের আচরণের অর্থ উপলব্ধি করে। হার্বার্ট মিড মিথস্ক্রিয়া সম্পর্কে ব্যাখ্যা দিয়েছেন। এছাড়া আরো অনেকে ব্যাখ্যা দিয়েছেন।

আরো পড়ুন- প্রতীকী মিথস্ক্রিয়াবাদ কী?

জর্জ হার্বার্ট মিড প্রতীকী মিথস্ক্রিয়াবাদের ব্যাখ্যায় চারটি বিষয়ে বেশি গুরুত্ব আরোপ করেছেন। যথা- (ক) অহমবোধ (খ) আত্মমিথস্ক্রিয়া (গ) আত্মার বিকাশ (ঘ) প্রতীকী অর্থ।
১। অহমবোধঃ প্রতীকী মিথস্ক্রিয়াবাদের গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো অহমবোধ। হার্বার্ট মিড অহমবোধকে সমাজবিজ্ঞানের একটি কার্যকরী অঙ্গ হিসেবে দেখিয়েছেন। ব্যক্তি তার নির্দিষ্ট পরিবেশে আচরণ করে এবং তার উদ্দেশ্য ব্যক্ত করে নেই। তিনি  things and object এর মধ্যে পার্থক্য তুলে ধরে দেখিয়েছেন যে, ব্যক্তি কার্যক্রমের মাধ্যমে  Things Object  এ পরিণত হয়। তিনি এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসেবে বলেছেন টমেটো যখন খাওয়া হয় এটি পুষ্টি হিসেবে ব্যবহৃত হয় কিন্তু যখন কারো দিকে ছুড়ে মারা হয় তথন ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ ঘটে।
মিড অহমকে আবার ২ ভাগে অআগ করেছেন (ক) আমি (খ) আমাকে।
(ক) আমিঃ ামি হচ্ছে অন্যর প্রতি মনোভাব প্রকাশে ব্যক্তির বা প্রাণীর অসংগতির প্রতিক্রিয়া এবং আচরণের সয়ংক্রিয় ও আবেগজড়িত অবস্থা।
(খ) আমাকেঃ এটি হচ্ছে ব্যক্তির নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি যা সে অন্যর কাছ থেকে শিখেছে।
২। অত্মমিথস্ক্রিয়াঃ অত্মমিথস্ক্রিয়া কাজ করে মানব কর্মকান্ডে মিডের ধারনার কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে। এর ভিত্তি হলো আত্মমিথস্ক্রিয়া। হারবার্ট মিডের মতে যোগাযোগ হলো এমন একটি প্রক্রিয়া যেখানে প্রতিটি ব্যক্তির ভূমিকা থাকে।
৩। আত্মার বিকাশঃ এই বিকাশের ক্ষেত্রে তিনি তিনটি পর্বের কথা বলেছেন।
(i) Imitation Stage (অনুকরণ স্তর)
(ii) Play stage (খেলা স্তর)
(iii) Game stage (ক্রিড়া স্তর)
(i) Imitation Stage (অনুকরণ স্তর): এই স্তরের শুরু হয় শিশুর ২ বছর বয়সে। শিশু এই সময় তার পরিচিত সামাজিক পরিমন্ডল মধ্যকার প্রতিটি ব্যক্তির অভিব্যক্তি অনুকরণ করতে শেখে।
(ii) Play stage (খেলা স্তর): এই স্তরের শুরু হয় ৩ বছর বয়স থেকে । একে মিড বলেছেন সক্রিয়তার স্তর হিসেবে। এ সময় শিশু নিজেকে অন্যর স্থানে নিয়ে আসতে পারে।
(iii) Game stage (ক্রিড়া স্তর): শিশুকাল বয়সের পর এ পর্যায়ের শুরু হয়। বালক এই সময়ে সাধারণত নিয়মকানুনের সাথে খাপ খাওয়াতে পারে।
৪। প্রতীকী অর্থঃ মিড ভাষাকে প্রতীকে একটি বিস্তৃত ব্যবস্থা মনে করেন।শব্দ ও প্রতীক সেটিও কোনো বস্তুর প্রতিনিধিত্ব করে। তিনি প্রতীকী মিথস্ক্রিয়া ব্যাখ্যা করতে গিয়ে দু ধরনের কার্যকারিতার উপর নির্ভর করেন-
(ক) তাৎপর্যপূর্ণ অঙ্গভঙ্গি (Significant gesture)
(খ) তাৎপর্যহীন অঙ্গভঙ্গি (Non- Significant gesture)
হারবার্ট মিড মনে করেন তাৎপর্যহীন অঙ্গভঙ্গি স্বয়ংক্রিয়ভাবে সাড়া দেয় কিন্তু তাৎপর্যপূর্ণ অঙ্গভঙ্গি স্বয়ংক্রিয়ভাবে সাড়া দেয় না।
হারবার্ট মিড প্রতীকী মিথস্ক্রিয়ার ৩টি মৌলিক নীতির কথা বলেছেন-
(i) অর্থ বা উদ্দেশ্য (Meaning)
(ii) ভাষা (Language)
(iii) চিন্তা (Thought)
(i) অর্থ বা উদ্দেশ্য (Meaning): অর্থ বা উদ্দেশ্যকে সামাজিক বাস্তবতার গঠন বলা হয়। মানুষ অন্যের বা অন্য বস্তুর প্রতি ভূমিকা পালন করে সেই অর্থে যা তারা ঐ মানুষ বা বস্তুগুলোর উপর আরোপ করে।
(ii) ভাষা (Language): ভাষা হলো অর্থ বা উদ্দেশ্যর অর্থ। অর্থ বা উদ্দশ্যের সামাজিক মিথস্ক্রিয়া থেকে আসে যা মানুষ একে অন্যের মধ্যে প্রত্যক্ষ করে।
(iii) চিন্তা (Thought): চিন্তা বলতে বোঝায় অন্যর ভূমিকা গ্রহণ করা। এক্ষেত্রে ব্যক্তি কোন কাজের পূর্বে চিন্তা করে অথবা চিন্তার প্রতি সাড়া দেই।
সমালোচনাঃ এ তত্ত্বের গুরুত্ব থাকলে তত্ত্বটি বিভিন্নভাবে সমালোচিত হয়েছে।
* এই তত্ত্বটি তাত্ত্বিক গঠন অনেকটা অস্পষ্ট এবং এটা ক্ষমতা ও দ্বন্দ্বের পরিবর্তনে কিছুই বলে না।
*ক্রিয়া করার ক্ষেত্রে মানুষ এয প্রতীকীর অর্থ বের করে তার উৎস কী সে ব্যাখ্যা এ তত্ত্বে পাওয়া যায় না।
উপসংহারঃ পরিশেষে বলা যায় যে উপরিউক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায় যে হার্বার্ট মিডের প্রতীকী মিথস্ক্রিয়াবাদ তত্ত্বটি সমাজ মনোবিজ্ঞানে গভীর প্রভাব বিস্তার করেছে। যদিো তার তত্ত্বের গুরুত্ব অপরিসীম্ আধুনিক সমাজবিজ্ঞানে এর মর্যাদা উচ্চ আসনে সমাসীন হয়ে আছে।

Comments

Popular posts from this blog

জনসংখ্যা সমস্যা কি? উন্নয়ণশীল দেশগুলিতে জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণসমুহ লিখ?

শিল্প বিপ্লব কি? সমাজবিজ্ঞান উদ্ভব ও বিকাশে শিল্প বিপ্লব ও ফরাসি বিপ্লবের ভূমিকা

রাষ্ট্রের উৎপত্তি সংক্রান্ত মতবাদ অলোচনা কর?