নির্ভরশীলতা প্যারাডাইম এর উৎপত্তির কারণসমূহ লেখ

নির্ভরশীলতা প্যারাডাইম এর উৎপত্তির কারণসমূহ লেখ

সমাজবিজ্ঞানীদের আলোচনার  অন্যতম বিষয়বস্তু হলো সমাজ রাষ্ট্র দেশ ও জাতি। তাদের এসব ব্যাখ্যা করা চিরন্তর। সমাজবিজ্ঞানীরা যেমন একদিকে সমাজকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্রভাবে ভাগ করেছেন অন্যদিকে সেগুলোর পেক্ষাপটে দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক চিত্রও আলোচনা করেছেন। সমাজবিজ্ঞানীরা সমাজ ব্যবস্থার উন্নয়নে যে সকল তত্ত্ব দেন তা আধুনিকায়ন তত্ত্ব নামে পরিচিত। আধুনিকায়ন তত্ত্বের মাধ্যমে অনুন্নত দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন না করতে পারায় এ তত্তের সমালোচনা লেখা শুরু হয় । এ সমালোচনা লেখা থেকে আর একটি নতুন তাত্ত্বিক  মতবাদ সৃষ্টি হয় যা নির্ভরশীলতা প্যারাডাইম নামে পরিচিত।

নির্ভরশীলতা প্যারাডাইমঃ ইংরেজি Dependency শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ নির্ভরশীলতা।সাধারণত নির্ভরশীলতা বলতে কোন কিছুর জন্য অন্যের উপর নির্ভর করাকে বুঝায়। নির্ভরশীলতা শব্দটি আর্থসামাজিক উন্নয়নের পরিপ্রেক্ষিতে রচিত।  এটি এমন এক ধরনের প্রক্রিয়া যার মধ্য দিয়ে তৃতীয় বিশ্ব এক ধরনের নির্ভরশীল সম্পর্কের মধ্য প্রবেশ করে। যার মধ্য দিয়ে নির্ভরশীল রাষ্ট্রগুলো অধস্তন অবস্থায় পতিত হয়।

নির্ভরশীলতা প্যারাডাইম এর উৎপত্তির কারণঃ  ষাটের দশকের আগে এ তত্ত্ব তেমন বিকাশ লাভ করতে পারেনি তবে ষাট দশকের পরে এ তত্ত্ব ব্যাপক সমালোচনার মুখে পরে। এ সময় সামাজিক বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখা থেকে আধুনিকায়ন তত্ত্বের তাত্ত্বিকের সমালোচনা শুরু হয়। এই সমালোচনার ফলে নির্ভরশীলতা প্যারাডাইমের বিকাশ লাভ করে। নিম্নে নির্ভরশীলতা প্যারাডাইম এর উৎপত্তির বিস্তারিত আলোচনা করা হলো-

১। রার্ডল প্রবিশ এর প্রতিবেদনঃ ১৯৪৮ সালে জাতিসংঘের উদ্যোগে  ল্যাটিন আমেরিকার অনুন্নয়নের কারণ অনুসন্ধানের জন্য ECLA (Economic Commission of Latin America)  নামে একটি কমিশন গঠন করা হয়।  রার্ডল প্রবিশ ছিলেন এ কমিশনের প্রধান।রার্ডল বিভিন্ন দেশের করা প্রতিবেদনের প্রক্ষিতে দেখান যে কিভাবে উন্নত দেশের সাথে বাণিজ্যের মাধ্যমে অনুন্নত দেশ উন্নতি লাভ করছে। তিনি তার বিশ্লেষণে স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছেন যে অনুন্নত দেশগুলি শুধু কৃষিপন্য রপ্তানি করে এবং শিল্পজাত দ্রব্য আমদানি করে। এছাড়া বাণিজ্যের শর্ত ক্রমাগত নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে ফলে তারা ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। এ অবস্থা থেকে বাচার জন্য রার্ডল প্রবিশ শিল্পের বিকল্প আমদানির কথা বলেছেন।তিনি আরও বলেন যে যখন থেকে ল্যাটিন আমেরিকায় উপনিবেশ স্থাপিত হয়েছে তখন থেকেই অনুন্নত অবস্থার শুরু হয়েছে। এর কারণ হচ্ছে ঔপনিবেশিক শক্তিগুলো উপনিবেশ স্থাপিত দেশের সম্পদ লু্ট করে নিয়ে যায়। নির্ভরশীলতা প্যারাডাইমের উৎপত্তি স্থল হলো রার্ডল প্রবিশ এর রিপোর্ট। তার মতে নির্ভরশীলতা প্যারাডাইমের মূল কথা হলো একটি সমাজের উন্নয়ণ অন্য একটি সমাজের অনুন্নয়ন। অর্থাৎ উন্নয়ণ ও অনুন্নয়ন দুটি বিপরীতমুখী ধারণা। একটি পরিবর্তিত হলে অপরটিও পরিবর্তিত হয়। আজ আমরা যে উন্নত বিশ্ব দেখি তা অনুন্নত দেশকে শৌষণ করেই হয়েছে। অন্যদিকে, একটি সমাজের কিভাবে উন্নয়ন হয় তার ব্যাখ্যা যেমন উন্নয়ন তত্ত্বে থাকে তেমনি সমাজের অনুন্নয়নের কারণ নির্ভরশীলতা প্যারাডাইমে রয়েছে। নির্ভরশীলতা প্যারাডাইমের মূলকথা হলো একটি দেশের উন্নয়ণ কেন হচ্ছে না সেটা খুজে বের করা। আর এ অনুন্নয়নের কাল খুজে বের করার পন্থা ধারণা থেকেই নির্ভরশীলতা প্যারাডাইম উদ্ভব।

২। ম্যাটস মাস এর নির্ভরশীলতা প্যারাডাইমঃ ম্যাটস মাস তার তত্ত্বে বলেন একটি সমাজের মধ্যেও নির্ভরশীরতা থাকতে পারে। সাআরণত একটি সমাজের ভিতরে প্রভাব বিস্তারকারী উপদল থাকে যা সমাজের বিভিন্ন কাঠামো ও নির্ভরশীলতার মধ্যে অসমতা তৈরি করে। যেমন যারা শহরে বাস করে তারা ক্ষমতা ও অর্থনৈতিক সম্পদকে নিয়ন্ত্রণ করে। অন্যদিকে দেশের বৃহত্তম শ্রেণি হচ্ছে কৃষক তারা গ্রামে বাস করে। ফলে শহরের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অভিজাত গ্রামের কৃষক জনগোষ্ঠীকে শোষণ করছে। যার কারণে গ্রাম থেকে শহর বেশি উন্নত আর এর ফলে গ্রাম ও শহরের মধ্যে নির্ভরশীলতা তৈরী হচ্ছে।

৩। গ্রিফিনের নির্ভরশীলতা প্যারাডাইমঃ গ্রিফিন বলেন আমরা যদি অনুন্নত দেশগুলোর অবস্থা পর্যবেক্ষণ করি তাহলে দেখা যায় ইউরোপীয় বিস্তারের জন্য এই অবস্থা। তিনি আরও বলেন ইউরোপ অনুন্নত বিশ্বকে আবিষ্কার করেনি, তারা অনুন্নত বিশ্ব সৃষ্টি করেছে। এদিক থেকে দেখা যায় যে বিশ্বের অনুন্নত দেশসমুহ ইউরোপ ও কেন্দ্রীয় শক্তির সাহায্য শোষিত হয়ে আসছে  অনুন্নত দেশগুলো পিছনে পরে থাকছে।

৪। আন্দ্রে গুন্ডার ফ্রাঙ্ক এর তত্ত্বঃ ফ্রাঙ্কের গবেষণায় দেখা যায় বেশীরভাগ মেট্টোপলিটন রাষ্ট্র স্যাটেলাইট রাষ্ট্রগুলোকে শোষণ করছে তাদের প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করছে। ফলে স্যাটালাইট রাষ্ট্রগুলো অনুন্নত থেকে যাচ্ছে।

৫। পল ব্যারন এর নির্ভরশীলতা প্যারাডাইমঃ পল ব্যারন তার নির্ভরশীলতা প্যারাডাইম আলোচনা করতে গিয়ে বলেন উন্নত দেশসমূহ মূলত অনুন্নত দেশকে শিল্পায়নে নিরুৎসাহিত করছে ফলে অনুন্নত দেশে উল্লেখযোগ্য শিল্প গড়ে উঠেনি। এ সুযোগ নিয়ে উন্নত দেশগুলি কাচামালের উৎস হিসেবে এসব দেশকে বেছে নেয় এবং তাদের প্রযুক্তি জ্ঞান দক্ষতা কাজে লাগিয়ে বিশ্ব বাজারে তাদের ভিত্তি শক্ত করে।

পরিশেষে বলা যায় নির্ভরশীলতা প্যারাডাইম যদিও আধুনিকায়ন তত্ত্বকে চ্যালেঞ্জ করে সেটা মূলত অনুন্নত দেশের অবস্থার উন্নয়নে সফল হয়নি বরং অনুন্নত বা উন্নয়নশীল দেশগুলোর উপর বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। তবে পুরোপুরি সফল না হলেও তৎকালিন সমাজ বিকাশে অনেকটা সফল হয়েছিল।

Comments

Popular posts from this blog

জনসংখ্যা সমস্যা কি? উন্নয়ণশীল দেশগুলিতে জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণসমুহ লিখ?

শিল্প বিপ্লব কি? সমাজবিজ্ঞান উদ্ভব ও বিকাশে শিল্প বিপ্লব ও ফরাসি বিপ্লবের ভূমিকা

রাষ্ট্রের উৎপত্তি সংক্রান্ত মতবাদ অলোচনা কর?