কাজী নজরুল ইসলামের সংক্ষিপ্ত জীবনী
➤ভূমিকা:-
কাজী নজরুল ইসলাম বাংলা সাহিত্যের এক বিস্ময়কর প্রতিভা, যিনি বিদ্রোহের কবি হিসেবেই বেশি পরিচিত। তাঁর কাব্য, গান ও সাহসী চিন্তা বাংলা জাতিকে জাগিয়ে তুলেছিল। তিনি বাংলাদেশের জাতীয় কবি হিসেবেও সম্মানিত।
জন্ম ও শৈশব:
কাজী নজরুল ইসলাম জন্মগ্রহণ করেন ১৮৯৯ সালের ২৪ মে পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে। তাঁর ডাকনাম ছিল “দুখু মিয়া”, যা যেন তাঁর শৈশবের দারিদ্র্যের প্রতিচ্ছবি। পিতা কাজী ফকির আহমেদ ছিলেন মসজিদের ইমাম। পিতার অকালমৃত্যুর পর মাত্র ৯ বছর বয়সে নজরুলকে সংসারের হাল ধরতে হয়।
শিক্ষাজীবন ও লেটো দলে যোগদান:
প্রাথমিক শিক্ষা নেওয়ার পর নজরুল লেটো দলে যোগ দেন, যেখানে তিনি অভিনয়, গান ও কবিতা রচনার চর্চা করেন। এখানেই তাঁর সাহিত্যিক সত্তার ভিত্তি তৈরি হয়। পরে আবার স্কুলে ফিরে এলেও আর্থিক সমস্যার কারণে শিক্ষাজীবন বারবার ব্যাহত হয়। জীবিকার জন্য তিনি বিভিন্ন কাজ যেমন মুয়াজ্জিন, রুটি বানানো, খানসামা ইত্যাদি করতে বাধ্য হন।
সেনা জীবন:
১৯১৭ সালে তিনি ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে যোগ দেন এবং করাচি সেনানিবাসে কর্মরত থাকাকালে সাহিত্যচর্চা অব্যাহত রাখেন। এই সময়েই তিনি 'মুক্তি' নামের প্রথম কবিতা লেখেন এবং 'বাউন্ডুলের আত্মকাহিনি'সহ বেশ কিছু গল্পও রচনা করেন।
সাহিত্য ও সাংবাদিকতা:
সেনাবাহিনী ত্যাগ করে নজরুল কলকাতায় ফিরে আসেন এবং সাহিত্য ও সাংবাদিকতা জীবনে প্রবেশ করেন। তিনি *ধুমকেতু* নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন, যা ব্রিটিশবিরোধী লেখার কারণে বন্ধ হয়ে যায় এবং তিনি কারাবরণ করেন। এ সময়েই লেখা ‘বিদ্রোহী’ কবিতা তাঁকে চিরস্মরণীয় করে তোলে।
সংগীত ও সাহিত্যকর্ম:
নজরুলের লেখা গানের সংখ্যা ৪০০০ ছাড়িয়েছে। তাঁর গানগুলো 'নজরুলগীতি' নামে পরিচিত। তিনি হিন্দু ও মুসলিম উভয় সংস্কৃতিকে সম্মান করে গান ও কবিতা রচনা করেন, যা ধর্মীয় সম্প্রীতির এক উজ্জ্বল নিদর্শন। উল্লেখযোগ্য রচনার মধ্যে রয়েছে *অগ্নিবীণা*, *বাঁধনহারা*, *চল চল চল*, *বিশের বাঁশি* ইত্যাদি।
রাজনীতি ও বিদ্রোহ:
নজরুল অসহযোগ আন্দোলনের সময় গান ও কবিতার মাধ্যমে জনসচেতনতা তৈরিতে ভূমিকা রাখেন। রাজনৈতিক আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণের জন্য একাধিকবার কারাবন্দীও হন।
পারিবারিক জীবন:
নজরুল প্রথমে নার্গিস নামে এক তরুণীর সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হলেও পরে প্রমীলা দেবীর সঙ্গে তাঁর গভীর সম্পর্ক গড়ে ওঠে এবং তিনি তাঁকেই জীবনসঙ্গিনী হিসেবে বেছে নেন। দাম্পত্য জীবনে তাঁদের চার সন্তান জন্মগ্রহণ করে, তবে দুজন অল্প বয়সেই মৃত্যুবরণ করেন।
অসুস্থতা ও জীবনের শেষ পরিণতি:
১৯৪২ সালে নজরুল দুরারোগ্য অসুস্থতায় আক্রান্ত হয়ে বাকশক্তি হারান। এরপর থেকে তিনি দীর্ঘদিন মানসিক ভারসাম্যহীন অবস্থায় ছিলেন। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ সরকার তাঁকে ঢাকায় নিয়ে আসে এবং নাগরিকত্ব প্রদান করে। তিনি ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর সমাধি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদ প্রাঙ্গণে।
পুরস্কার ও সম্মাননা:
নজরুল পেয়েছেন পদ্মভূষণ, জগত্তারিণী স্বর্ণপদক, একুশে পদক, স্বাধীনতা পুরস্কারসহ নানা সম্মাননা। ১৯৭৪ সালে তাঁকে বাংলাদেশের জাতীয় কবি হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
উপসংহার:
কাজী নজরুল ইসলাম শুধু একজন কবি নন, তিনি বাংলা সাহিত্যে এক বিদ্রোহী চেতনার প্রতীক। তাঁর জীবনসংগ্রাম ও সাহিত্য কর্ম আজও আমাদের প্রেরণা জোগায়। তিনি ধর্ম-বর্ণ-শ্রেণি নির্বিশেষে মানবতার কণ্ঠস্বর হয়ে থাকবেন চিরকাল।