রাজনৈতিক সমাজবিজ্ঞানের প্রকৃতি ও পরিধি বা বিষয়বস্তু আলোচনা কর
রাজনৈতিক সমাজবিজ্ঞানের প্রকৃতি ও পরিধি বা বিষয়বস্তু আলোচনা কর
👉👍ভূমিকাঃ রাজনৈতিক সমাজবিজ্ঞান মূলত একটি মিশ্র প্রকৃতির বিজ্ঞান। সমাজবিজ্ঞান ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের চলমান সম্পর্কের ফলে রাজনৈতিক সমাজবিজ্ঞানের আবির্ভাব হয়। বিশ শতকের পূর্বেই মানুষের জ্ঞান চর্চা বিকাশের ফলে সমাজবিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখা প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে। এসব ব্যাখ্যা সমূহে ভিন্ন ভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয়। আর এই শাখাগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো রাজনৈতিক সমাজবিজ্ঞান। রাজনৈতিক সমাজবিজ্ঞান নবীন শাখা হিসেবে আধুনিককালে আত্মপ্রকাশ করেন। বর্তমান বিশ্বে গতিশীল রাজনীতিতে রাজনৈতিক সমাজবিজ্ঞানে নতুন নতুন ধারা সংযোজন হচ্ছে ফলে এর জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
রাজনৈতিক সমাজবিজ্ঞানের প্রকৃতিঃ সামাজিক বিজ্ঞানের নবীন শাখা হিসেবে রাজনৈতিক সমাজবিজ্ঞানের আত্মপ্রকাশ ঘটে যে কারণে এর প্রকৃতি সম্পর্কে ধারণা থাকা আবশ্যক। নিম্নে রাজনৈতিক সমাজবিজ্ঞানের প্রকৃতি সম্পর্কে আলোচনা করা হলো-
১। অধিকতর বাস্তববাদীঃ রাজনৈতিক সমাজবিজ্ঞান অধিকতর বাস্তববাদী বিজ্ঞান। বিভিন্ন ধরনের সামাজিক বিজ্ঞানের বিষয় বস্তু গবেষণার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সমাজবিজ্ঞান অভিঙ্গবাদী ও পরীক্ষা নিরীক্ষামূলক পদ্ধতি অনুসরণ করে। অন্যদিকে অনুমানমূলক ধারণাকে এড়িয়ে চলে। তাই রাজনৈতিক সমাজবিজ্ঞানকে একটি বাস্তববাদী বিজ্ঞান বলা হয়।
২। গতিশীল প্রকৃতির বিজ্ঞানঃ রাজনৈতিক সমাজবিজ্ঞান এক ধরনের গতিশীল প্রকৃতির বিজ্ঞান। যে কারণে অনেক সমাজতাত্ত্বিক রাজনৈতিক সমাজবিজ্ঞানের সর্বজনীন সংজ্ঞা প্রদান করতে চাইলেও ব্যর্থ হয়েছন। যার কারণে রাজনৈতিক সমাজবিজ্ঞান এর পরিধি দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এজন্য সমাজতাত্ত্বিকগণ রাজনৈতিক সমাজবিজ্ঞান কে গতিশীল প্রকৃতির বিজ্ঞান বলেছেন।
৩। ক্ষমতার পরিমাপকারীঃ রাজনৈতিক সমাজবিজ্ঞান কে ক্ষমতার পরিমাপকারী বিজ্ঞান বলা হয়। কেননা রাজনৈতিক সমাজবিজ্ঞান যেহেতু রাজনীতি নিয়ে আলোচনা করে আর রাজনীতির সাথে ক্ষমতা ওতপ্রতভাবে জড়িত। রাজনীতির সাথে জড়িত ব্যক্তিদের মধ্যে ক্ষমতার বন্টন, ক্ষমতার প্রয়োগ ইত্যাদি রাজনৈতিক সমাজবিজ্ঞান পরিমাপ করে। এজন্য রাজনৈতিক সমাজবিজ্ঞানকে ক্ষমতার পরিমাপকারী বলা হয়।
৪। অন্তঃবিষয়ক বিজ্ঞানঃ রাজনৈতিক সমাজবিজ্ঞানকে অন্তঃবিষয়ক বিজ্ঞান বলা হয়। রাজনৈতিক সমাজবিজ্ঞানের উৎপত্তি ও প্রকৃতি আলোচনা করতে গিয়ে প্রখ্যাত সমাজবিজ্ঞানী Giovanni Sartoni বলেন- “রাজনৈতিক সমাজবিজ্ঞান মূলত একটি অন্তঃবিষয়ক বিজ্ঞান।” কারণ রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞানের শূন্যতা পূরণ করার জন্যই রাজনৈতিক সমাজবিজ্ঞান এর আবির্ভাব ঘটেছে বলে মনে করা হয়।
৫। নতুন প্রকৃতির বিজ্ঞানঃ রাজনৈতিক সমাজবিজ্ঞান এককভাবে নতুন প্রকৃতির বিজ্ঞান। কেননা একদিকে রাজনৈতিক সমাজবিজ্ঞান যেমন রাষ্ট্রবিজ্ঞান নয়, আবার অন্যদিকে সমাজবিজ্ঞান ও নয়। কারণ সমাজবিজ্ঞান সমাজ নিয়ে আলোচনা করে আর রাষ্ট্রবিজ্ঞান রাষ্ট্র নিয়ে আলোচন করে। এই দুই বিজ্ঞানের মিশ্রণে রাজনৈতিক সমাজবিজ্ঞান এর আবির্ভাব তাই রাজনৈতিক সমাজবিজ্ঞান নতুন প্রকৃতির বিজ্ঞান।
৬। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পরিধি সম্প্রাসারণকারীঃ রাজনৈতিক সমাজবিজ্ঞান হলো রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পরিধি সম্প্রসারণকারী।কেননা, যে বিষয়গুলো নিয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান আলোচনা করে সেই বিষয়গুলো ভিন্নভাবে ভিন্ন দৃষ্টিকোণ হতে রাজনৈতিক সমাজবিজ্ঞান আলোচনা করে থাকে।যার কারণে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পরিধি সম্প্রসারিত হচ্ছে।
৭। স্বতন্ত্র বিজ্ঞানঃ রাজনৈতিক সমাজবিজ্ঞানকে স্বতন্ত্র বিজ্ঞান বলা হয় । একটি শাস্ত্রকে বিজ্ঞান হিসেবে চিহিৃত করতে গিয়ে Morton A. Kplan (মর্টন এ কাপলন) ৫টি বৈশিষ্ট্যর কথা বলেন। সেগুলো হলোঃ
- প্রথমত- সংশিলষ্ট শাস্ত্রের বিভিন্ন বিষয়কে আলোচনার জন্য বিজ্ঞান সম্মত তাত্ত্বিক ভিত্তি থাকবে।
- দ্বিতীয়ত- প্রতিটি বিষয়ে সুস্পষ্ট থারণা কাঠামো।
- তৃতীয়ত- নির্দিষ্ট আলোচ্যসূচি ও আলোচ্যসূচির অন্তর্ভূক্ত প্রতিটি বিষয়ের সুনির্দিষ্ট সীমারেখা।
- চতুর্থত- প্রতিটি বিষয়ের সাথে কয়েকটি সাধারণ সূত্র সংযোগ থাকবে।
- পঞ্চমত- আলোচ্য বিষয়গুলোর প্রতিটির স্বকীয়তা।
আর উপরিল্লেখিত সকল বিষয় রাজনৈতিক সমাজবিজ্ঞানের মধ্য বিদ্যমান তাই রাজনৈতিক সমাজবিজ্ঞানকে একটি স্বতন্ত্র বিজ্ঞান ও বলা হয়।
৮। মিশ্র প্রকৃতির বিজ্ঞানঃ রাজনৈতিক সমাজবিজ্ঞান কে মিশ্র প্রকৃতির বিজ্ঞান বলা হয়। কেননা, রাজনৈতিক সমাজবিজ্ঞানীরা যেমন রাজনৈতিক ব্যবস্থায় আলোচনা করেন তেমনি সমাজব্যবস্থার উপর রাজনৈতিক দলের প্রভাব প্রতিক্রিয়া সম্পর্কেও আলোচনা করেন। যার কারণে রাজনৈতিক সমাজবিজ্ঞান কে মিশ্র প্রকৃতির সমাজবিজ্ঞান বলা হয়। এ প্রসঙ্গে অমল কুমার মুখোপ্যাধ্যায় বলেন- রাজনৈতিক সমাজবিজ্ঞান আসলে একটি সংযোগ স্থাপনকারী সেতু যা অনেকাংশে রাজনৈতিক সমাজবিজ্ঞানের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের বিশ্বাস করে এবং সামাজিক ও রাজনৈতিক চলক সমূহের উপর সমান গুরুত্ব আরোপ করে।
রাজনৈতিক সমাজের পরিধি বা বিষয়বস্তুঃ রাজনৈতিক সমাজবিজ্ঞান একটি গতিশীল বিজ্ঞান। এর পরিধি বা বিষয়বস্তু সম্পর্কে সহজে বলা সম্ভব নয়। তাই এর পরিধি বা বিষয়বস্তু সম্পর্কে জানা আবশ্যক ।
১। অরাজনৈতিক রাজনীতিঃ রাজনৈতিক সমাজবিজ্ঞান অরাজনৈতিক রাজনীতি নিয়ে আলোচনা করে। বর্তমান সময়ের রাজনীতি আজ রাষ্ট্রে পরিধির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। রাষ্ট্রীয় গন্ডির সীমাবদ্ধতা থেকে আধুনিক রাজনীতি অনেকাংশে মুক্ত।অর্থাৎ রাজনৈতিক সমাজবিজ্ঞান অরাজনৈতিক রাজনীতি ও সমাজবিজ্ঞানের পরিবর্তনীয় উপাদান সমূহের ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ করে।
২। রাষ্ট্র ও রাজনীতিঃ রাজনৈতিক সমাজবিজ্ঞান এর প্রধান আলোচ্য বিষয় হলো রাষ্ট্র ও রাজনীতি। ভিন্ন দৃষ্টিকোণ হতে রাজনৈতিক সমাজবিজ্ঞান রাষ্ট্র ও রাজনীতি নিয়ে আলোচনা করে। রাষ্ট্রবিজ্ঞান রাষ্ট্র নিয়ে আলোচনা করে এবং সমাজবিজ্ঞান সমাজ নিয়ে আলোচনা করে। আর রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞান কিভাবে রাষ্ট্রের উপর প্রভাব ফেলে সে বিষয় নিয়ে রাজনৈতিক সমাজবিজ্ঞান আলোচনা করে।
৩। আমলাতন্ত্রঃ রাজনৈতিক সমাজবিজ্ঞান আমলাতন্ত্র নিয়ে ব্যাপকভাবে আলোচনা করে।রাজনৈতিক সমাজবিজ্ঞানে আমলাতন্ত্রকে একটি সামাজিক গোষ্ঠী হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সমাজ যত উন্নত হচ্ছে তত বেশি জটিল হচ্ছে এবং তার সাথে সমাজে আমলাতন্ত্রে প্রয়োজনীয়তা বাড়ছে। যার কারণে রাজনৈতিক সমাজবিজ্ঞান এ আমলাতন্ত্রকে কোন রাজনৈতিক বিষয় হিসেবে ধরা হয় না বরং আমলাতন্ত্রকে বৃহৎ সামাজিক প্রেক্ষাপটে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করা হয়।
৪। এলিট নিয়ে আলোচনাঃ রাজনৈতিক সমাজবিজ্ঞানে এলিট শ্রেণি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে বিবেচিত। সমাজে এক শ্রেণি রয়েছে যাদের সমাজে ক্ষমতা বেশিএবং অন্যদের প্রভাবিত করতে পারে তাদেকেই এলিট বলা হয়। সাধারণত এলিটরা সমাজের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে থাকে। এলিট শ্রেণির গতিবিধি রাজনৈতিক সমাজবিজ্ঞানীরা ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করে।
৫। সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তনঃ রাজনৈতিক সমাজবিজ্ঞান সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তন ব্যাখ্যা করে। সমাজ সদা পরিবর্তনশীল । তাই সমাজ পরিবর্তন হলে রাজনীতির উপর প্রভাব পড়ে আবার রাজনীতি পরিবর্তন হলে সমাজের উপর প্রভাব পড়ে। এই পরিবর্তনের মধ্যে ভারসাম্য থাকলে সমাজের মধ্যে ভারসাম্য থাকে। আর এ বিষয়গুলো নিয়ে রাজনৈতিক সমাজবিজ্ঞানীরা বিশ্লেষণ করে।
৬। কর্তৃত্বের আলোচনাঃ রাজনৈতিক সমাজবিজ্ঞানে কর্তৃত্ব সর্বদায় গুরুত্বপূর্ণ। ক্ষমতাকে বৈধ করতে পারলে কর্তৃত্বে পরিণত হয়। আর ক্ষমতা কর্তৃত্বে পরিণত হলে ক্ষমতার প্রয়োগ ও বৈধ হয়। তবে ক্ষমতার বৈধতা অনেকাংশে জনগণের উপর নির্ভর করে। কারণ, ক্ষমতা প্রয়োগের বৈধতা জনগণ কর্তৃক স্বীকৃত হওয়ার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।
৭। রাজনৈতিক সংস্কৃতিঃ রাজনৈতিক সংস্কৃতি ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ ছাড়া একটি সমাজের প্রকৃত রাজনৈতিক ব্যভস্থা সম্পর্কে জানা সম্ভব নয়। মানুষের সামাজিক জীবন ধারায় রাজনৈতিক সংস্কৃতির সৃষ্টি ও বিকাশ।কোন সমাজের রাজনীতি সফল হবে না ব্যর্থহবে সেটা নির্ভর করে সে সমাজের রাজনৈতিক সংস্কৃতির উপর।
৮। রাজনৈতিক দল ও চাপ সৃষ্টিকারী দলঃ রাজনৈতিক সমাজবিজ্ঞানে রাজনৈতিক দল ও চাপ সৃষ্টিকারী দল বা গোষ্ঠী নিয়ে আলোচনা করা হয়। রাজনৈতিক দল একটি সমাজের চালিকা শক্তি হিসেবে কাজ করে। আবার চাপসৃষ্টিকারী দল রাজনৈতিক দলকে সঠিক পথে পরিচালনা করতে সাহায্য করে। যদি সামাজিক ও রাজনৈতিক পরক্রিয়ায় কোন প্রকার দ্বন্দ্ব দেখা দিলে সেক্ষেত্রে চাপসৃষ্টিকারী দল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে ।
৯। রাজনৈতিক সামাজিকীকরণঃ রাজনৈতিক সমাজবিজ্ঞান এ রাজনৈতিক সামাজিকীকরণ নিয়ে আলোচনা করা হয়। যে প্রক্রিয়ায় সমকালীন রাজনৈতিক সংস্কৃতি পরবর্তী প্রজম্মে প্রবাহিত হয় তাকে রাজনৈতিক সামাজিকীকরণ বলে। যা রাজনৈতিক সমাজবিজ্ঞানের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
পরিশেষে বলা যায় যে, রাজনৈতিক সমাজবিজ্ঞানীরা রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞানের সকল শাখা নিয়ে রাজনৈতিক সমাজবিজ্ঞান আলোচনা করে । রাজনৈতিক সমাজবিজ্ঞানে সমাজের উপর রাজনীতির প্রভাব ও রাজনীতির উপর সমাজের প্রভাব নিয়ে আলোচনা করা হয়।
Comments
Post a Comment