জর্জ হোমান্স এর সামাজিক আচরণ সম্পর্কিত প্রধান নীতিমালা ব্যাখ্যা কর

জর্জ হোমান্স এর সামাজিক আচরণ সম্পর্কিত প্রধান নীতিমালা বা বিনিময় তত্ত্ব আলাচনা কর

ভূমিকা:- জর্জ ক্যাসপাস হোমান্স একজন আমেরিকান সমাজবিজ্ঞানী ও চিন্তাবিদ। এই চিন্তাবিদ ক্ষুদ্র গোষ্ঠির সামাজিক প্রক্রিয়া সম্বন্ধে অগ্রসরমান পরীক্ষালব্ধ পূর্বানুমান এবং ব্যাখার ক্ষেত্রে একজন পথিকৃৎ তাত্ত্বিক হিসেবে সমাদৃত। এই তাত্ত্বিক সমজাবিজ্ঞানী ট্যালকট পারসন্স এর সাথে দীর্ঘদিন ঘনিষ্টভাবে কাজ করতে গিয়ে সমাজবিজ্ঞানের প্রতি আকৃষ্ট হন। বিনিময় তত্ত্ব ও স্তরায়ন তত্ত্ব সমাজবিজ্ঞানী হোমান্সের দুইটি উল্লেখযোগ্য তাত্ত্বিক অবদান।

জর্জ হোমান্স এর সামাজিক আচরণ সম্পর্কিত প্রধান নীতিমালা ব্যাখ্যা কর

জর্জ হোমান্স এর সামাজিক বিনিময় তত্ত্ব:

জর্জ ক্যাসপাস বোমান্স-এর একটি যুগান্তকারী তত্ত্ব হলো সামাজিক বিনিময় তত্ত্ব। নিম্নে তাঁর এই তত্ত্বটি আলোচনা করা হলো-

সামাজিক বিনিময় তত্ত্বের প্রাথমিক ধারণা:

সামাজিক বিনিময় তত্ত্ব বলতে সাধারণ অর্থে সেই তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গিকে বুঝানো হয়েছে যেখানে সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে বিভিন্ন গোষ্ঠী বা দলের মধ্যকার সম্পর্ককে ব্যাখ্যা করা হয়। সামাজিক বিনিময় তত্বের মূল বিষয়বস্তু হলো মানুষের সামাজিক সম্পর্ক, যা গঠিত হয় Subjective cast benefit analysis এবং Comparison of alternative বিষয় দুটি ব্যবহার ও বিবেচনার মাধ্যমে। ১৯৫৮ সালে বিশিষ্ট সমাজবিজ্ঞানী জর্জ হোমান্সের দ্বারা সামাজিক বিনিময় তত্ত্বটি বিকাশিত হয়।

তিনি সামাজিক বিনিময় তত্ত্বকে বাস্তব বা অবাস্তব। ব্যয়বহুল অথষ্য পুরস্কৃত কমপক্ষে দুইজন ব্যক্তির মধ্যকার কার্যকলাপের বিনিময় হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। সামাজিক বিনিময় তত্ত্ব বিকাশের মূল লক্ষ্য ছিল মানুষকে সামাজিক সম্পর্কগুলো ভালোভাবে বুঝানো। আমরা কোনো সম্পর্ক তৈরি করি এবং সম্পর্কগুলোর মধ্যে কোন বিশেষ সম্পর্কে Continue করি তা ব্যাখ্যা করে এই তত্ত্বটি। তাছাড়া যোগাযোগ ও মিথস্ক্রিয়া এবং মানুষের মিথস্ক্রিয়ার ক্ষেত্রে যে বিষয়গুলো কাজ করে সেগুলো সম্পর্কেও আলোকপাত করে এই সামাজিক বিনিময় তত্ত্ব।

জর্জ হোমান্সের সামাজিক আচরণ সম্পর্কিত প্রধান নীতিমালা:

সমাজবিজ্ঞানী George Homan's  সামাজিক বিনিময় তত্ত্বকে সংক্ষেপে তিনটি প্রস্তাবনার মাধ্যমে বর্ণনা করেছেন। প্রস্তাবনা তিনটি হলো-

(ক) সাফল্য প্রস্তাবনা (Success Proposition):

যখন কোন ব্যক্তি কোনো কাজের জন্য পুরস্কৃত হয় তখন সে কাজটি পুনরায় এবং বার বার করতে থাকে। এটাকে হোমান্স সাফল্য প্রস্তাবনা নামে অবিহিত করেছেন।

(খ) কর্মপ্রেরণা প্রস্তাবনা (Stimulus Proposition):

অতীতে কোন ব্যক্তি যে উদ্দীপনায় যত তাড়াতাড়ি উদ্দীপৃত হয়, ব্যক্তি তত তাড়াতাড়ি সেই ব্যাপারে প্রতিক্রিয়া দেখাবে। অর্থাৎ সামাজিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে কর্মপ্রেরণা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

(গ) বঞ্চনা (Deprivation):

সামাজিক বিনিময়ের ক্ষেত্রে হোমান্স বর্ণিত তৃতীয় প্রস্তাবটি হলো  বঞ্চনা। অতীতে কোন কাজ করার পর যত পুরষ্কার কম পাওয়া যায়, সেই কাজটি ব্যক্তির কাছে তত মূল্যহীন হয়ে পড়ে। অর্থাৎ পুরস্কারের আশা না থাকলে কোন কাজ পুনরাবৃত্তি হার অনেকটা কমে যায়।

১। হোমান্সের মতে, মানুষ তার ব্যক্তিগত লাভ সর্বোচ্চ করার লক্ষ্যে যৌক্তিক গণনার ওপর ভিত্তি করে আচরণ করে।

২। অধিকাংশ মানুষই গ্রহণযোগ্যতা, বিশ্বস্ততা, আর্থিক সহযোগিতা, স্নেহ ও সহচর্য্য কে মূল্য দেয় এবং তার জন্য কোন ব্যক্তির সাথে সম্পর্ক যা আমাদের সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি করে তাকে আমরা ফলপ্রসূ বিবেচনা করি। তা্‌ই এ ধরনের সম্পর্ক তৈরীতে মানুষ আগ্রহী হয়ে থাকে।

৩। অন্যদিকে সামাজিক সম্পর্কে মূল্য আবির্ভূত হয় যেখানে সেখানে মানুষের জন্য নেতিবাচক Value কাজ করে।

৪। এই সামাজিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে Cost এবং Reward এর  net outcome এক থাকে।

অর্থাৎ হোমান্স যে সমাজিক সম্পর্কে বা সমাজিক বিনিময়ের কথা বলেছেন তা মূলত Cost এবং Benefit নির্ভর। একজন আরেকজনের সাথে তখনই সামাজিক সম্পর্ক করবে যখন তাদের  Cost benefit analysis তাদের অনুকুলে থাকবে এবং ব্যক্তি মর্যাদা বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। হোমান্স তার সামাজিক বিনিময় তত্ত্বে benefit বুঝাতে reward শব্দটি ব্যবহার করেছেন এবং তিন প্রস্তাবনার মাধ্যমে সামাজিক বিনিময়ের পুরো বিষয়টি ব্যাখ্যা করেছেন।

সামাজিক বিনিময় তত্ত্বের প্রয়োগ:

বিভিন্ন ক্ষেত্রে আমরা সামাজিক বিনিময় তত্ত্বের প্রয়োগ দেখতে পাই। বিশেষ করে যোগাযোগের ক্ষেত্রেও গণমাধ্যমগুলোতে এই তত্ত্বের প্রয়োগ সবচেয়ে বেশি লক্ষ করা যায়। নিম্নে সামাজিক বিনিময় তত্ত্বের প্রয়োগ আলোচনা করা হলো- 

যোগাযোগ ক্ষেত্রে সামাজিক বিনিময় তত্ত্বের প্রয়োগ:

সামাজিক বিনিময় তত্ত্ব মানুষের আন্তঃসম্পর্ক বিকাশে সহায়তা করে। এই তত্ত্বের প্রয়োগের মাধ্যমে মানুষ তার অগভীর সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে রূপান্তরিত করতে পারে। তাছাড়া একজন আরেকজনের চাহিদা এবং চিন্তা সম্পর্কে ভাবে বা তাদের কার্যকরী সম্পর্ক তৈরিতে সাহায্য করে। এই তত্ত্ব থেকে অর্জিত জান মানুষের মধ্যকার যোগাযোগ ও সম্পর্ক দৃষ্টিতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে।

গণমাধ্যমের ক্ষেত্রে সামাজিক বিনিময় তত্ত্বের প্রয়োগ:

আধুনিক বিশ্বে তথ্যের অবাধ প্রবাহের সুন্দর দৃষ্টান্ত বুঝা যায় স হোমান্সের সামাজিক বিনিময় তত্ত্বের মাধ্যমে। এই তত্ত্বটি ৪ গণমাধ্যমেও বিশেষভাবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এই তত্ত্বটি মানুষের সম্পর্কের ক্ষেত্রে যেভাবে Cost benefit analysis-এর ব্যাখ্যা দিয়েছে মিডিয়া তা পর্যালোচনা করে তার ব্যবসার কাজে। স মানুষের সামাজিক সম্পর্কের বিষয়গুলো মাথায় রেখেই -গণমাধ্যমগুলো মূলত তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে।


পরিশেষে বলা যায় যে, সমাজবিজ্ঞানের তাত্ত্বিক আলোচনায় জর্জ হোমান্সের সামাজিক বিনিময় তত্ত্বটি একটি বিশেষ সংযোজন। তবে এটি কেবলমাত্র তাত্ত্বিক সমাজবিজ্ঞানেই নয়, প্রায়োগিক সমাজবিজ্ঞানেও সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। সর্বোপরি হোমান্স এর সামাজিক বিনিময় তত্ত্বটি সমাজবিজ্ঞানের অবিচ্ছেদ্য অংশ।

এই তত্ত্ব মানুষের পারস্পরিক সম্পর্ক, সামাজিক আচরণ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া বিশ্লেষণে বাস্তবভিত্তিক ও কার্যকর কাঠামো প্রদান করে। আধুনিক সমাজে ব্যক্তি কেন কাকে, কখন, কীভাবে মূল্য দেয়—তা বিশ্লেষণ করতে হোমান্সের তত্ত্ব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অতএব, এই তত্ত্ব আজও প্রাসঙ্গিক।

No comments:

Post a Comment