সামন্ততন্ত্র বলতে কি বুঝায়?
রোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর মধ্যযুগে ইউরোপে বিশেষ করে পশ্চিম ইউরোপে দাসপ্রথা নির্ভর সমাজব্যবস্থায় অরাজকতা ও বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়। এ অরাজকত, বিশৃঙ্খলা ও অস্থিরতার কারণে একসময় দাসপ্রথা সমাজব্যবস্থা ভেঙে পড়ে ঠিক তখনই নতুন একটি সমাজ ব্যবস্থা গড়ে উঠে যার নাম সামন্তপ্রথা। দাসপ্রথার পর এটি নতুনভাবে রাজনীতি ও অর্থনীতি নিয়ে ভূমি ব্যবস্থায় সামরিক কাঠামোর মাধ্যমে নতুন প্রশাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলে যা ইতিহাসে সামন্তপ্রথা নামে পরিচিত।
সামন্ততন্ত্রঃ feudalism বা সামন্তবাদ শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে ল্যাটিন শব্দ Feodails এবং ফরাসি শব্দ Feodalite থেকে। Feud বা Fief থেকে এসেছে Feudalism শব্দটি। Feudalism এর অর্থ হচ্ছে সামন্ত প্রভূদের অধীনস্থ ভূখন্ড। fief এর মালিক বা লর্ডদেরকে খাজনার শর্তসাপেক্ষে যেসব কৃষক বা প্রজারা জমি চাষাবাদ করতো তাদেরকে সামন্ত বা vessel বলা হতো।একই অর্থে সম্রাটের vessel ছিলো রাজা বা সামন্ত প্রভুরা। কারণ এই সামন্তপ্রভূরা vessel দের মতো সম্রাটকে খাজনা দিত অথবা vessel এর প্রয়োজনে ভূমি গ্রহণকারী সামন্তপ্রভূরা তাদের সাময়িক সাহায্য প্রদানে অঙ্গিকারবদ্ধ থাকতো। এ কারণে একে একটি সরকার ব্যবস্থা হিসেবেও ব্যাখ্যা করা হয়। এখানে রাজনীতিক ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণসহ সামরিক সাহায্যের বিনিময়ে ভূমিবন্টন ও চাষাবাদের ব্যবস্থা বিদ্যমান ছিল। মোটকথা মধ্যযুগের এক বিশেষ ধরনের উৎপাদন বা অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ছিলো সামন্তপ্রথা। মধ্য যুগে ইউরোপে যে তিনটি স্তম্ভ উপর ভিত্তি করে তাদের সমাজ ও সভ্যতার সৌধ নির্মিত হয়েছিল বলে স্বীকৃত, সেই তিনটি স্তম্ভের মধ্যে সামন্ততন্ত্র একটি।
প্রামাণ্য সংজ্ঞাঃ সামন্ততন্ত্রকে বিভিন্ন ঐতিহাসিক সমাজবিজ্ঞানী এবং দার্শনিকগণ বিভিন্নভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন।নিম্নে কয়েকটি সংজ্ঞা তুলে ধরা হলো-
টি ডব্লিউ ওয়ালবার্ক ও টেইলর বলেন সামন্ততন্ত্র এমন একটি সরকার ব্যবস্থা যার বৈশিষ্ট্য ছিলো অভিজাত সম্প্রদায়ের মধ্যে রাজনৈতিক ও সামরিক ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ। বিশিষ্ট অধ্যাপক ড. নাজমুল করিম বলেন সামন্ততন্ত্র হচ্ছে এমন একটি সমাজ ও সাংস্কৃতি যেখানে ভূমিই হচ্ছে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতার ভিত্তি।
স্টাবস এর মতে ''সামন্ততন্ত্র ভূমি ব্যবস্থার মাধ্যমে নির্মিত সমাজের একটা সংগঠন যেখানে রাজা থেকে নিম্ন স্তরের ভূমি মালিক সবাই কতকগুলো নীতি ও নিরাপত্তার মাধ্যমে বাধিত থাকে।''
ঐতিহাসিক গ্যানশিপ বলেন ''লর্ডের জমি প্রদান আর ভেসেলের জমি গ্রহণের ফলে এ দুইজনের সম্পর্কের মধ্যে যে ব্যবস্থার উদ্ভব ঘটেছিল তাই সামন্ততন্ত্র।
বি কে গোকহেল এর মতে ''নিরাপত্তা সেবা প্রদানের মূলনীতির উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠে সামাজিক ব্যবস্থা। সৈন্য সামন্তসহ অভিজাত শ্রেণী যাদের নিরাপত্তা দরকার তাদেরকে নিরাপত্তা প্রদান করে বিনিময়ে তাদের কাছ থেকে সেবা ও প্রদেয় মূল্য নিশ্চিত করে।
উপরিউক্ত সংজ্ঞার আলোকে বলা যায় যে, কতকগুলো বিধিব্যবস্থা এবং প্রথার সমষ্টিই হচ্ছে সামন্ততন্ত্র যেখানে শক্তিশালী মানুষ সেবার বিনিময়ে দুর্বল মানুষকে সাহায্য করবে।
পরিশেষে বলা যায় যে ইউরোপে একাদশ শতকে যে বিশেষ সমাজ ব্যবস্থার উদ্ভব হয়েছিল তাই সামন্ততন্ত্র। এই প্রথা অষ্টাদশ শতকে শিল্প বিপ্লবের পরবর্তী সময়ে বিলুপ্তির সম্মুখীন হয়।